নিয়ন্ত্রণই ডায়াবেটিস রোধের 'মূলমন্ত্র'

ডায়াবেটিস হয়েছে জেনে দুর্ভাবনার কিছু নেই। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পরিবর্তিত জীবনপ্রণালি ও নিয়মিত ওষুধ সেবনে এই রোগনিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট হাঁটা ও হালকা ব্যায়াম করতে হবে। ছবিটি প্রতীকী।  প্রথম আলো
ডায়াবেটিস হয়েছে জেনে দুর্ভাবনার কিছু নেই। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পরিবর্তিত জীবনপ্রণালি ও নিয়মিত ওষুধ সেবনে এই রোগনিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট হাঁটা ও হালকা ব্যায়াম করতে হবে। ছবিটি প্রতীকী। প্রথম আলো

সাফিয়া সুলতানা। বয়স ৩৪। চেম্বারে ঢুকলেন অত্যন্ত বিষণ্ন চেহারা নিয়ে। কী সমস্যা জিজ্ঞেস করতেই খুব মন খারাপ করে উত্তর দিলেন, ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। এরপর যত প্রশ্নই করছিলাম, উত্তর দিচ্ছিলেন অন্যমনস্কভাবে। জিজ্ঞেস করলাম, ডায়াবেটিস ধরা পড়াতে আপনার কি খুব মন খারাপ? এরপর আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না, অঝোরে কেঁদে দিলেন। এর ঠিক এক মাস পরেই তিনি হাসতে হাসতে চেম্বারে ঢুকলেন, হাতে নিয়ন্ত্রিত একটি ডায়াবেটিসের রিপোর্ট।

সাফিয়ার মতো এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা ডায়াবেটিস রোগটিকে প্রথমে সহজে মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু সঠিক ধারণা থাকলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই ডায়াবেটিস সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রত্যেকের জন্য জরুরি। কেননা, বর্তমানে বিশ্বে ডায়াবেটিস মহামারি আকার ধারণ করেছে। পৃথিবীতে প্রায় ৪২ কোটির বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা হবে প্রায় দ্বিগুণ। এ ছাড়া ১৮ বছর বয়সের ওপরে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ১৯৮০ সালে ছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ, যা বর্তমানে ৮ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। (সূত্র: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা)

ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। কিন্তু আক্রান্তের ৫৭ শতাংশই জানে না তাদের ডায়াবেটিস আছে। বিশেষ করে মধ্যম ও স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে (এশিয়া, আফ্রিকা) এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি, যেখানে খুব দ্রুত খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন চলছে।

আমরা খাবার খেলে শরীরে সেই খাদ্যের শর্করা ভেঙে চিনি বা গ্লুকোজে পরিণত হয়। অগ্ন্যাশয় নামক গ্রন্থি থেকে ইনসুলিন নামের হরমোন নিঃসৃত হয়, যার মাধ্যমে শরীরের কোষগুলো গ্লুকোজ গ্রহণ করতে পারে এবং গ্লুকোজ থেকে আমাদের শরীর শক্তি উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু যদি কোনো কারণে এই ইনসুলিন একেবারেই তৈরি হতে না পারে, প্রয়োজনের তুলনায় কম তৈরি হয় বা ইনসুলিন তৈরি হয় ঠিকই কিন্তু সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না, তখনই আমাদের ওই গ্লুকোজ কোষে না ঢুকে রক্তে জমা হতে থাকে। এটাই ডায়াবেটিস রোগ।

বিভিন্ন ধরনের ডায়াবেটিস আছে। যেমন টাইপ ওয়ান ও টাইপ টু। টাইপ ওয়ানে ডায়াবেটিস রোগীর অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন একেবারেই উৎপাদিত হয় না, ফলে রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। অটো ইমুউনিটি (শরীরের নিজস্ব কোষের বিরুদ্ধে নিজেরই প্রতিরোধ তৈরি হওয়া), জিনগত সমস্যা বা অগ্ন্যাশয়ে ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলো নষ্ট হয়েও এ রোগ হতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের ১০ শতাংশ এই টাইপ ওয়ানে আক্রান্ত। শৈশব থেকেই এই ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। সঠিক নিয়ন্ত্রণ না থাকলে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জটিলতা প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।

টাইপ টু ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে শরীরে পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরি হয় না, বা হলেও তা সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ রোগীই টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। মাঝবয়সী বা বৃদ্ধ ব্যক্তিদেরই এই ধরনের ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। তবে বর্তমানে কম বয়সে টাইপ টু ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর অন্যতম কারণ স্থূলতা, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও কায়িক পরিশ্রমের স্বল্পতা। তা ছাড়া পারিবারিক ইতিহাসও এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।

ডায়াবেটিসের অন্যান্য ধরনের মধ্যে রয়েছে গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস। এ ছাড়া অন্যান্য হরমোন, রোগ ও কিছু ওষুধ দীর্ঘদিন সেবনে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

ডায়াবেটিস শনাক্ত করার কিছু উপসর্গ থাকলেও, অর্ধেকের বেশি রোগীর কোনো লক্ষণই থাকে না। অন্য কোনো রোগের চিকিৎসায় বা অস্ত্রোপচারের আগে রুটিন চেকআপের সময় ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। উপসর্গগুলোর মধ্যে ঘন ঘন পিপাসা, অতিরিক্ত ক্ষুধা ও ক্লান্তি, ঘন ঘন ও অধিক পরিমাণে প্রস্রাব হওয়া, উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ ছাড়াই শরীরের ওজন দিন দিন কমে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হওয়া, বারবার ইনফেকশন, ফোঁড়া, বিচি–পাঁচড়া ও অন্যান্য চর্মরোগ হওয়া, শরীরের কোনো কাটাছেঁড়া বা ঘা শুকাতে দেরি হওয়া, নারীদের সাদা স্রাব, চুলকানি, বারবার বাচ্চা নষ্ট হওয়া বা বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণও হতে পারে ডায়াবেটিস। এ ছাড়া অনেক রোগী ‘ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিস’ নিয়েও আসতে পারে, যাকে আমরা ডায়াবেটিসের জটিল ও জরুরি অবস্থা বলে থাকি। দ্রুত চিকিৎসা না করলে এ ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে টাইপ ওয়ান রোগীদের ক্ষেত্রে এটি বেশি হতে পারে, তবে এটি টাইপ টুর বেলায়ও হয়।

নিয়ন্ত্রণ করুন ডায়াবেটিস

ডায়াবেটিস হয়েছে জেনে দুর্ভাবনার কিছু নেই। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পরিবর্তিত জীবনপ্রণালি এবং নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব কিছু নয়।

চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীর বয়স, উচ্চতা, বর্তমান ওজন ও প্রাত্যহিক পরিশ্রমের ধরন বুঝে নির্দিষ্ট খাদ্যতালিকা প্রণয়ন করা হয়, যা তার মেনে চলা উচিত। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট মধ্যম মাত্রার শারীরিক পরিশ্রম, যেমন হাঁটার অভ্যাস করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ৩ দিন হাঁটবেন, তবে লক্ষ রাখতে হবে, পরপর দুই দিন হাঁটা বা ব্যায়াম থেকে যেন বিরত থাকা না হয়। চিনি, গুড় বা এসব দিয়ে তৈরি খাবার, প্রক্রিয়াজাত মিষ্টি খাবার ও কোমল পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। সাদা আটার পরিবর্তে ভুসিওয়ালা লাল আটাই উত্তম। প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি খাবেন।

এক বেলা খাবার বাদ দিয়ে পরের বেলা পেট ভরে খাওয়া বা এক বেলা বেশ পেট ভরে খেয়ে দীর্ঘক্ষণ বিরতি দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস ঠিক না। বিরতি দিয়ে অল্প করে খাবার খেতে হবে। একবারের বেশি খাওয়া যাবে না। আমাদের দৈনিক খাদ্যাভ্যাসের মূল খাবার, যেমন সকালের নাশতা, দুপুরের ও রাতের খাবারের পাশাপাশি সকালের একটি হালকা নাশতা, যা সকাল ও দুপুরের মাঝামাঝি সময়ে এবং বিকেলের হালকা নাশতা, যা দুপুর ও রাতের খাবারের মাঝামাঝি সময়ে করতে হবে। অর্থাৎ একজন ডায়াবেটিসের রোগীকে দিনে পাঁচবার খেতে হবে। কিন্তু তা হতে হবে পরিমিত। ধূমপান পরিহার জরুরি। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের মুখে খাওয়ার ওষুধ বা ইনসুলিনের মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসা করা হয়।

মুখে খাবার ওষুধের ক্ষেত্রে, কোনটি খাবার আগে ও কোনটি পরে খেতে হয়, তা চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নেবেন। নিজে নিজে ওষুধের মাত্রা পরিবর্তন করবেন না। এতে গ্লুকোজ অতিমাত্রায় কমে বা বেড়ে গিয়ে মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

ব্যবস্থাপত্রে ইনসুলিন দেওয়ার সময় প্রায়ই দেখা যায়, রোগীরা তা গ্রহণ করতে চান না। মনে রাখতে হবে, ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ। চিকিৎসার যে পর্যায়ে মুখে খাবার ওষুধ ব্যর্থ হয়, তখনই ইনসুলিন নিতে হয়।

ইনসুলিন প্রয়োগের সঠিক পদ্ধতি জানা জরুরি। ইনসুলিন যখন অপরিহার্য, তখন সময়মতো ইনসুলিন না নিলে, ডায়াবেটিসের জটিল অবস্থা তৈরি হওয়ার ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সুযোগ কিন্তু আপনিই করে দিলেন। তাই ইনসুলিনকে ভয় পাবেন না। বাজারে এখন অত্যাধুনিক ইনসুলিন ও তা প্রয়োগের পেন, নিডেল পাওয়া যায়, যাতে ব্যথা তুলনামূলকভাবে কম হয় এবং সহজেই যে কেউ এগুলো ব্যবহার করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, ডায়াবেটিস চিকিৎসায় শুধু চিকিৎসকের পক্ষে ওষুধ ও পরামর্শ দিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ না রোগী নিজে সঠিক নিয়ম না মেনে চলবেন। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস অন্ধত্ব, কিডনি বিকল, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এমনকি নিম্নাঙ্গে পচন ধরে কেটে ফেলে দেওয়ারও অন্যতম কারণ। তাই সময় থাকতে নিজের ডায়াবেটিস সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে।

নিয়মিত ডায়াবেটিস চেক করার পাশাপাশি বছরে অন্তত একবার কিডনি, হার্ট, চক্ষু ও রক্তের কোলেস্টেরল পরিমাপ করবেন। ডায়াবেটিস নিয়ে অযথা মানসিক চাপে ভুগবেন না। মনে রাখবেন, ডায়াবেটিস যেন কোনোভাবেই আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ না পায়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ