সন্তানের অটিজম জয়ের সংগ্রাম
প্রায় তিন দশক ধরে অটিজম আক্রান্ত ছেলেকে বড় করছেন। একদিকে নিজের চিকিৎসাপেশা, অন্যদিকে সংসার। সবকিছু ছাপিয়ে ছেলে অর্ণবকে বড় করার সংগ্রামে নেমেছিলেন বাসনা মুহুরী। তাঁর অটিজম জয়ের এই সংগ্রাম এখনো চলছে।
দিন শুরু রোজকার মতো অর্ণবকে নিয়ে। বাবা ওঠো, হাঁটতে যাব। শোয়া থেকে উঠে তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে সাদা গেঞ্জি নিয়ে আমার কাছে আসে পরিয়ে দিতে, বলি নিজে নিজে গায়ে দাও। অর্ণব নিজে নিজে পরে নেয় গেঞ্জি। এটা শিক্ষক এবং ঘরের অনেক অনেক দিনের প্রচেষ্টার ফল।
অর্ণবের জন্য প্রাতভ্র৴মণ খুবই প্রয়োজন। সে শুধু অটিজম আক্রান্ত নয়, তার আছে মৃগী রোগ (খিঁচুনি)। অটিজম আক্রান্তদের অনেকেরই মৃগী রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই হার ২০-৩০ শতাংশ।
এ ছাড়া অর্ণবের ডায়াবেটিস দেখা দিয়েছে তিন বছর ধরে। ওষুধের পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা, প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪০ মিনিট হাঁটা প্রয়োজন। এসব নিয়মকানুন মেনে চলা জরুরি। তবে খুব কষ্টসাধ্য একজন অটিজম আক্রান্তের ক্ষেত্রে। অর্ণবের কথাই যদি বলি, যোগাযোগে এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। নানা সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছি ছেলেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে।
অর্ণবের প্রথম থেকেই খাবারে সমস্যা ছিল। পরিবারের সবার চেষ্টায় খাবারের সূচি নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছে। খাবারের পরিমাণ, খাওয়ার সময় ও খাদ্যতালিকা করা হয়েছে। এ জন্য অনেক সচেতন হতে হয়।
অটিজম আক্রান্তদের খাবারের ক্ষেত্রে সচেতনতা জরুরি। যেমন বিস্কুট, চানাচুর ইত্যাদি খেলে বেশি হাইপার হয়ে যেতে পারে। এখন সে বিশেষ খাবারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কোমল পানীয়ের (কোক) প্রতি ছিল খুবই আসক্তি। এখন তা সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়েছে।
সে অনেক বেশি পরিমাণে ভাত এবং মাংস খেতে পছন্দ করত, মাছ বা সবজি তেমন খেতে চাইত না। কিন্তু এখন সে আমাদের পরিমাপমতো ভাত-মাছ খায়, প্রচুর সবজি খায়, করলা এখন তার খুব পছন্দ।
অটিজম আক্রান্ত সন্তানের অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের খাবারের ব্যাপারে সচেতন নন, অনেকেই আবার চেষ্টা করেও সফল হচ্ছেন না। একটু ধৈর্য ধরে চেষ্টা করলে সম্ভব। অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার, কোক, জুস, টেস্টিং সল্ট, চিনিযুক্ত খাবার ইত্যাদি অটিজম আক্রান্তদের ক্ষেত্রে বাদ দেওয়া ভালো।
আমরা অর্ণবকে নিয়ে কোনো রেস্তোরাঁ বা নিমন্ত্রণে গেলে সেখানে আগে থেকেই সাদা ভাতের ব্যবস্থা করে নিতাম।
টেবিল থেকে কোমল পানীয় সরিয়ে ফেলতাম। সে যা খেতে পারবে না, তার সামনে আমরাও সাধ্যমতো চেষ্টা করি সেটা না খাওয়ার। প্রয়োজনে লুকিয়ে খেতে হবে।
অটিজম আক্রান্ত ছেলেমেয়েদের থেরাপি, শিক্ষা এবং বিশেষ যত্নের পাশাপাশি খাবারদাবারের ব্যাপারেও অভিভাবকদের যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। জিএফসিএফ খাবার সবার ক্ষেত্রে উপকারী নাও হতে পারে। পরীক্ষামূলকভাবে কয়েক মাস দিয়ে দেখা যায়।
আমি কোনো অটিজম বিশেষজ্ঞ নই, অর্ণবকে লালনপালন করতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বিনিময় করছি। অটিজম বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিই।
অটিজমের সঙ্গে দীর্ঘ প্রায় তিন দশক পথ চলায় এটুকু বুঝতে পেরেছি, হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। প্রাথমিক অবস্থায় যা আছে তা দিয়ে পরিবারের সবাই মিলে সন্তানের পরিচর্যা করলে অটিজম থেকে উত্তরণ অনেকটাই সম্ভব।
সরকার অটিজমের ব্যাপারে এখন অনেক অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছে। জনগণও এখন অনেক সচেতন। আরও বেশি সচেতন এবং সহায়ক হওয়া প্রয়োজন।
আমার কাছে সন্তানই প্রাণ, আমার জীবনীশক্তি, আমার কাজের প্রেরণা ।
লেখক: শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ