অনুপ্রেরণায় নকশা

মডেল ইন্দ্রাণী, রিবা ও দোয়েলের পেশাজীবনে বাঁকবদল হয়েছে নকশার মাধ্যমে। সাজ: নুজহাত খান, কৃতজ্ঞতা: স্টুডিও ক্যানভাস, ছবি: কবির হোসেন
মডেল ইন্দ্রাণী, রিবা ও দোয়েলের পেশাজীবনে বাঁকবদল হয়েছে নকশার মাধ্যমে। সাজ: নুজহাত খান, কৃতজ্ঞতা: স্টুডিও ক্যানভাস, ছবি: কবির হোসেন
>

কারও হয়তো প্রথম ফটোশুট নকশায়, নকশায় ছবি প্রকাশের পরপরই কেউ মডেলিংয়ে সুযোগ পেয়েছেন। আবার নকশার একটা ফটোশুট বদলে দিয়েছে পেশাজীবনের গতিপথ। মডেল থেকে হয়েছেন সুপারমডেল। অনেক কাজের মধ্যেও নকশার কাজকে এখনো মনে করেন বিশেষ। এমন ছয়জন মডেল, কোরিওগ্রাফার ও অভিনেত্রী নকশার আজকের আয়োজনে লিখেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। ৪ নভেম্বর প্রথম আলোর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এবারের বিশেষ নকশায় আরও থাকছে পাঠক ও রান্নাবিদের অনুপ্রেরণার গল্প

আজরা মাহমুদ, মডেল ও কোরিওগ্রাফার
আজরা মাহমুদ, মডেল ও কোরিওগ্রাফার


নকশায় ছবি এলে পরিবারে আনন্দ বয়ে যায়
আজরা মাহমুদ, মডেল ও কোরিওগ্রাফার

সারা বছর নানা কাজে ব্যস্ত থাকি। কিন্তু পরিবারের লোকজন অপেক্ষায় থাকেন কবে নকশায় আমার ছবি ছাপা হবে। মজার ব্যাপার হলো, এত দিন হয়ে এল মিডিয়ায় কাজ করছি, অন্য জায়গায় কী করছি, তা নিয়ে তাঁদের খুব একটা উচ্ছ্বাস নেই। কিন্তু নকশার ছবি দেখার ব্যাপারে তাঁদের আগ্রহের এখনো কোনো কমতি নেই। বিশেষ করে আমার দাদিশাশুড়ি, যেদিন নকশায় আমার ছবি ছাপা হয়, সেই নকশা যত্ন করে তুলে রাখেন। আর বাড়িতে যে–ই আসেন, তাঁকেই সেই ছবি বের করে দেখান। অন্য কোনো জায়গায় যত কাজই করি না কেন, নকশায় ছবি এলে পরিবারের লোকজনের খুশি হয় দেখার মতো।

আসিফ আজিম, মডেল ও অভিনেতা
আসিফ আজিম, মডেল ও অভিনেতা


মডেল থেকে সুপার মডেল
আসিফ আজিম, মডেল ও অভিনেতা

মেহেরপুরের ছেলে আসিফ আজিম। ঢাকায় এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। ঢাকা থেকে পৌঁছে গেলেন ভারতের মুম্বাই। হলেন সুপার মডেল। এরপর তো প্যারিস, লন্ডন, নিউইয়র্ক, সিডনি, দুবাইসহ বিশ্বের বড় বড় শহরে ছুটেছেন। আজ এই দেশ তো কাল অন্য দেশ। দেশ–বিদেশের বিখ্যাত ডিজাইনারদের সঙ্গে কাজ করেছেন। হয়েছেন সর্বভারতীয় সেরা দশ পুরুষ মডেলের একজন। এ ছাড়া একটা সময় বিশ্বের সেরা ১০০ নারী–পুরুষ মডেলের তালিকায় উঠে আসে তাঁর নাম।

তবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পাওয়া এই সুপার মডেলের ছবি নকশায় ছাপা হয়েছিল ২০০০ সালে। নকশার প্রচ্ছদে ছাপা হওয়া সেই ছবিতে আসিফের পরনে ছিল মেরুন রঙের একটি পাঞ্জাবি। আর এই ছবিকেই আসিফ আজিম তাঁর জীবনের ‘টার্নিং পয়েন্ট’ মনে করেন। নকশার আগে মডেল হতে গিয়েছিলেন ফ্যাশন হাউস আলতামিরায়। আসিফ আজিম বলেন, ‘নকশায় এই ছবি ছাপা হওয়ার পরই আড়ং, ক্যাটস আইসহ বেশ কয়েকটি বড় ব্র্যান্ড থেকে ডাক আসে।’ এরপর কাজ করেন বিবি রাসেল, প্রয়াত শাহরুখ শহীদ, সব্যসাচী মুখার্জি, মণিষ মালহোত্রা, রোহিত বালসহ বিখ্যাত অনেক ডিজাইনারের সঙ্গে। হয়েছেন একাধিক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল।

মেদহীন শরীর, পর্যাপ্ত উচ্চতা, তীক্ষ্ণ চোখ আর সুন্দর ব্যবহার দিয়ে আসিফ দ্রুত পৌঁছে যান সেরাদের দলে। আর এই জনপ্রিয়তার জন্যই ২০১৩ সালে ডাক পান ভারতের জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো বিগ বস ৭–এর আসরে। কাজের সুবাদে দীর্ঘদিন ধরে আসিফ মুম্বাইতে আছেন। ২০১৮ সালে বলিউডের সিনেমা কাশিতে কৃতি শ্যাননের বিপরীতে নায়ক হিসেবে শুটিং শুরু করেন। ১১ দিন শুটিং করার পর সেটেই একটি বড় দুর্ঘটনায় পড়েন আসিফ। নিজের একটি কাজে বর্তমানে দেশে থাকা আসিফ আজিম জানালেন, ‘পুরোপুরি ফিট হয়ে দ্রুত কাজে ফিরতে চাই। বাংলাদেশ ও ভারতের বেশ কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে পরিকল্পনা করেছি। আশা করি, নতুন বছরে বেশ কিছু ভালো খবর দিতে পারব।’

শবনম ফারিয়া, অভিনেত্রী
শবনম ফারিয়া, অভিনেত্রী


মায়ের কাছে সংগ্রহে থাকে
শবনম ফারিয়া, অভিনেত্রী

প্রথম আলো পত্রিকা প্রকাশের প্রথম দিন থেকেই আমার পরিবারের সবাই এর পাঠক। যখন মিডিয়ায় কাজ শুরু করেছি, তখন পরিবারের সবার একটা চাওয়া ছিল নকশার প্রচ্ছদে যেন আমি কাজ করি। কারণ, তাঁদের কাছে এটা ছিল একটা মাইলফলক। এখন পর্যন্ত নকশায় ছাপা হওয়া প্রতিটি ছবি আমার মা খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছেন।

নকশায় সব ধরনের পাঠক রয়েছে, যে কারণে ছবি ছাপা হলে দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। আমার নিজের একটা শুটের কথাই বলি। রুপার গয়না নিয়ে নকশায় একটি প্রচ্ছদের কাজ করেছিলাম। ছবিটি যেদিন ছাপা হয়, সেদিন আত্মীয়স্বজন তো ফোন দিয়েছিলেনই, অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার ছিল, স্কুলের বন্ধু–বান্ধবদের ফোন। এই ব্যস্ততার সময়ও একটা কাজ দেখে মানুষ যখন ফোনে প্রশংসা করে, তা সত্যিই অন্য রকম ভালো লাগায় মনকে ছুঁয়ে দেয়।

দিলরুবা দোয়েল, মডেল ও অভিনেত্রী
দিলরুবা দোয়েল, মডেল ও অভিনেত্রী


জীবনের গল্প বদলে দিল নকশা
দিলরুবা দোয়েল, মডেল ও অভিনেত্রী

আমার বড় বোন ছিলেন সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্রী, যে কারণে গণমাধ্যমের অনেকের সঙ্গেই ছিল চেনাজানা। সেই সূত্রেই প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক কবির হোসেনের সঙ্গে পরিচয়। একদিন কবির হোসেন বললেন, ‘তুমি নকশার মডেল হবে?’ আমি মডেল হব, এই ভাবনাই তো কখনো মাথায় আসেনি। তা–ও আবার নকশার? কবির হোসেনকে বেশ মজা করেই উত্তর দিয়েছিলাম, ‘হুম, করব, যদি প্রচ্ছদে নেন।’

সেই কথা অনুযায়ী নকশা থেকে একদিন ডাক এল। নকশার প্রচ্ছদের শুটের জন্য। যখন শুট করছি, তখনো বুঝিনি আসলে কী হতে যাচ্ছে। জীবনের গল্পটাই বদলে গেল সেদিন, যেদিন নকশার প্রচ্ছদে ছাপা হলো আমার ছবি। অনেক ফোন, মানুষের ভালোবাসায় ভেসে গেলাম আমি। কয়েক দিনের মধ্যেই অনেক জায়গা থেকে কাজের সুযোগ এল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সার্ফ এক্সেলের বিজ্ঞাপন।

নকশার জনপ্রিয়তার কথা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে একটি ছবি যে এতটা সাড়া পাবে, তা সত্যিই ভাবতে পারিনি। না, এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এভাবেই নকশা থেকে একে একে ফ্যাশন শো, মডেলিং, চলচ্চিত্র নামক শব্দগুলো জড়িয়ে গেল আমার জীবনের সঙ্গে।

সাবরিনা জামান রিবা, মডেল
সাবরিনা জামান রিবা, মডেল


পয়লা বৈশাখের শুট ছিল টার্নিং পয়েন্ট
সাবরিনা জামান রিবা, মডেল

২০১০ সালের ঘটনা। টুকটাক মডেলিংয়ের কাজ করছি। সেই সময় নকশার তৃতীয় পৃষ্ঠায় সানসিল্কের বিজ্ঞাপনে আমার হেয়ারস্টাইলের একটি ছবি ছাপা হয়েছিল। সেই ছবি ছাপা হওয়ার পর বেশ কিছু ফ্যাশন শোতে ডাক পেয়েছিলাম। তবে নকশায় ছাপা হওয়া যে ছবিটি আমার ক্যারিয়ারের গল্প বদলে দেয়, সেটা ছিল ২০১১ সালের পয়লা বৈশাখের একটি শুট। নকশার প্রচ্ছদে বৈশাখী সাজে সেদিন আড়ংয়ের পোশাক পরেছিলাম। নকশার প্রচ্ছদে ছবি ছাপা হচ্ছে, এই আনন্দ তো অবশ্যই অন্য রকম ছিল। কিন্তু ছাপা হওয়ার পর যে সাড়া পেয়েছি, তা ছিল কল্পনাতীত।

সেই ছবি ছাপা হওয়ার পরই আড়ংয়ের মডেল হওয়ার সুযোগ আসে। আরেকটা মজার ব্যাপার, আমার নানি যখন বেঁচে ছিলেন, তখন দেখতাম তিনি প্রতিটি নকশা জমিয়ে রাখতেন। সেই নকশাতেই যখন আমি মডেল হলাম, পরিবারের মানুষের কাছে সে আনন্দ ছিল একেবারেই অন্য রকম। এখনো যখন নকশায় ছবি ছাপা হয়, আমার বাসার সামনের যে দোকান থেকে মোবাইল ফোনে ফ্লেক্সিলোড করি, সেই দোকানি বলেন, ‘আপা, আপনের ছবি আইছে পেপারে, ওই পেপারটা কাইটা রাখছি।’

ইন্দ্রাণী দাশ, মডেল এবং টিভি ও মঞ্চ উপস্থাপক
ইন্দ্রাণী দাশ, মডেল এবং টিভি ও মঞ্চ উপস্থাপক


ফ্রিদা কাহ্‌লো হব ভাবতেই পারিনি
ইন্দ্রাণী দাশ, মডেল এবং টিভি ও মঞ্চ উপস্থাপক

ছাপা কাগজে আমার মডেল হওয়ার সুযোগ আসে প্রথম আলোরনকশার হাত ধরে। নকশার শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল সেই ছবি। স্কার্টের প্রতিবেদনের ফটোশুট ছিল। এর আগে ছোট কিছু প্রতিষ্ঠানে শাড়ির মডেল হয়েছিলাম। সবাই মনে করত, শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাকে আমাকে মানায় না। নকশার সেই ছবি দেখে সবার ধারণা ভাঙল। পাশ্চাত্য ঘরানার পোশাকেও যে আমাকে মানাবে, এটা অনেকেই ভাবতেই পারত না।

সেই শুটের পর অনেক পত্রিকা আর ফ্যাশন হাউসে কাজের সুযোগ আসে। তবে যে শুটটা আমার আমিকে ভেঙে নতুন করে উপস্থাপন করল, সেটা ছিল ফ্রিদা কাহ্‌লোর শুট। নকশা থেকে যখন জানানো হলো যে ফ্রিদার কাজের জন্য তাঁরা আমার কথা ভাবছেন, তখন প্রায় না–ই করে দিয়েছিলাম, এই ভেবে যে ফ্রিদা কাহ্‌লোর লুক আমার মধ্যে আসবে না। তবে কাজটা যদি না করতাম, তবে যে কী ভুলটাই হতো! কারণ, ফ্রিদার ওই ছবি ছাপা হওয়ার পর যে সাড়া পেয়েছিলাম, সেটা খুব কম কাজেই মেলে।

এখানেই নকশার বিশেষত্ব। নতুন রূপে, নতুন বিষয়ে কাজ করে পাঠকদের চমকে দেয় তারা। আর আমরা মডেলরা বছরজুড়ে অপেক্ষায় থাকি এমন সুযোগ পাওয়ার।

সাবিলা নূর, অভিনেত্রী ও মডেল
সাবিলা নূর, অভিনেত্রী ও মডেল


নকশা মানেই বিশেষ কিছু
সাবিলা নূর, অভিনেত্রী ও মডেল

আমার আজকের এই সাবিলা নূর হয়ে ওঠার গল্পটা কিন্তু শুরু হয়েছে নকশার হাত ধরেই। ২০১১ সালের দিকে নকশার একটি বিউটি শুট করেছিলাম। ছবি তুলেছিলেন কবির হোসেন। সেই ছবি ছাপা হওয়ার পর হাঁসমার্কা নারকেল তেলের বিজ্ঞাপনে কাজের সুযোগ আসে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এখনো অপেক্ষা করি নকশায় কাজের জন্য। কারণ নকশা মানেই নতুন কিছু।