নাই-বা খেলাম পেঁয়াজ

পেঁয়াজে নানা ধরনের ভিটামিন, পটাশিয়াম ও প্রাকৃতিক তেল থাকে, যা রান্নার পর নষ্ট হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। ছবি: প্রথম আলো
পেঁয়াজে নানা ধরনের ভিটামিন, পটাশিয়াম ও প্রাকৃতিক তেল থাকে, যা রান্নার পর নষ্ট হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। ছবি: প্রথম আলো

প্রথমেই একটি কৌতুক বলি।
নতুন বউ বাড়িতে এনে শাশুড়ি বলছেন, ‘বউমা, দুইটার বেশি তিনটা নয়, একটা হলে ভালো হয়।’

বউমা তো লজ্জায় লাল। তার ওপর এ যুগের মেয়ে। শাশুড়িকে বলেই বসলেন, ‘মা, আপনার তো সাত সাতটি ছেলেমেয়ে, আমার ব্যাপারে এত কঠোর কেন?’

শাশুড়ি বললেন, ‘আরে মা, বাচ্চাকাচ্চার কথা বলছি না, বলছি তো তরকারিতে পেঁয়াজ দেওয়ার কথা।’

বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশে পেঁয়াজের বাজারে ঝাঁজ বাড়ছে। দেশি পেঁয়াজের দাম এখন ১৩০ থেকে ১৪৫ টাকা কেজি। বড় আকারের একটি পেঁয়াজের দাম ১০ থেকে ১২ টাকা। দামের কারণে প্রতিটি বাড়ির রান্নাঘরে পেঁয়াজ নিয়ে হাহাকার পড়ে গেছে। পেঁয়াজ ছাড়া রান্না ভাবাই যায় না। প্রতিটি রান্নার শুরুতেই কড়াইতে গরম তেলে পেঁয়াজকুচি ছেড়ে দেওয়ার একটা ‘ছ্যাঁৎ’ করা আওয়াজ দিয়েই রান্না শুরু হয়। আর এখন কিনা এই উচ্চমূল্যের জন্য পেঁয়াজ ধরলে হাতে ছ্যাঁকা লাগার দশা।

রান্নাবান্নার ইতিহাসে পেঁয়াজের ব্যবহার অত্যন্ত প্রাচীন। নিরামিষভোজী জাতিগুলো বাদ দিলে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিভিন্ন রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্যে পেঁয়াজ একটি মৌলিক উপকরণ। কাঁচা পেঁয়াজ সালাদ ও বিভিন্ন রকম ভর্তায় ব্যবহার করা হয়। কুচি করা পেঁয়াজ ভেজে বেরেস্তা করে বা সরাসরি রান্নার কাজে লাগানো হয়। বাঙালি ঘরের কোনো মজাদার রান্না খাবার পেঁয়াজ ছাড়া হবে, সেটা ভাবা দায়—সেটা মাছ, মাংস বা সবজি, যা–ই হোক। এ ছাড়া পেঁয়াজকে ভিনেগার বা সিরকায় ডুবিয়ে আচার বানানো হয়।

পেঁয়াজের উৎপাদন: এটি এমন একটি উদ্ভিদ, যা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই উৎপাদিত হয়। যেসব দেশে বৃষ্টি হয় না, পাশাপাশি হালকা শীত থাকে, সেসব দেশে পেঁয়াজ বেশি উৎপন্ন হয়। সে জন্য বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাষ হয় শীতকালে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় ভারত ও চীনে। অতিরিক্ত প্রয়োজন মেটানোর জন্য বাংলাদেশে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। তাই তো বিশেষ বিশেষ সময়ে পেঁয়াজের দাম যায় বেড়ে।

বাংলাদেশি পেঁয়াজ: বাংলাদেশের যেসব এলাকায় শীত বেশি থাকে, সেসব এলাকায় পেঁয়াজ বেশি জন্মায়। আমাদের দেশে পেঁয়াজ আকারে বেশি বড় হয় না। আকারে বেশি বড় না হলেও এ দেশের পেঁয়াজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি ঝাঁজালো বেশি হয়। কারণ, এতে এলিসিনের মাত্রা বেশি থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আর এই ঝাঁজালো স্বাদের জন্যই আমাদের দেশের পেঁয়াজ দিয়ে রান্না অনেক মজা হয়। পেঁয়াজ আসলে কোনো সবজি নয়, এটি একটি মসলাজাতীয় উদ্ভিদ। এর মূল উপাদান পানি, কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার।

কাঁচা অবস্থায় প্রতি ১০০ গ্রাম পেঁয়াজের পুষ্টিগত মান: শক্তি ৮০ ক্যালরি, শর্করা ৯ দশমিক ৩৪ গ্রাম, চিনি ৪ দশমিক ২৪ গ্রাম, ফাইবার ১ দশমিক ৭ গ্রাম, স্নেহ পদার্থ শূন্য দশমিক ১ গ্রাম ও প্রোটিন ১ দশমিক ১ গ্রাম।

পেঁয়াজে যেসব ভিটামিন আছে: থায়ামিন (বি১) শূন্য দশমিক ০৪৬ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লোবিন (বি২) শূন্য দশমিক ০২৭ মিলিগ্রাম, ন্যায়েসেন (বি8) শূন্য দশমিক ১১৬ মিলিগ্রাম, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড (বি৫) শূন্য দশমিক ১২৩ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ শূন্য দশমিক ১২ মিলিগ্রাম, ফোলেট (বি৯) ১৯ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন সি ৭ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম।

পেঁয়াজে যেসব মিনারেল থাকে: ক্যালসিয়াম ২৩ মিলিগ্রাম, লোহা শূন্য দশমিক ২১ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ১০ মিলিগ্রাম, ম্যাংগানিজ শূন্য দশমিক ১২৯ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ২৯ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১৪৬ মিলিগ্রাম ও দস্তা শূন্য দশমিক ১৭ মিলিগ্রাম।

অন্যান্য উপাদান: পানি ৮৯ দশমিক ১১ গ্রাম।

রান্নায় পেঁয়াজের স্বাদ: পেঁয়াজের মধ্যে সালফার বিদ্যমান থাকায় এটি রান্নায় একধরনের ঝাঁজালো স্বাদ যোগ করে। এ কারণে পেঁয়াজ দিয়ে রান্না খাবারের স্বাদ অনেক তীব্র হয়। পেঁয়াজ যেকোনো তরকারিকে গ্রেভি ও আকর্ষণীয় করে।

রান্নার ফলে পেঁয়াজের গুণাগুণের হেরফের: পেঁয়াজে নানা ধরনের ভিটামিন, পটাশিয়াম ও প্রাকৃতিক তেল থাকে, যা রান্নার পর নষ্ট হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়। রান্নার সময় তাপের ফলে পেঁয়াজে অবস্থিত ভোলাটাইল অ্যাসিড উড়ে যায়। সে কারণে কাঁচা অবস্থায় নাক–মুখ জ্বালা করে। উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করলে পেঁয়াজের খাদ্যগুণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে মধ্যম তাপমাত্রায় রান্না করাই ভালো।

পেঁয়াজ একটি মসলাজাতীয় উদ্ভিদ। এর মূল উপাদান পানি, কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার। ছবি: দীপু মালাকার
পেঁয়াজ একটি মসলাজাতীয় উদ্ভিদ। এর মূল উপাদান পানি, কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার। ছবি: দীপু মালাকার

পেঁয়াজ কাঁচা ও টাটকা খাওয়া উচিত: পেঁয়াজ কেটে বাসি না করে টাটকা খেয়ে নেওয়া উচিত। অনেকক্ষণ ধরে পেঁয়াজ কেটে রাখলে এর সালফারের অক্সিডেশন বিক্রিয়ার ফলে একধরনের বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এতে পেঁয়াজের গুণ নষ্ট হয়ে যায়।

পেঁয়াজ খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
• পেঁয়াজকে বায়ুনাশক বলা হয়, কিন্তু রান্না করা পেঁয়াজ বায়ুকারক হয়ে যায়।
• পেঁয়াজ খেলে মুখে দুর্গন্ধ হয় এবং অন্য লোকের সঙ্গে কথা বলতে গেলে বড় অস্বস্তি লাগে।
• রান্নায় বেশি পেঁয়াজ দিলে অনেক সময় পেটে গ্যাসের উদ্রেক হয়। বারবার ঢেকুর ওঠে।
• এতে অনেকের পেটে ব্যথা হয়, পেট ফুলে যায়।
• অনেকের পেট গরম হয়ে বারবার পাতলা পায়খানা হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে পেঁয়াজ জোলাপের কাজ করে।

পেঁয়াজের বিকল্প: পেঁয়াজ যারা খায়, তারা বেশির ভাগই এর গুণাগুণ বিচার করে খায় না। খাবারের স্বাদ ও তরকারির ঘনত্ব বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পেঁয়াজ ব্যবহার করে থাকে। এ কারণে এই উচ্চমূল্যের কারণে পেঁয়াজকে পরিত্যাগ করে বা অল্প পরিমাণে ব্যবহার করে বিকল্প কিছু চিন্তা করা যেতেই পারে। এতে রান্না করা খাদ্যের গুণগত মান বাড়বে বৈ কমবে না।

কাঁচা পেঁপে: পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে আমরা কাঁচা পেঁপে ব্যবহার করতে পারি। এমনকি অনেক দোকানেই আজকাল চপ, শিঙারা ও মোগলাইয়ের সঙ্গে সালাদ হিসেবে কাঁচা পেঁপের কুচি দেওয়া হয়।

এ ছাড়া তরকারির ঝোল ঘন করার জন্য কাঁচা পেঁপে সেদ্ধ করে সেটা পিষে মসলা কষানোর সময় দেওয়া যেতে পারে। এই পেঁপে যকৃতের স্বাস্থ্য ও পেটের সমস্যার জন্য খুবই উপকারী। এ ছাড়া যাঁরা হৃদ্‌রোগে ভুগছেন, তাঁদের জন্যও উপকারী।

টমেটোর রস: টমেটো ভাপ দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে পেস্ট করে রান্নার সময় পেঁয়াজের পরিবর্তে ব্যবহার করলে রান্না করা খাবার অতি সুস্বাদু হয়। মাছ, মাংস, এমনকি সবজিও টমেটো পেস্ট দিয়ে রান্না করলে তরকারির রং খুব সুন্দর হয়। আর উপকারিতা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। টমেটোর উপকারিতা পেঁয়াজের থেকে অনেক গুণ বেশি, এটা কমবেশি সবারই জানা।

মিষ্টিকুমড়া: মিষ্টিকুমড়া গ্রেটার দিয়ে কুচি করে একইভাবে পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে তরকারিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

পেঁয়াজ ছাড়া দুটি সুস্বাদু রান্নার রেসিপি

পালংশাক দিয়ে গ্রিন প্রন কারি
উপকরণ ও পরিমাণ
পালংশাক: ১ আঁটি,
বড় রসুন: ২-৩ কোয়া
কাঁচা মরিচ: ৫-৬টি (স্বাদমতো)
চিংড়ি মাছ: ২৫০ গ্রাম
লবণ: স্বাদমতো
সাদা তেল: ২ টেবিল চামচ
মরিচগুঁড়া: পরিমাণমতো
হলুদগুঁড়া: পরিমাণমতো
জিরাগুঁড়া: পরিমাণমতো
আদা-রসুনবাটা: পরিমাণমতো

প্রণালি
১. প্রথমে চিংড়ি মাছ ভালো করে বেছে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন।
২. মাছে সামান্য লবণ, মরিচগুঁড়া, হলুদগুঁড়া, জিরাগুঁড়া, আদা–রসুনবাটা দিয়ে মেখে আধা ঘণ্টা মেরিনেট করে রাখুন।
৩. পালংশাক ভালোভাবে বেছে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে কেটে নিন।
৪. শাক, রসুনকুচি, কাঁচা মরিচ, পরিমাণমতো লবণ দিয়ে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে নিন।
৫. সসপ্যানে তেল গরম করে শাকের মিশ্রণ ঢেলে নাড়তে থাকুন। ফুটে উঠলে মেরিনেট করা চিংড়ি ছেড়ে দিয়ে আলতো করে নাড়তে থাকুন, যাতে মাছ ভেঙে না যায়।
৬. রস শুকিয়ে তেল বের হয়ে এলে চুলা নিভিয়ে দিন।

অনেক ক্ষেত্রে পেঁয়াজ জোলাপের কাজ করে। ছবি: দীপু মালাকার
অনেক ক্ষেত্রে পেঁয়াজ জোলাপের কাজ করে। ছবি: দীপু মালাকার

এ রকম পালংশাকের পেস্ট দিয়ে একইভাবে চিংড়ির পরিবর্তে ইংলিশ (সামান্য লবণ–হলুদ মাখিয়ে), কই, সরপুঁটি ও মেনি মাছ রান্না করা যায়। এ রান্নায় পেঁয়াজ দেওয়ার প্রয়োজনই পড়ে না। এ ধরনের শাক রান্না শুধু ভাতের সঙ্গেই নয়, পোলাওয়ের সঙ্গেও অসাধারণ লাগে খেতে। আর দেখতেও অসাধারণ।

গাজর দিয়ে গোল্ডেন চিকেন

উপকরণ ও পরিমাণ
মুরগি: ১টি (পছন্দমতো টুকরা করা)
গাজর মিহি করে বাটা: ১ কাপের বেশি (২৫০ গ্রাম)
লবণ: স্বাদমতো
আদা-রসুনবাটা: ২ চা-চামচ
জিরাবাটা বা গুঁড়া: ১ চা-চামচ
হলুদগুঁড়া: আধা চা-চামচ
মরিচগুঁড়া: আধা চা-চামচ
গরমমসলা: পরিমাণমতো
সাদা তেল: ৫-৬ টেবিল চামচ (একটু বেশি লাগে)

প্রণালি
১. টুকরা করা মুরগি ভালোভাবে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন।
২. রান্নার হাঁড়িতে তেল দিয়ে গরম হলে তাতে গরমমসলা ছেড়ে দিন।
৩. মুরগি দিয়ে একে একে লবণ, হলুদগুঁড়া, মরিচগুঁড়া, জিরাগুঁড়া ও আদা-রসুনবাটা সামান্য পানি দিয়ে হালকা আঁচে কষাতে থাকুন।
৪. তেলের ওপর এলে গাজরের পেস্ট ঢেলে আলতো নেড়ে মিশিয়ে দিন।
৫. ফুটে উঠলে ঢেকে দিয়ে জ্বাল কমিয়ে দমে রাখুন।
৬. কিছুক্ষণ পর তেলে বেরিয়ে মাখা মাখা হয়ে এলে লবণ ঠিক আছে কি না দেখে চুলা নিভিয়ে দিন। চাইলে এ সময় কাঁচামরিচ দিতে পারেন স্বাদমতো।

এবার বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই, রান্নায় স্বাদ বাড়ানোর জন্য সব সময় বেশি মসলার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন বিকল্প ভাবনার। বিভিন্ন উপকরণের পাওয়া না–পাওয়ার ওপর নির্ভর করে রান্নায় পরিবর্তন আনা সম্ভব! এতে রুচির পরিবর্তন আসে। অপ্রাপ্তি বা মূল্যবৃদ্ধিজনিত সংকট খুব সহজেই মোকাবিলা করা যায়। এসব সংকট তো চিরস্থায়ী নয়।

সামনে শীতকাল আসছে। নতুন পেঁয়াজ উঠবে। তার আগে বাজারে আসবে পেঁয়াজপাতা ও কলি, যা দিয়ে মজার মজার খাবার রান্না করা যাবে। পুষ্টিগুণ, ঝাঁজালো গন্ধ ও স্বাদে পেঁয়াজের সমতুল্য এসব সবজি পেঁয়াজের কোনো অংশেই কম নয়। তা ছাড়া পর্যাপ্ত থাকলেও কোনো জিনিসই মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করা উচিত নয়। ভবিষ্যতে সংকটের কথা মনে রেখেই পেঁয়াজ সংরক্ষণে রাখুন।

লেখক: পুষ্টি ও খাদ্য পরামর্শবিদ