কেওক্রাডং কড়চা

কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় দাঁড়ালে মন জুড়িয়ে দেয় পাহাড়ের সবুজ প্রকৃতি। ছবি: সংগৃহীত
কেওক্রাডংয়ের চূড়ায় দাঁড়ালে মন জুড়িয়ে দেয় পাহাড়ের সবুজ প্রকৃতি। ছবি: সংগৃহীত

কমলা বাজার ছাড়ার পর চান্দের গাড়ি একেবারে পাহাড়ের গা বেয়ে খাড়া ওপরের দিকে উঠতে থাকল। ভেতরে শক্ত হয়ে বসি আমরা। টান টান উত্তেজনায় পাহাড়ের গা যেন আঁকড়ে ধরে এই যান, তার সবটুকু শক্তি নিংড়ে আস্তে আস্তে উঠতে থাকে। আমার তখন স্পাইডারম্যান ছবির কথা মনে পড়ে গেল! স্পাইডারম্যান যেমন আকাশচুম্বী দালান আঁকড়ে ধরে খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠতে থাকে, আমাদের চান্দের গাড়িও যেন সেই ভূমিকায়। একদম খাড়া চড়াই পেরিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করতেই বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলাম দাঁড়িয়ে আছি বগা লেকের সামনে।

অপূর্ব সুন্দর হ্রদ বগা। বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ২৮৬ ফুট উচ্চতায় এর অবস্থান। ঘিরে থাকা পাহাড়, অরণ্য, আকাশের অবারিত নীল আর মেঘের ছায়ায় হাজারো রং ও আলোর খেলা হ্রদজুড়ে। ফুরফুরে বাতাসে শান্ত জলে হালকা ঢেউ দেখছিলাম মুগ্ধ হয়ে। তার মধ্যেই স্থানীয় রবার্টদার বাড়িতে খাওয়ার ডাক পড়ল।

খাওয়াদাওয়ার ফাঁকে রবার্টদার কাছ থেকে জানা হয় বগা লেকের সৃষ্টির সঙ্গে ভয়ানক এক ড্রাগনের গল্প, যা স্থানীয় নৃগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত আছে। এমনকি হ্রদের নিচে নাকি একটি ড্রাগন এখনো বিচরণ করে বলেও কেউ কেউ বিশ্বাস করে! খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের দলের অপুর নির্দেশ, বেরিয়ে পড়তে হবে। দেরি করা
যাবে না, নচেৎ পথেই রাত নেমে
যাবে।

জুমখেতে বসার জন্য জুমঘর
জুমখেতে বসার জন্য জুমঘর

বম পাড়া ছাড়ার পর রাস্তা উঠে গেছে উঁচু পাহাড়ের চূড়ার দিকে। সেই পাহাড়ে অর্ধেকটা উঠতেই দম যেন গলার কাছে চলে এল! হাঁপিয়ে উঠে একটু বিশ্রামের পর রাস্তা ছেড়ে পাশের ট্রেইল ধরলাম। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চলে গেছে একচিলতে পথ (ট্রেইল)। একটু পরপর পথের ওপর পাথুরে শিলাখণ্ড। কোথাও পাথরের ওপর দিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাওয়ার চিহ্ন। বৃষ্টি নামলে রোদে পুড়তে থাকা শুকনা পাথরের গা হয়ে যাবে যেন একেকটা শৈলপ্রপাত। পাহাড়ের ঢাল নিচে নেমে গিয়ে আরেক পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠেছে সারি সারি জুমের কলাগাছ। সামনে পড়ল ঝিরির ওপর দিয়ে যাওয়া বাঁশের সাঁকো। ভ্রমণসঙ্গী মোশারফ ঝিরির তলদেশে একটি পাথুরে ধাপ দেখালেন। সাঁকো হওয়ার আগে ছড়ায় নেমে ধাপের পাশে বুনো লতা ধরে বেয়ে ওপরে উঠতে হতো। পাহাড়ে জুমখেত থেকে বেতের ঝুড়ি পিঠে ঝুলিয়ে পাড়ায় ফিরছে একদল বম নারী। পাহাড়িদের এই ঝুড়ির নাম কাল্লোং। ঝুড়িতে ঠাসা রাংগোয়াই জাতের পাকা আম। পার্বত্য অঞ্চলের জুমচাষে মূলত আম্রপালি ও রাংগোয়াই আমের চাষ হয়। ট্রেইলের পাশজুড়ে শণজাতীয় ঘাসের ঠাসবুনট। চোখ যায় দূরের পাহাড়শ্রেণির দিকে। মেঘ রোদ্দুর লুকোচুরি খেলছে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে।

ট্রেইল এবার উতরাইয়ে নেমে গিয়ে থেমেছে চিংড়ি ঝরনার ঝিরিতে। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে থাকা পাথরের বোল্ডারের ওপর দিয়ে হেঁটে ঝরনায় চলে যাই। পাথুরে পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরছে ঝরনার ক্ষীণ স্রোত। বৃষ্টি নামলে এমন ক্ষীণ স্রোতেই হয়ে যাবে উন্মত্ত। ঝরনার পাশে শক্তপোক্ত লিয়ানা লতা ঝুলে চলে গেছে গাছে গাছে। আমার তখন টারজানের কথা মনে পড়ে গেল! পাথরের নিচ দিয়ে তিরতির করে বয়ে গেছে টলটলে পানির প্রবাহ। আঁজলা ভরে পিপাসা মিটিয়ে ফেরার পথে বোতল ভরে নিলাম। শণের বুনট কোথাও ট্রেইলে এমনভাবে হেলে পড়েছে যে হাঁটতে গিয়ে শরীর আছড়ে দিচ্ছে লোমশ কাঁটা পাতা। সামনে পড়ে উঁচু এক পাহাড়। তার পাদদেশে ঝিরির ওপর সুন্দর এক কাঠের সাঁকো। পাহাড়ের চড়াই বেয়ে ওপরে উঠে ঘাসের ওপর বসে পড়ি। বোতলে থাকা খাবার স্যালাইন কয়েক ঢোঁক গিলে আবারও চলা। ট্রেইল এবার কিছুটা প্রশস্ত রাস্তায় রূপ নিয়েছে। সেই পথে সামনে পড়ে বেশ উঁচু খাড়া পাহাড়। চড়াই বেয়ে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি। লাঠি ঠুকে ঠুকে কোনোরকমে ওপরে উঠতেই একদম পুলকিত
হয়ে যাই। সে এক বিস্ময়কর ভালো লাগা।

পাহাড়ের বাগান থেকে আম বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন একজন
পাহাড়ের বাগান থেকে আম বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন একজন

দাঁড়িয়ে আছি অপূর্ব সুন্দর এক দৃশ্যপটের সামনে। লুংতং পাড়ার কাছে তংমেং পাহাড়ের আকাশে তখন কালো মেঘ ঘোঁট পাকাচ্ছে। উপত্যকাজুড়ে মেঘ আর রোদের লুকোচুরি। নিচের পাহাড় সারির ওপর কোথাওবা কালো কালো ছোপ। এগুলো মূলত মেঘের ছায়া। পাহাড়ের গায়ে জুমঘর, জুমের ধানে বাতাসের নাচন। টংঘরে পাহাড়ি লেবুর শরবতে চনমনে হয়ে পা চালাতেই সামনে আরেক খাড়া চড়াই। ওপরে উঠে এক পাশে আনারসের জুম, আরেক পাশে ভুট্টাখেতের জুমঘর পেরিয়ে দূরের কালচে পাহাড়শ্রেণির আকাশ যেন নিখাদ নীল। তারপর দার্জিলিংপাড়া। পাড়ার মাঝ দিয়ে হেঁটে আসার সময় চোখে পড়ে বম সম্প্রদায়ের দোতলা কাঠের মাচাঘর। পা চালিয়ে পাড়ার শেষ প্রান্তে আসার পরই শুরু হয়েছে কেওক্রাডং পর্বতের উঁচু চড়াই। খাড়া ঢাল বেয়ে উঠতে উঠতে লাঠির ওপর ভর দিয়ে মাঝেমধ্যে জিরিয়ে নিতে হলো। খেয়াল হলো দৃষ্টিসীমার ভেতর সামনে–পিছে কেউ নেই। বনবনানীও হালকা হয়ে এসেছে। দুই পাশে শণ ঝোপের দঙ্গল পেরিয়ে নিচের দিকে দূর হতে দূরে দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়শ্রেণি। সে এক অদ্ভুত রকম মৌন! হঠাৎ করে মাত্র কয়েক ফুট সামনে থেকে নীল ডানা ছড়িয়ে বয়সী বৃক্ষের ডালে উড়ে গিয়ে বসল একটি পাখি। কয়েক সেকেন্ড পরখ করে মনে হলো, সুন্দর বিহঙ্গটি পাহাড়ি নীলকণ্ঠ। ডাল থেকে চোখ ফেরাতে না–ফেরাতে ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনে হার্ড ব্রেক কষার মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম। পথ আগলে উড়ছে বড়সড় এক ভ্রমর। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে মতিগতি দেখতে থাকি। কয়েক মুহূর্ত পর সরে যেতেই সটকে পড়ি দ্রুত। আর তখনই সামনে পড়ল কেওক্রাডং পর্বতের চূড়া। ৩ হাজার ২৩৫ ফুট উচ্চতার পর্বতচূড়া যেন ডাকছে মায়াবী আহ্বানে। কেওক্রাডং শৃঙ্গে উঠে সামিট ফলকের পাশে দাঁড়ালাম যখন, পশ্চিম আকাশে সারি সারি পাহাড়ের ওপর গোধূলির লালিমা ছড়িয়ে সূর্যিমামা বিদায়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।

যেভাবে যাবেন

কেওক্রাডং যেতে বান্দরবানে এসে প্রথমে বাসে করে রুমা বাজার। সেখানে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে অবহিত করে চান্দের গাড়িতে বগা লেক পর্যন্ত যাওয়া যাবে। বগা লেক থেকে কয়েক ঘণ্টার ট্রেকিং ট্রেইল ধরে কেওক্রাডং পর্বত। এ ছাড়া চাইলে বান্দরবান শহর থেকে রিজার্ভে চান্দের গাড়ি নেওয়া যাবে। 