শীতে আসে পরিযায়ী মানুষেরা

শীতকালে প্রবাসী প্রিয়জনেরা ফিরে আসেন শিকড়ের টানে। তাঁদের কেন্দ্র করে এক বা দুই দিনের জন্য হতে পারে পারিবারিক মিলনমেলা। মডেল: সেজিল, পূজা, উল্কা হোসেন, কারার, আয়াজ, কাজী রওনক হোসেন ও হামিম। ছবি: সুমন ইউসুফ
শীতকালে প্রবাসী প্রিয়জনেরা ফিরে আসেন শিকড়ের টানে। তাঁদের কেন্দ্র করে এক বা দুই দিনের জন্য হতে পারে পারিবারিক মিলনমেলা। মডেল: সেজিল, পূজা, উল্কা হোসেন, কারার, আয়াজ, কাজী রওনক হোসেন ও হামিম। ছবি: সুমন ইউসুফ
আমাদের দেশ থেকে কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপে যত বেশি মানুষ থিতু হচ্ছেন, শীতকালে তাঁদের দেশে ফেরার সংখ্যাও তত বাড়ছে। পরিবার-পরিজন, পুরোনো বন্ধুবান্ধব, পাড়াতো ভাইবোনদের জন্য বছর ধরে জমিয়ে রাখা আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা—সব যেন উজাড় করে দিতেই দেশে ফেরা। তাই তো নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন সবাইকে নিয়ে এক বা দুই দিনের জন্য কোথাও যাওয়া হয়, কাটানো হয় আনন্দময় কিছু মুহূর্ত। লিখেছেন সৈয়দ গাউসুল আলম

সেদিন হঠাৎ স্কুলের বন্ধু শমিতের ফোন। চট্টগ্রাম পাবলিক স্কুলের আমাদের সময়কার, আমাদের সবার ভীষণ শ্রদ্ধার প্রিন্সিপাল মোর্শেদ স্যার ছুটিতে দেশে এসেছেন এবং আমাদের সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি কোনো তারিখই মেলানো গেল না, কারণ, তাঁর দুই দিন পরই উনি বরিশাল চলে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে ১০ দিনের জন্য। ফিরে এলে তারপর দেখা হবে।

ভেবেছি, দেখা হলে স্যারকে জিজ্ঞাসা করব,‘স্যার, বুকের কোন জায়গাটায় আন্ধারমানিক নদ লুকিয়ে রাখেন বছরের পর বছর, আর কখন লুকাতে না পেরে ছুটে আসেন নদের বুকে ঝাঁপ দিতে পরিযায়ী মানুষ হয়ে?’

আসলে আমার সব সময়ই মনে হয়েছে, প্রত্যেক মানুষের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নেয় একটা করে পাখি, মানুষ তা জানতেও পারে না। যখনই মানুষের মন উদাস কিংবা উড়ু উড়ু হয়, তখন তার অজান্তেই সেই পাখির সঙ্গে যোগাযোগ হয় আর পাখি উড়াল দেয় অজানার উদ্দেশ্যে—ঘুরে বেড়ায় দেশ থেকে দেশান্তরে। তাই কখনো কখনো নতুন কোনো জায়গায় গেলে আপনার প্রায়ই যখন মনে হয়, ‘আমি সম্ভবত এখানে আগে এসেছি’ (দেজা ভু), বুঝে নেবেন আপনার পাখি এখানে ঘুরে গেছে কোনো এক উদাস দুপুরে। আবার কখনো কখনো থিতু মানুষ তার সেই যাযাবর পাখির অজানা টানে শিকড় ছেড়ে নিজেই পরিযায়ী হয়ে যায়। কিন্তু পরিযায়ী মানুষ ঠিকই সেই শিকড়ের টানে, ঘরের ওমের টানে কোনো এক কুয়াশা-ঢাকা ভোরে ফিরে আসে তার আন্ধারমানিক নদের কাছে, পৃথিবীর সব মোহ তখন তুচ্ছ মনে হয়।

কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপে যত বেশি মানুষ থিতু হচ্ছে, শীতকালে তাদের দেশে ফেরার সংখ্যাও তত বাড়ছে। পরিবার-পরিজন, পুরোনো বন্ধুবান্ধব, পাড়াতো ভাইবোনদের জন্য বছর ধরে জমিয়ে রাখা যত আবেগ,অনুভূতি, ভালোবাসা—সব যেন উজাড় করে দিতেই দেশে ফেরা। কলেজজীবনের সেই মামার দোকানের মালাই চা, বন্ধুদের সঙ্গে রাতভর আড্ডা, মায়ের হাতের গরম-গরম গুড়ের ক্ষীর, গ্রামের সেই পটে আঁকা নদী—কোনো কিছুই যেন এক দিনের জন্যও পুরোনো হয়নি। যেখানে রেখে গিয়েছিল, ফিরে এসে যেন সেখান থেকেই শুরু হলো আবার। সবকিছুই যেন অনেক আপন, ভীষণ নিজের। আজ আর কোনো তাড়াহুড়া নেই, সব কেমন স্থির, শান্ত, পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। নদীর পাড়ের বড় কাঞ্চনগাছটার নিচে একটা পাটি বিছিয়ে শুয়ে থেকে যেন বাকি জীবনটা কেটে যাবে।

ফোনের আওয়াজে সংবিৎ ফেরে। ওই দেশ থেকে বিদেশি বউয়ের উৎকণ্ঠিত গলার স্বর। এদিক থেকে শান্ত উত্তর, ‘আই উইল কাম ব্যাক সুন হানি।’ ফোন রেখেই মনে হয়, ‘আচ্ছা কোথায় ফিরে যাব বললাম? ফিরেই তো এলাম।’

দিন কাটানো তো বটেই, সবাই মিলে খাওয়াদাওয়াও
দিন কাটানো তো বটেই, সবাই মিলে খাওয়াদাওয়াও

ফিরে আসা পরিযায়ী মানুষেরা এই হিসাব করা দিনগুলোর প্রতিটাকে সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতে চায়। যেন একটা মুহূর্তও নষ্ট না হয়। তাই ফেরার আগের থেকেই প্রস্তুতি শুরু। রাত-দিন এক করে এঁকে–ওকে–তাকে হাজারটা ফোন। বিভিন্ন দেশে থাকা পরিযায়ী মানুষদের এক করার কাজ শুরু হয়ে যায়। আর এদিকে দেশে যারা অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অপেক্ষমাণ, তাদেরও যেন বাড়িতে উৎসব লেগে যায়। নানা রকমের আয়োজন শুরু হয়ে যায়—কোথায় কোথায় দল বেঁধে যাওয়া হবে, কী কী খাওয়া হবে, কে কী রাঁধবে, আর এর মধ্যে যদি বাড়িতে একটা বিয়ে লাগিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তো কথাই নেই। এখানেই শেষ নয়, ফেরার পর শুরু হয় তাদের অদ্ভুত সব আবদার। এমন সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তারা দেখা করতে চায়, যাদের কথা দেশে থাকা আত্মীয়রাই ভুলে গেছে এমন সব জায়গায় তারা যেতে চায়, যেসব জায়গায় পৌঁছানোর পথ দেশে থাকা মানুষেরা ভুলে গেছে। এমন সব গলিতে এমন সব খাবার তারা খেতে চায়, যেখানে দেশে থাকা মানুষেরা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে—তাই পরিযায়ী মানুষেরা শুধু নিজেরাই ফিরে আসে না, আমাদেরও ফেরত নিয়ে যায় অবহেলায় পড়ে থাকা ধুলোমাখা অতীতের কাছে।

অনেকেই বলেন, এত অতীতচারিতারই-বা কী আছে। কিন্তু আমার মনে হয়, অতীতের প্রতি ভালোবাসা আমাদের বর্তমানের প্রতি আরও বেশি মানবিক করে তোলে। পরিযায়ী মানুষগুলো ফিরে এলে সেই অতীতচারিতাই সবচেয়ে বেশি হয়। সবাই মিলে যেন ফেরত চলে যাই সেই কুড়ি বছর আগের জীবনে, আর কী সব স্মৃতি যে ফেরত আসে, ভাবা যায় না। পুরোনো প্রেমিক, এক লহমার জন্য দেখা বনলতা সেনের চোখ, প্রথম স্কুল পালানো, বাবার হাতে খাওয়া মার, মাকে দলে নিয়ে রাত করে বাড়ি ফেরা, দুই বন্ধু মিলে একই মেয়ের প্রেমে পড়া, প্রথম পাখি পোষা, প্রথম পাখি খাঁচা থেকে ছেড়ে দেওয়া—এমন আরও হাজারো স্মৃতির যেন মেলা বসে বাড়িজুড়ে। অতীত তার সব টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদ নিয়ে হাজির হয় আর আমাদের আপাতবর্তমানকে দখল করে নেয়, আর কারও যেন সেই ঘোর থেকে বেরোনোর তাড়া নেই। আহা জীবন। এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না।

কিন্তু দিন এমনি করে তো যায় না। আবারও একসময় পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। সন্ধ্যাগুলো বিষাদময় লাগতে শুরু হয়। মনের কোণে বিদূর বাঁশি বাজতে শুরু করে। প্রতিটি দিন থেকে আরও বেশি করে নিংড়ে নিতে ইচ্ছা করে। সময়ের মতো নিষ্ঠুর আর কাউকে মনে হয় না। কিন্তু তাতে কী? এই কদিনে পরিযায়ী মানুষ জমিয়ে নেয় আরও কয়েক বছরের খোরাক। মনের আলমারিতে পাট পাট করে সাজিয়ে নেয় নানান পদের নতুন স্মৃতির বয়াম, টক-ঝাল-মিষ্টি। বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা আন্ধারমানিক নদের নবায়ন হয় আরও দুই বছরের জন্য। মনে থাকে ছুটির এক বা দুই দিনে সবাই মিলে গিয়েছিলাম কোথাও—কেটেছিল দারুণ দিন-রাত। ব্যাগভর্তি উপহার আর বুকভর্তি স্মৃতি নিয়ে পাখি উড়াল দেয় আবারও, ফেরার অপেক্ষায়।

লেখক: গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং, ঢাকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক