সব দোষ তোমাদের

কম বয়সী সন্তান নিজের যেকোনো ব্যর্থতায় মা– বাবা ও পরিবারের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। ছবি: সুমন ইউসুফ
কম বয়সী সন্তান নিজের যেকোনো ব্যর্থতায় মা– বাবা ও পরিবারের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। ছবি: সুমন ইউসুফ
‘কেন সময়মতো আমাকে টিউটর দাওনি? এ জন্যই তো পরীক্ষার ফল খারাপ হলো।’ ‘তোমরা আমাকে কারও সঙ্গে মিশতে দাও না, তাই আমার কোনো বন্ধু হয় না।’ যেকোনো অপ্রাপ্তি বা ব্যর্থতার জন্য সন্তান তার মা–বাবা, পরিবারের দিকে আঙুল তোলে। কম বয়সী সন্তানের কাছে তাঁরা যেন ‘ভিলেন’। আসলেই কি সবকিছুর জন্য মা–বাবা দোষী? কেন এমন হয়, এমন হলে মা–বাবা কিংবা সন্তানের করণীয় কী? লিখেছেন মনোরোগ চিকিৎসক আহমেদ হেলাল

 ‘সবকিছু তোমাদের জন্য হয়েছে, কেন সময়মতো আমাকে টিউটর দাওনি,’ পরীক্ষায় খারাপ করেই ১৪ বছরের শিপলু (ছদ্মনাম) দায়ী করে মা-বাবাকে। আবার ১৭ বছর বয়সী শায়লার (ছদ্মনাম) সমস্যাটা ভিন্ন। সে সব সময় মা-বাবাকে বলে, ‘তোমাদের জন্য আমার কোনো বন্ধু হয় না, তোমরা আমাকে কারও সঙ্গে মিশতে দাও না।’

এমনি করে সন্তানেরা তাদের যেকোনো সমস্যা, ব্যর্থতা আর অপ্রাপ্তির জন্য কখনো কখনো মা-বাবাকে দায়ী করতে থাকে। পড়ালেখায় খারাপ করা থেকে শুরু করে প্রেমে ব্যর্থ হওয়া পর্যন্ত অনেক কিছুর জন্য যেন কেবল মা-বাবাই দায়ী। একটা সময়ে সন্তানের জীবনে মা-বাবা যেন ‘ভিলেন’ হয়ে ওঠেন।

সাইকোলজি টুডে সাময়িকীর আগস্ট ২০১৮ সংখ্যায় শিশু বিকাশ বিশেষজ্ঞ ডোনা ম্যাথিউ ‘ব্লেমিং গেম’ বা শিশুদের অন্যকে দায়ী করার ব্যাখা দিতে গিয়ে বলেন, শিশুরা সাধারণত তিনটি কারণে এমনটা করে থাকে—প্রথমত, কোনো অন্যায় বা অপরাধের ঘটনায় নিজের দায়িত্ব এড়াতে, দ্বিতীয়ত, নিজেকে ভালো আর যোগ্য প্রমাণ করতে আর তৃতীয়ত, কারও ওপর প্রতিশোধ নিতে।

এ রকম পরিস্থিতিতে মা-বাবা নিজেরাও আত্মপক্ষ সমর্থন করতে থাকেন। সন্তানের সঙ্গে পাল্টা যুক্তি দিতে থাকেন, এতে সন্তানের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কটা নড়বড়ে হয়ে যায়। তাতে সন্তানের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, যার প্রভাব পড়ে তাদের পরিণত বয়সে। সন্তান লালনপালন বা প্যারেন্টিং–বিষয়ক মার্কিন বিশেষজ্ঞ স্কট তুরানস্কি ও জন মিলার তাঁদের ‘দ্য কডিস হু প্লে দ্য ব্লেমগেম লস’ নিবন্ধে উল্লেখ করেন, যে শিশুরা বেশি বেশি ব্লেম গেম করে, অর্থাৎ নিজের ব্যর্থতা বা অপরাধের জন্য অপরকে (শিক্ষক অথবা মা–বাবা) দায়ী করে, তাদের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয় এবং তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

সন্তানের অভিযোগে তাৎক্ষণিক রেগে না গিয়ে পরে তাকে বুঝিয়ে বলুন। মডেল: জাকির, তানভীরা ও ঋভু, ছবি: সুমন ইউসুফ
সন্তানের অভিযোগে তাৎক্ষণিক রেগে না গিয়ে পরে তাকে বুঝিয়ে বলুন। মডেল: জাকির, তানভীরা ও ঋভু, ছবি: সুমন ইউসুফ

এ কথা সত্য যে সন্তানের জীবনে মা-বাবার আচরণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সন্তানের সব ধরনের সাফল্য-ব্যর্থতার পেছনে মা-বাবার মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু অনেক সময় সন্তানেরা নিজের ব্যর্থতা আর হতাশার জন্য মা-বাবাকে দায়ী করে, যা আদৌ সঠিক নয়। বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হয় ‘ডিফেন্সেকানিজম’। এভাবে নিজের অক্ষমতা আর ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য অন্যদের (মা-বাবা) দায়ী করে নিজের অহং বা ইগোকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সন্তান যখন প্রতিনিয়ত মা-বাবাকে দায়ী করতে থাকে, তখন পারিবারিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দায়িত্ব রয়েছে সবারই। একদিকে মা-বাবাকে কৌশলগতভাবে বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে, অপর দিকে সন্তানকেও অর্জন করতে হবে সামাজিক দক্ষতা, বাড়াতে হবে আত্মবিশ্বাস।

কেন সন্তান মা-বাবাকে দায়ী করে

সন্তান যখন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়, নিজের চিন্তা আর সিদ্ধান্তগুলো স্বাধীনভাবে নিতে পারে না, হতাশ হয়, তখন সে কোনো ব্যর্থতার জন্য অপরকে দায়ী করতে চায়। এ ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে সহজ টার্গেট হচ্ছেন মা-বাবা। তখন সে মা-বাবাকে দায়ী করে নিজের হতাশা কমানোর চেষ্টা করে।

মা-বাবা যখন সন্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করা শুরু করেন, সন্তানকে ভয় পেতে থাকেন, সন্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন, তখন সন্তান সবকিছুর জন্য মা-বাবাকে দায়ী করতে থাকে।

সন্তান যদি পরিবারে দেখতে শিখে যে তার মা-বাবা সবকিছুতে সন্তানের দাদা-দাদি, নানা-নানি, শিক্ষক, প্রতিবেশী, সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দায়ী করেন, তখন সন্তানের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি হয় না। যেমন মা-বাবা যদি সন্তানের সামনে প্রতিনিয়ত বলতে থাকেন, ‘দেশের সবকিছু ত্রুটিপূর্ণ, সবাই খারাপ, সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে, এ দেশের কিছু হবে না’, তখন সন্তান এই ‘ব্লেমিং গেম’ শিখতে থাকে। সে ভাবে, ‘তাই তো, আমার তো কিছু করার নেই, সিস্টেমই খারাপ, সিস্টেমই দায়ী।’ তখন সে নিজেও অন্য অনেক কিছুর মতো মা-বাবাকেও সবকিছুর জন্য দায়ী করতে থাকে।

সন্তানকে যদি ছোটবেলা থেকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া না হয়, তখন পরবর্তী সময়ে সে নিজের দায়িত্বকে অস্বীকার আর অবহেলা করতে শেখে। সে ভাবে, আমার কোনো দায়িত্ব নেই—সবকিছু মা-বাবা করে দেবেন। এভাবে যখন সে বড় হতে থাকে, তখনো আশা করে, মা-বাবাই সবকিছু তাকে করে দেবেন। কিন্তু যখন সেটা হয় না, তখন সে দায়ী করে মা-বাবাকেই। একটা ছোট উদাহরণ হচ্ছে, সন্তান স্কুলের পড়া ঠিকমতো লিখে নিয়ে আসতে পারছে না, মা উদ্বিগ্ন হয়ে প্রতিদিন সন্তানের বন্ধুর মা, বন্ধুর বাবা, শ্রেণিশিক্ষককে ফোন করে করে পড়া সংগ্রহ করছেন। এ কারণে সন্তানের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়, নিজের পড়া নিজে সংগ্রহ করে না, যা তার সামাজিক দক্ষতা তৈরির অন্তরায় হয়ে যায়। একসময় সে মা-বাবার এই অযাচিত সাহায্য না পেলেই তাদের দায়ী করতে শুরু করে।

পাশ্চাত্যের শিশু–কিশোরেরা তাদের সংস্কৃতি অনুযায়ী নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, অধিকার, অবাধ্য আচরণ আর নেশাবিষয়ক ইস্যুতে মা–বাবা বা শিক্ষককে দায়ী করে আর ভারতীয় উপমহাদেশ অর্থাৎ এই অঞ্চলের শিশুরা পড়ালেখায় খারাপ করা, নিজের অন্যায় আচরণ অথবা কোনো অপরাধ লুকাতে মা–বাবা ও শিক্ষকদের দায়ী করে থাকে।

সন্তান যদি ছোটবেলা থেকে সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাকে মেনে নিতে পারার দক্ষতা অর্জন না করে, তখন যেকোনো ব্যর্থতার জন্য আশপাশকে, বিশেষ করে মা-বাবাকেই দায়ী করতে থাকে।

কখনো কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার বা অপজিশনাল ডেফিয়েন্ট ডিজঅর্ডার ধরনের মানসিক সমস্যার জন্য সন্তান মা-বাবার প্রতি আগ্রাসী হয়ে ওঠে এবং মা-বাবাকে সবকিছুর জন্য দায়ী করতে থাকে।

কী করা উচিত

দায়িত্ব রয়েছে মা-বাবা আর সন্তান—দুই পক্ষেরই। ডোনা ম্যাথিউ বলেন, মা–বাবাকে ধৈর্য ধরতে হবে, সন্তানকে ভালোবাসতে হবে এবং সন্তানের এই আচরণের ব্যাখা গ্রহণ করতে হবে, অর্থাৎ সন্তান কেন এমনটা করছে—তা বুঝতে হবে। সন্তানের মধ্যে যাতে এই দায়ী করার প্রবণতা গড়ে না ওঠে, এ জন্য মা-বাবা যা করবেন, তা হচ্ছে—

ছোটবেলা থেকেই সন্তানকে বয়সোপযোগী কিছু দায়িত্ব দিন। সে যখন দায়িত্ব পালন করতে শিখবে, তখন দায়িত্বের সফলতা বা ব্যর্থতাকে সে নিজের করে নেবে। অপরকে দায়ী করবে না।

সন্তানকে ব্যর্থতার মুখোমুখি হতে শেখান। ব্যর্থতার জন্য তার সমালোচনা করবেন না, বরং সফলতার জন্য কী করা উচিত, তা বুঝিয়ে বলুন। সন্তান কোনো কাজে ব্যর্থ হলেও রাগ করবেন না, নেগেটিভ সমালোচনা করবেন না। জীবনে সফলতার মতো ব্যর্থতাও রয়েছে, তা বুঝিয়ে বলুন।

সন্তানের সামনে রাষ্ট্র, সমাজ, সিস্টেম, পরিবারের অন্য সদস্য বা সন্তানের শিক্ষকের সমালোচনা করবেন না। নিজের পরিবর্তনের দিকে গুরুত্ব দিন। যেমন রাস্তায় যানজট বা দুর্ঘটনার জন্য সব সময় রাষ্ট্র বা সিস্টেমের সমালোচনা না করে আপনি নিজে বা আপনার সন্তানকে রাস্তায় চলার সঠিক নিয়ম পালনে উত্সাহিত করুন।

সন্তানের সঙ্গে তর্ক করবেন না। সন্তান যখন উত্তেজিত হয়ে তর্ক করতে থাকবে, তখন চুপ থাকুন, পরবর্তী সময়ে সন্তান যখন শান্ত থাকবে, তখন তাকে বুঝিয়ে বলুন।

সন্তানকে ধন্যবাদ দিতে আর প্রশংসা করতে শেখান। আপনি নিজে সন্তানের সামনে অপরের কাজকে মূল্যায়ন করুন। আপনাকে দেখে সন্তান শিখবে কী করে আরেকজনের প্রশংসা করতে হয়।

সন্তানকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করবেন না, তাকে টিটকারি দেবেন না। সন্তানের আচরণের জন্য তার সমালোচনা করবেন না, লজ্জা দেবেন না।

দায়িত্ব আছে সন্তানদেরও। নিজের আত্মবিশ্বাস যত বেশি থাকবে, তত কিন্তু অপরকে দায়ী করার প্রবণতা কমবে। তাই আত্মবিশ্বাস বাড়ে, এমন ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকতে হবে। নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে পারার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে মা-বাবা সব সময়ই সন্তানের মঙ্গল চান। তাই তাদের দায়ী করে নয়, বরং নিজে দায়িত্ববান হয়েই সফলতার জন্য দৌড়াতে হবে।

আহমেদ হেলাল, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।