আলসেমিও ভালো জীবনে দেয় আলো

মাঝে মধ্যে কিছু না ভেবে শুধুই বসে থাকা কর্মদক্ষতা বাড়ায়। মডেল: মৌসুমী
মাঝে মধ্যে কিছু না ভেবে শুধুই বসে থাকা কর্মদক্ষতা বাড়ায়। মডেল: মৌসুমী

‘ব্যস্ততা আমাকে দেয় না অবসর...।’

সোলসের এই গান এখন আমাদের আত্মার আকুতি। কাজ, কাজ, কাজ আর কাজ। কাজ ছাড়া আমাদের কোনো সময় কি কাটে? একবার ভেবে দেখুন তো, দিনের কোন সময়টায় কিছুই না করে অলস সময় কাটান? 

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটি বিষয় বলে দিই। একটু ফাঁক পেলেই যখন স্মার্টফোনে ফেসবুক খুলে বসেন, তখন কিন্তু ঠিক অবসর কাটানো হয় না। কারণ, অন্যের জীবনে উঁকি দেওয়ার বা নিজের জীবনের ছবি অন্যের সামনে তুলে ধরার একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই ফেসবুকিং করা হয়। তাতে লাইক দেওয়ার তাড়া থাকে, কমেন্টের উত্তর দেওয়ার আগ্রহও থাকে। সুতরাং একে আদতে অলস সময় কাটানো আর বলা যায় না। 

এই অব্যাহত ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পাওয়া তাই বেশ কঠিন। চাইলেও ভাঙা অসম্ভব হয়ে পড়ে ব্যস্ততার নিগড়। সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা আমাদের দেয় দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ। অশান্ত মন প্রভাব ফেলে শরীরেও। এভাবেই ব্যস্ততা মাঝেমধ্যে আমাদের শয্যাশায়ী করে ফেলে। 

এহেন ব্যস্ততা থেকে স্বস্তি আদায় করতে এবার এসে গেছে জীবনাচরণের নতুন দর্শন। এর নাম ‘নিকসন’। এটি একটি ডাচ শব্দ। তবে এখন আর শুধু ডাচ সীমান্তে আটকে নেই নিকসন, ছড়িয়ে পড়ছে পুরো বিশ্বেই। 

কী বলে নিকসন

নিকসন বলে, কিছুই না করে অলসভাবে সময় কাটানোর কথা। কোনো কিছুই না করার বিষয়টি একটু জটিল। কারণ, আমরা সব সময়ই কিছু না কিছু করতে থাকি, এমনকি ঘুমানোর সময়ও। মনস্তাত্ত্বিকেরা বলছেন, নিকসন হলো এমন একটি গাড়ি, যার ইঞ্জিন চালু আছে, কিন্তু গাড়িটি কোথাও যাচ্ছে না। 

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ল্যাংকাশায়ারের মনোবিদ স্যান্ডি মান। তাঁর মতে, প্রতিটি নির্দিষ্ট সময়েই আমাদের করার মতো কিছু কাজ থাকে। ওই সময়টায় কাজ না করাটাই নিকসন। কারণ, অনেক সময়ই আমরা কিছু কাজ না চাইলেও করতে বাধ্য হই। আগ্রহ না থাকায় হয়তো কোনো রকমে কাজটি সমাধা হয়। এর বদলে কাজ না করাটাই নিকসন। 

অর্থাৎ নিকসনের মূল ধারণা হলো চুপচাপ বসে থাকা বা জানালার ধারে বসে আপাত–অর্থহীনভাবে বাইরে তাকিয়ে থাকার জন্য জেনেবুঝে সময় বের করা। ওই সময়টায় কোনো কাজ নিয়ে ভাবা চলবে না। শুধুই অলসভাবে বয়ে যেতে দিতে হবে সময়কে। প্রচলিত শব্দে এ ধরনের কাজকে বলা হবে ‘আলসেমি’ বা ‘সময় নষ্ট করা’। হয়তো কেউ কেউ আহাম্মকিও বলে বসতে পারেন। 

বিরতি বাড়ায় কর্মক্ষমতা

মানুষের বর্তমান কর্মব্যস্ত জীবন নিয়ে গবেষণা হচ্ছে ঢের। এসবে বলা হচ্ছে, তুমুল ব্যস্ততার কারণে মানুষ নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছে। সেসব থেকে পরিত্রাণ পেতে নানা তরিকা দেওয়া হচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিয়মিত বিরতি নেওয়া। বলা হচ্ছে, এসব পরিকল্পিত বিরতি মানুষের কর্মনৈপুণ্য ও উৎপাদনশীলতা বাড়ায়। ঠিক এই ধারণাই নিকসন অন্য রূপে এনেছে। পার্থক্য হলো এই বিরতিতে কোনো কাজই করা যাবে না, শুধুই আলসেমি থাকবে আপনার টু-ডু লিস্টে। 

গবেষণায় দেখা গেছে, এভাবে অলস সময় কাটানোর প্রধান বাধা হলো প্রযুক্তি। বিজ্ঞানের কিছু অভাবনীয় উদ্ভাবন (যেমন: ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, ফেসবুক ইত্যাদি) মানুষের পুরো মস্তিষ্ককে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। কিন্তু সময় করে আলসেমিতে অভ্যস্ত হতে পারলে তার উপকারিতা অনেক। গবেষণায় পাওয়া ফলাফল জানিয়ে স্যান্ডি মান বলেন, অলস সময় কাটানোর একটি অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া আছে। তা হলো দিবাস্বপ্নের জগতে হারিয়ে যাওয়া। 

দিবাস্বপ্ন যখন ইতিবাচক

যদিও হালের সমাজব্যবস্থা দিবাস্বপ্ন দেখাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে থাকে, কিন্তু বিষয়টি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ইতিবাচক। স্যান্ডি বলছেন, দিবাস্বপ্ন মানুষকে আরও সৃজনশীল করে তোলে। এর ফলে একজন ব্যক্তি সমস্যার সমাধান দ্রুত করতে পারে। মাথায় আসে নতুন নতুন ধারণা। আর এসবের জন্যই ‘চূড়ান্ত অলস সময়’ কাটানোর প্রয়োজন হয়। 

এই চূড়ান্ত অলস সময় কাটানোর সুযোগই দেয় নিকসন। নেদারল্যান্ডসের ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি রটারডামের অধ্যাপক ও সমাজতাত্ত্বিক রুট ভেনহোভেন বলছেন, নিকসন মানুষের মনকে আকাশে ভেসে বেড়ানোর সুযোগ দেয়। সুখ নিয়ে গবেষণা করা রুট বলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির কিছু অবসর সময় কাটানো উচিত এবং এর ধরন একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। ইউরোপ ও আমেরিকায় অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে মানুষের দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে। তাই নিকসন এসব অঞ্চলে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আগে খোদ নেদারল্যান্ডসে নিকসন নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব থাকলেও, এখন মানুষ এতে আকৃষ্ট হচ্ছে। কারণ, এর মাধ্যমে দূরে রাখা যাচ্ছে দুঃসহ মানসিক চাপ। আর চারপাশে মানসিক চাপ যত বেশি থাকবে, নিকসন তত বেশি কার্যকর হবে। 

নিকসনের সুবিধা–অসুবিধা

ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গ্রেটার গুড সায়েন্স সেন্টারের পরিচালক ইভ একম্যান বলছেন, নিকসনের সুবিধা অনেক। মানুষের শারীরিক সুস্থতা ধরে রাখতে এটি উপকারী। দুশ্চিন্তার পারদ নিচে নামিয়ে আনে। সৃজনশীলতাকে পাখা মেলতে নিকসন দারুণ সাহায্য করে। নিকসনে পাওয়া দিবাস্বপ্ন থেকে আসে নতুন নতুন মৌলিক ধারণা। এমনকি খুব জটিল কোনো সমস্যার ত্বরিত সমাধানেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখে নিকসন। জোগায় অনুপ্রেরণা।

তবে হ্যাঁ, নিকসনে অভ্যস্ত হওয়াটা কর্মব্যস্ত সমাজ ভালোভাবে না–ও নিতে পারে। হয়তো কেউ জিজ্ঞেস করে বসল, ‘কী করছেন?’ এর জবাবে ‘কিছুই না’ বলাটা খানিকটা অস্বস্তিকর। তবে নিকসনের শিক্ষা হলো, এমন আলসেমির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। একে স্রেফ অলসতা হিসেবে না দেখে, জীবনযাপনের কৌশল হিসেবে বিচার করতে হবে। তবেই মিলবে ব্যস্ততা থেকে অবসর। 

তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, টাইম ও ইনসাইডার ডট কম