দেশের লাগিয়া

>হয়তো কাজে, পড়াশোনার জন্য কিংবা অভিবাসন নিয়ে থিতু হয়েছেন ভিন্ন দেশে। পরিচয় প্রবাসী। কিন্তু সব সময়ই মন কাঁদে স্বদেশ বাংলাদেশের জন্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রবাসীদের দেশের জন্য আকুতি চোখে পড়ে। অধুনার আহ্বানে দেশের জন্য মনের কথা লিখে পাঠিয়েছেন প্রবাসী অনেক পাঠক। সেখান থেকে নির্বাচিত কয়েকটি লেখা নিয়ে এই আয়োজন।
আনিকা তাসনীম
আনিকা তাসনীম

দেশের জন্য ভালোবাসা 
আনিকা তাসনীম, ডেকালব, ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র। 

চোখেমুখে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছাড়ার সময়ে দেশের জন্য খারাপ তো নয়ই, বরং ভালো লাগছিল। আনন্দ পেয়েছিলাম এই দূষণ, যানজট, দুঃসহ গরমের নগরীতে আর ভুগতে হবে না ভেবে। বাবা-মা অবশ্য বলছিল, ওখানে রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সবকিছুই একা একা করতে হবে। কিন্তু কয়েক বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুফিয়া কামাল হলে পরিবার ছেড়ে রুমমেট আর বান্ধবীদের সঙ্গে থাকার সুখস্মৃতির আলোকে তাঁদের অভয় দিলাম। উঠে পড়লাম জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে।

বিদেশযাত্রায় প্রথম বাদ সাধল প্লেনের তীব্র এসি। শীতে কাঁপতে কাঁপতে সেই প্রথম ঢাকার গরমকে মিস করা শুরু করলাম। ‘নিজের কাজ নিজে করা’ তত্ত্বের প্রথম ব্যবহারিক প্রয়োগ ছিল নিজের ওজনের সমান লাগেজ কনভেয়র বেল্ট থেকে নামানো! 

আমি যেখানে থাকি, তাকে একটা ছোটখাটো মফস্বল বলা যায়। ঢাকার তুলনায় লোকজন অনেক কম। পেছনের উঠানে হরিণের আনাগোনা। প্রায় ছয় মাসই তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের কাছাকাছি বা তারও নিচে। মাঝে মাঝে তাপমাত্রাকেও বকা দিয়ে বলতে ইচ্ছা করে, ‘তুই আর কত নিচে নামবি’? সুর্যের দেখা মেলে না সহজে, সারাক্ষণ মেঘলা বিমর্ষ হয়ে থাকে আকাশ। তখন ঢাকার রাজপথের সেই কাঠফাটা রোদের কথা খুব মনে পড়ে। আর মাঝে মাঝে বরফের কুচিসমেত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামে, তাতে না যায় শরীর ভেজানো, না যায় মন ভেজানো। অথচ দেশের বৃষ্টির কী মাতাল করা স্পর্শ ছিল! এখন বুঝি এক দেশের কবি কেন বলেছেন, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’ আর অন্য দেশের কবি কেন বলেছেন, ‘রেইন, রেইন, গো অ্যাওয়ে’! চারটার পরেই একদম ঝুপ করে সন্ধ্যা ঘনায় এখানে। বিদেশি রুমমেটরা যে যার ঘরে ঢুকে যায়। কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেও হাই–হ্যালোর পর কথা ঠিক জমে না। ইংলিশে মন খুলে আড্ডা দেওয়া ভারি কঠিন।

ঢাকা শহরের জনারণ্য থেকে প্রায় জনশূন্য এ শহরে এসে প্রথমে মানিয়ে নিতে কষ্ট হলেও এখন সয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে একাই বেরিয়ে পড়ি বড় শহরের রোশনাই দেখতে। কিন্তু বড় শহর একা ঘুরে দেখার চেয়ে বান্ধবীদের নিয়ে রিকশায় ঘোরাঘুরির দিনগুলো অনেক ভালো ছিল। সবাই মিলে সন্ধ্যায় চা-নাশতা খেতে খেতে গল্পগুজব করার টানে বারবার দেশে যেতে মন চায়!

‘বাংলাদেশ’ নামের একরত্তি শব্দটা হৃদয়ের গভীরে গিয়ে দোলা দেয়। বুকটা তখন খাঁ খাঁ করে।

ফেরদৌসি বেগম
ফেরদৌসি বেগম

বাংলাদেশের আলো–বাতাসের জন্য মন কাঁদে

ফেরদৌসি বেগম, পোর্টল্যান্ড ওরেগন, যুক্তরাষ্ট্র

আজ অনেক বছর হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্র এসেছি। প্রথমবার এসেছিলাম বেড়াতে। তারপর পরিস্থিতির চাপে প্রতিবছরই আসতে লাগলাম এবং প্রয়োজনের তাগিদে একসময় বসবাস শুরু করলাম। স্বামীর অসুস্থতা ও চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ গিয়ে বেশি দিন থাকতে পারি না। শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেশে গেলে কয়েক দিন থেকেই চলে আসতে হয়। 

আমি এখানে আছি ঠিকই, কিন্তু মনটা পড়ে আছে আমার জন্মভূমি সুদূর বাংলাদেশে। যে মাটিতে আমি জন্মেছি, যে দেশের আলোবাতাসে আমি বেড়ে উঠেছি। যে দেশে আমার সমস্ত আত্মা আর অস্তিত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে, মনটা তো সেখানেই। যেখানে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে আমার শৈশব, কৈশোর ও সারা জীবনের মধুময় সব স্মৃতি। যেই মাটিতে ঘুমিয়ে আছেন আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন বাবা-মা, আত্মীয়–পরিজন। আমার সংসারজীবন, আমরা সন্তানেরা সবই তো দেশে। 

যুক্তরাষ্ট্রে আরাম–আয়েশ, সুযোগ–সুবিধা, প্রাচুর্য—কোনো কিছুরই কমতি নেই। কিন্তু প্রাচুর্যই কি জীবনের সব? এত কিছুর মধ্যে থেকেও আমি আমার জন্মভূমিকে একমুহূর্তের জন্য ভুলে থাকতে পারি না। আমি বড় বেশি ভালোবাসি আমার দেশকে, ভালোবাসি আমার দেশের মানুষকে। খুঁজে ফিরি আমার দেশের মাটির গন্ধ, ধুলাময় অলিগলি পথ, গাছপালা—সবকিছু। কী অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা আমার জন্মভূমি। কী নিবিড় সখ্য ছিল সবকিছুর সঙ্গে। যে দেশে যতই প্রাচুর্য থাকুক, দেশের আলোবাতাস কি সেখানে মেলে! যেখানে বসে গাওয়া যায়, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি...।

মাহমুদুল হাসান
মাহমুদুল হাসান

দেশটা ভালোবাসার জায়গা
মাহমুদুল হাসান, তাবুক শার্মা, সৌদি আরব

তখন আমি স্কুলের ছাত্র। বাড়ির ওপর আকাশ দিয়ে বিমানের উড়ে যাওয়া দেখার জন্য ছোটাছুটি করতাম। আমার মেজ কাকা ও ছোট কাকা—দুজনেই ছিলেন সৌদিপ্রবাসী। তখন মনে মনে ভাবতাম, এই বিমান দিয়ে হয়তো তারা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরছে। তখন বিদেশকে মনে হতো এক রূপকথার রাজ্য। যেখানে যা চাই তা–ই পাব, টাকাপয়সা সোনা-রুপা যা চাই, তা–ই আমার হবে। তখন থেকেই ইচ্ছাটা জাগে এই রূপকথার রাজ্যে পাড়ি জমানোর।

এইচএসসি পরীক্ষার পর পাসপোর্ট করলাম। কয়েক দিন পরে সৌদি আরবের ভিসাও হাতে পেলাম। এবার কেবল অপেক্ষা ওই রঙিন বিমানে করে রূপকথার দেশে পাড়ি জমানোর। বিমানবন্দরে আমাকে বিদায় জানাতে আব্বা, দুলাভাই, ছোট ভাই আর আমার বন্ধু এসেছিল। আমাকে একা রূপকথার রাজ্যের পথে রেখে তারা চলে গেল। বিদেশের বিমানে ওঠার পর এই প্রথম মনে হলো, আমি একা হয়ে গেলাম। সবার থেকে অনেক দূরে চলে এলাম।

আমার কর্মস্থল সৌদি আরবের তাবুক শার্মা শহরের নিয়ম বাই এয়ারপোর্টে। এখানে প্রতিদিন অনেক বিমান ওঠানামা করে। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি আর ভাবি, আসবে কি সেই দয়ালু বিমানটি। যে আমাকে পৌঁছে দেবে আমার দেশের মাটিতে, নিজ শহরে, আমার পরিবারের কাছে। এসব রূপকথার রাজ্য আমি চাই না। রূপকথার রাজ্য তো সেটা, যেখানে আমার মা থাকেন, ভাইবোন থাকেন, প্রিয় ভাগনে–ভাগনিরা থাকেন। আমি তো সেই দেশে যেতে চাই, যেখানে আমার গ্রামের প্রকৃতি এবং পরম মানুষজনের মুখ দেখা যায়। যেখানে আলো–হাওয়া গায়ে মাখলে আমার কোনো অসুস্থতা আসবে না বলে মনে হয়।

আধুনিক যুগে প্রযুক্তির সুবাদে ভিডিও কলের মাধ্যমে সেই রূপকথার মানুষদের সঙ্গে এখন দেখা হয়। কিন্তু এই দেখা আকুলতা আরও বাড়িয়ে দেয়। তাঁদের সাথে কথা হলেও ছুঁয়ে দেখা যায় না, গায়ে এসে লাগে না তাঁদের স্নেহের পরশ। মাতৃভূমির আলো-বাতাস ও মাটির ছোঁয়া আমাকে অতৃপ্ত রাখে। আর তাই সারাক্ষণ ভাবি, সব অমঙ্গল থেকে আমার দেশ ও দেশের মানুষ যেন সুরক্ষিত থাকে। দেশের উন্নতি ও অগ্রগতিতে সাধ্যমতো আমাদের অবদান থাকবে। আমরাই স্বদেশপ্রেমের ভেতর দিয়ে বিশ্বপ্রেমের সেতুবন্ধ রচনা করব।

অর্পিতা আদিত্য
অর্পিতা আদিত্য

এখানে কি নেই?
অর্পিতা আদিত্য, পিএইচডি শিক্ষার্থী, ম্যারিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র।

প্রবাসে এসেছি দুই বছর হয়ে গেল। দেশ ছাড়ার প্রাথমিক খারাপ লাগা কমেছে, এখানকার গতির সঙ্গে তাল মেলাচ্ছি। তারপরও যখন একটু কম কাজ থাকে, দেশের যেকোনো বিষয়ের কথা মনে করে খারাপ লাগে। বিদেশে হয়তো সব আছে, কিন্তু দেশ নেই। মা-বাবা নেই, নিজের সেই বাড়ি নেই, বারান্দা নেই, বারান্দার সামনের সেই এক চিলতে রোদ নেই।

রিকশা নেই, নেই রিকশায় করে বেড়ানো বান্ধবীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস নেই, মাঝ রাস্তায় বাস থামিয়ে বাসে ওঠার সেই ব্যবস্থাও নেই।

ভালো রান্না নেই। বন্ধু নেই। রুমি, যূথী, সুমি, জেমিনি, সালমা নেই। শাড়ি পরে ছবি তোলা নেই। এখন আর কেউ বলে না—দোস্ত, কালকে তো আর পরীক্ষা না, চল মাঠে গিয়ে বসি। প্রিয় সহকর্মীদের খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে দেশের ঝালমুড়ি, পুরি, শিঙাড়া, আলুর চপ, আম ভর্তা, চটপটি, ফুসকার কথা। টিএসসির ১০ টাকা দামের নিউজ পেপার খাতার জন্যেও তাই মন খারাপ হয়। মন খারাপ হয় ম্যাটাডোর কলম বা নীলক্ষেতের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ফটোকপির দিনগুলো মনে করলেই। এই যে এত কিছুর জন্য নেই নেই, তারাও কী আমাকে মিস করে না! এসবের জন্য যদি মন খারাপ হয় সেটা কী দেশের জন্য মন খারাপ না? 

তাসরিফ আহমেদ
তাসরিফ আহমেদ

কাজ করি দেশের জন্য
তাসরিফ আহমেদ, ইউনিটি সেন্টার, সিঙ্গাপুর

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। আমাদের জীবনে বিজয়ের ছোঁয়া লেগে আছে সেই ছোটবেলা থেকে। যখন স্কুলে পড়তাম তখন থেকেই ষোলো ডিসেম্বরের কুচকাওয়াজে স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করতাম। তারপর স্কুল ও কলেজজীবন শেষ করে এখন প্রবাসজীবন। থাকি সিঙ্গাপুরে। নাম হয়ে গেল প্রবাসী বাংলাদেশি।

প্রবাসীদের সম্পর্কে আমাদের মনে একটু আবেগ–অনুভূতি কাজ করলেও কতটুকু জানি প্রবাসজীবন সম্পর্কে! কঠোর পরিশ্রম করে সাফল্য অর্জনের জন্য মাতৃভূমি ছেড়েছি প্রায় তিন বছর। আকাশচুম্বী দালানকোঠার এ শহরে একজন প্রবাসীর জীবন সীমাহীন কষ্টের। সপ্তাহ আর মাস শেষে কাজের ক্লান্তি দূর করতে একটু ছুটি পেলেই ছুটে যাই কোনো এক বাংলাদেশির কাছে। তারপর, সময়টাকে উপভোগ করে ঘরে ফিরি একবুক স্মৃতি নিয়ে। পরদিন আবার সেই নিজের জন্য কাজ করা শুরু। আমি সব সময়ই চেয়েছি বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে, এখন আমার বাংলাদেশি ভাইদের জন্য কিছু করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি খুব আশাবাদী হয়ে এটুকু বলতে পারি যে কোনো এক দেশি ভাইকে সাহায্য–সহযোগিতা করলে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হয়। মনে হয়, দেশের জন্যই তো কিছু করলাম। 

আমার মা, মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ছেড়ে থাকার কিঞ্চিৎ কষ্ট নিয়ে কত দিন বেঁচে থাকতে হবে, সে উত্তর অজানা। দেশের বাইরে থাকলেও সব সময় বুকের মধ্যে থাকে বাংলাদেশ। এখন বুঝি, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ এ এক মধুর লাইন।

জাতীয় সংগীত শুনে কাঁদি

মোবারক হোসেন, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত

যখন স্কুলে পড়তাম, জাতীয় সংগীতের সময় স্কুলের বাইরে লুকিয়ে থাকতাম। রোদের মধ্যে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে জাতীয় সংগীত আর পিটি থেকে বাঁচার জন্য বন্ধুদের সঙ্গে পালাতাম। এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করার পর দুবাই চলে এলাম শ্রমিক হিসেবে। এখানে অনেক পরিশ্রম করি, কখন সূর্য ওঠে আর ডোবে বুঝতে পারি না। রোদে গা পুড়ে যায়। অনেক কষ্টে, দুঃখে দিন কাটে। তারপরও বাড়িতে ফোন করে বলি, ‘মা, ভালো আছি। অনেক সুখে আছি। এখানে এসির মধ্যে থাকি।’ মা ভিডিও কল দিতে বলে, আমি বলি, এখন না। রাতে ফিরে কল দেব। মা বলে, তুই ভালো আছিস তো মোবারক? আমি আর কথা বলতে পারি না। লাইন কেটে দিই।

মা, মাটি আর বাংলাদেশের জন্য হাউমাউ করে কাঁদি। ভারত আর শ্রীলঙ্কার শ্রমিকেরা সান্ত্বনা দেয়। সবাই মিলে দেশের জন্য কাঁদি। আমার মনে হয় দেশের জন্য যদি কেউ বেশি চিন্তা করে থাকে, তবে প্রথমে আসবে প্রবাসীদের নাম।

মা ও জন্মভূমি প্রবাসীদের কাছে সোনার চেয়ে মূল্যবান। কিছুদিন আগের বুলবুল ঝড়ের সময় রুমের মধ্যে সবাই মিলে সারা রাত দোয়া করেছি, কারও যেন ক্ষতি না হয়। মোবাইলে বাংলা গান শুনি, শুনে শুনে নিজেরাও গাই। জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা শুনলে এখন শক্তি পাই। যতই গরমে গা পুড়ে যাক, এই গান শুনলে গরম লাগে না। মনে হয় বাংলাদেশের আকাশের নিচে বসে আছি। খালি চোখের পানি বাধা মানে না। এখানে কষ্টে আছি শুনলে মায়ের কষ্ট হবে, তাই ছবি ছাড়লাম না।

বোরহান খান
বোরহান খান

বাংলাদেশ, আমি তোমায় ভালোবাসি
বোরহান খান, ব্যবস্থাপক, অ্যাল্ডি সুপার মার্কেট, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

১৫ বছর হলো দেশ ছেড়েছি। তবে এক মুহূর্তের জন্যও বাংলা, বাংলাদেশকে ভুলে থাকতে পারিনি।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে আমার বসবাস। ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করি বহুজাতিক একটা সুপার মার্কেটে। এখানে দেশের অনেক কিছুই আছে—বাংলা বাজার, বাংলা খাবার, বাংলা সাংস্কৃতিক উদযাপন, বাংলা পণ্য; কিন্তু এরপরও কোথায় যেন নেই নেই একটা অনুভূতি কাজ করে। কোথায় যেন আমার বাংলাদেশ, আমার কুলিয়ারচরের বাঙালি ছোঁয়াটা নেই।

ডিসেম্বর মানেই বাংলাদেশের বিজয়ের মাস। আমার ছোটবেলায় এই বিজয় মাসে শীত সকালের বিভিন্ন উদযাপনগুলো ভীষণভাবে অনুভব করি। কখনো কখনো নিজের অজান্তেই কল্পনায় এক পা, দুই পা করে কুলিয়ারচরের ভেজা মাটির দূর্বা ঘাসে ফুল হাতে স্মৃতির দিকে হাত বাড়াই। কিন্তু তাতে মন অতৃপ্ত থাকে।

সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে ছুটে যাই। জন্মভূমির জল, মাটি, বাতাসের আলাদা একটা শক্তি আছে। সেটা হয়তো দেখা যায় না, অনুভব করা যায়। এখনো কুলিয়ারচরের ভোরের সূর্য, পূর্ণিমার চাঁদ, নদীর ঢেউ, বিল, পাখির কলরব জাদুমন্ত্রের মতো টানে। যাঁরা দেশে থাকেন তাঁরা হয়তো বুঝতেই পারেন না যে বাংলাদেশের দুঃখ-বেদনা, কষ্ট আমরা কতটা অনুভব করি।

বৈশ্বিক এ সহজ যোগাযোগের সময়ে মানুষ হয়তো একদিন তাঁর জন্মভূমির জন্য আলাদা করে শূন্যতা অনুভব করবে না। কিন্তু আমার মনে হয়, শুধু মৃত্যু পর্যন্ত না, ওপরে গিয়েও দেশের শূন্যতা অনুভব করব। চিৎকার করে বলব—বাংলাদেশ, আমি তোমায় ভালোবাসি।

মো. জাহাঙ্গীর আলম
মো. জাহাঙ্গীর আলম

প্রবাসীদের কথাও একটু ভাবুন
মো. জাহাঙ্গীর আলম, ঢাকা মেডিকেল সেন্টার, রিয়াদ, সৌদি আরব

আমরা প্রবাসী। মা আমাদের কাছে নেই। জন্মভূমির মাটির স্পর্শও আমরা পাই না। আমাদের দিনরাত কাটে পরিশ্রমে, পরিবার আর স্বজনের চিন্তায়। আমরা সব কষ্ট হাসিমুখে সয়ে বেঁচে থাকি। মা যখন মুঠোফোনে জানতে চান, কেমন আছি? মলিন মুখ নিয়েও তখন বলি, ‘ভালো আছি মা। কত সুযোগ-সুবিধা এখানে!’ ছোট ভাইবোনের কত আবদার। কারও বিদেশি চকলেট চাই, কারও বিদেশি পারফিউম। কারও একটা মুঠোফোনের চাহিদা। আমরা নিজেরা এক বেলা কম খেয়েও প্রিয়জনদের আবদারগুলো পূরণ করতে চাই। মৌমাছির মতো তিলে তিলে জমানো টাকা দেশে পাঠাই। রেমিট্যান্স বাড়ে, আমাদের পরিবার-পরিজন সচ্ছল থাকে।

আমরা প্রবাসে থাকি বলেই উপলব্ধি করি দেশের মমত্ব কতটুকু। উপলব্ধি করি মায়ের মতো দেশও কত প্রিয়। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করতে আমরা দিনরাত খেটে যাই। আমাদের পরিশ্রমে বাংলাদেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। আমরা প্রবাসীরাই ব্যাংকিং চ্যানেলে ২০১৫ সালে ১ হাজার ৫৩১ কোটি মার্কিন ডলার ও ২০১৬ সালে ১ হাজার ৩৬১ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছি। প্রিয় বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়, তখন আমাদের ভালো লাগে। যখন আমরা নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করতে পারি, তখন গর্বে ঘামে ভেজা এ বুক ভরে ওঠে। বাংলাদেশি হিসেবে আমরা গর্ববোধ করি, আনন্দিত হই।

আমাদের ঈদ, পূজা, উদ্​যাপন বলতে তেমন কিছু থাকে না। পরিবার-পরিজন ছাড়া কি আর আনন্দ হয়। তা ছাড়া হয়তো এসব দিনে প্রবাসে ছুটি নেই। ছুটি থাকলেও একা একা মন টানে না। বুক ফেটে কাঁদতে ইচ্ছে করে। নিজেদের এতিম আর নিঃসঙ্গ মনে হয়। প্রবাসী ছাড়া এই বেদনাটুকু আর কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন না। এটিও যে আত্মত্যাগ, তাই অনেকে সেটি বুঝতে পারেন না, বোঝার চেষ্টাও করেন না। প্রবাসে থাকলে ভাবি, কবে ছুটি পাব, কবে টাকা জমাব, দেশে যাব। ছুটি মিললেও আর্থিক সামর্থ্য হয়ে ওঠে না। দুই বছর, তিন বছর, চার বছর পর হয়তো আমরা দুই-তিন মাসের জন্য দেশে ফিরি। এই ফেরাই আমাদের ঈদের আনন্দ, স্বর্গীয় সুখ বলে মনে হয়। দেশের মাটি ছোঁয়ার জন্য প্রবাসীদের আকুলতা কে বুঝবে! অতিথি পাখির মতো স্বদেশে আমরা অতিথি হয়ে যাই।

শ্রম, ঘাম, জীবন, যৌবন দিয়ে প্রবাসীরা দেশ ও স্বজনের জন্য কাজ করে। অথচ প্রবাসীরা যেন তাঁদের প্রাপ্য সম্মান পাচ্ছেন না। কোথাও যেন একটা বাধা আছে। কোথাও যেন আমাদের ছোট করে দেখার মানসিকতা এখনো রয়ে গেছে। সে জন্য আমাদের কত রকমের কথা শুনতে হয়। দূতাবাস, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে কত স্থানেই না প্রবাসীদের হয়রানি হতে হয়। আবার অনেকের ‘মূর্খ’, ‘অশিক্ষিত’, ‘বর্বর’ গালি শুনতে হয়। কেউ কেউ বলেন, আমরা কামলা, জুতো পালিশ করি। আমাদের সত্যিই তখন প্রতিবাদের ভাষা থাকে না। আমাদের শ্রমে আমাদের পরিবার সুখে থাকে। আমাদের দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়। এটি কি আমাদের অর্জন নয়? আর দেশবাসীর কাছে অনুরোধ, আপনারা প্রবাসীদের নিয়ে একটু মানবিকভাবে ভাবুন। প্রবাসীরা ভালো থাকলেই দেশ ও মানুষ ভালো থাকবে। 

মাহবুবুল আলম
মাহবুবুল আলম

দেশকে অনেক বেশি মিস করি
মাহবুবুল আলম, ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট এজেন্ট

|নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট-ট্রাফিক ডিভিশন, যুক্তরাষ্ট্র।

জীবিকার তাগিদে প্রবাসজীবন বেছে নেওয়া। সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে আমি এখন আমেরিকায়। আগে প্রবাসীদের কষ্ট শুনলে বুঝতে পারতাম না। এখন বুঝতে পারি, বুঝতে পারি নিজের প্রবাসজীবনের জন্য। মা–বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনকে ছেড়ে দূর–দূরান্তে পড়ে থাকা অনেক বেশি কষ্টের। চেনা পরিবেশ ছেড়ে অচেনা একটা পরিবেশকে আপন করে নেওয়া আসলেই দুঃসাধ্য। প্রবাসে থাকলেও মন পড়ে আছে বাংলাদেশে। প্রতিদিন প্রতিক্ষণ শুধু আমার প্রিয় মাতৃভূমিকে মনে পড়ে। মনে পড়ে, আমার সেই ছোট্ট গ্রামের মেঠোপথ। চিরচেনা সেই গ্রামখানির ছবি ভেসে উঠে স্মৃতিপটে। ইচ্ছে করে ফিরে যাই আমার সেই গ্রামে। মন চায় পানিতে সাঁতার কাটতে। কত দিন হলো পুকুরে নেমে গোসল করি না। মাছ ধরি না। গ্রামের কুয়াশাভেজা সবুজ ঘাসের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে খুব ইচ্ছে করে। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছের ঝোল খেতে খুব ইচ্ছে করে।

শীতের সকালে মায়ের হাতের নানা পদের পিঠা খুব মিস করি। মায়ের হাতের খাবার খাই না অনেক বছর হয়ে গেল। বাবার আলিঙ্গন, ভাইবোনের সঙ্গে একত্রে বসে আড্ডা দেওয়া, খাওয়াদাওয়া, খুব বেশি মিস করি। এসব ভাবলেই চোখে পানি চলে আসে। এত দূরে থাকি যে চাইলেই দেশে আসা যায় না। এখানে চলতে–ফিরতে বাংলাদেশি কাউকে দেখলে মনটা ভরে যায়। কিংবা হঠাৎ করে কারও মুখে বাংলা ভাষাটা শুনলে খুব ভালো লাগে। মনে হয় আমার দেশেই আছি। আমরা যারা প্রবাসে আছি, তাদের সবারই আলোচনার বিষয় থাকে প্রিয় মাতৃভূমি। দেশের যেকোনো ভালো খবর আমাদের অনেক আনন্দ দেয়। ঠিক তেমনি যেকোনো খারাপ খবর হতাশ করে আমাদের। দেশের মানুষের মধ্যে যে ধরনের আন্তরিকতা ভালোবাসা রয়েছে, এখানে সে ব্যাপারটা খুব মিস করি। এতটা বছর বিদেশে থেকেও এখানকার কোনো কিছু নিজের করে নিতে পারিনি! দেশের প্রতি যে এত টান, এত মমত্ববোধ বিদেশে না এলে কেউ বুঝবে না।

স্বদেশের জন্য যে হাহাকার অন্তরে বয়ে বেড়াতে হয়, তা প্রবাসী ছাড়া কেউ বুঝবে না। দেশের জন্য আমার এই আবেগ ও ভালোবাসা আজীবন থাকবে। 

আমি নিউইয়র্ক পুলিশের ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত। এখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত আছে। জনগণও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পূর্ণ নাগরিক সুবিধা পাওয়া যায়। আমার বিশ্বাস, একদিন বাংলাদেশ ও উন্নত দেশগুলোর মতো হয়ে উঠবে। এটি শুধু আমাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। আমরা যদি একটু সচেতন হই, তবে আমাদের এই সোনার বাংলা একদিন পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। দেশকে স্বাধীন করতে যাঁরা অবদান রেখেছিলেন, এই বিজয়ের মাসে তাঁদের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।