গ্যাসলাইটিং: আমাকে শেষ করে দিচ্ছে

কারও মাধ্যমে গ্যাসলাইটিংয়ের মতো মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বুঝতে পারলে নিজের সিদ্ধান্ত আর বিশ্বাসে অটল থাকুন। মডেল: প্রভা, ছবি: সুমন ইউসুফ
কারও মাধ্যমে গ্যাসলাইটিংয়ের মতো মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বুঝতে পারলে নিজের সিদ্ধান্ত আর বিশ্বাসে অটল থাকুন। মডেল: প্রভা, ছবি: সুমন ইউসুফ

মিসেস নীরা (ছদ্মনাম) নিয়মিত সন্তানকে স্কুলে আনা–নেওয়া করেন। তিনি লক্ষ করতে থাকলেন, ওই স্কুলের আরেকজন সুদর্শন অভিভাবক মি. আতিক (ছদ্মনাম) কী রকমভাবে যেন তাঁর দিকে তাকান। দেহের ভাষা আর চোখের চাহনি দিয়ে মিসেস নীরার দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। আর ধীরে ধীরে নীরা নিজেও আতিক সাহেবের প্রতি দুর্বল হতে থাকলেন। মাঝেমধ্যে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা থেকে শুরু করে মুঠোফোনের নম্বর আদান–প্রদান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (সোশ্যাল মিডিয়া) যোগাযোগ এবং রোমান্টিক বার্তা আদান–প্রদান হতে থাকে।

কেউ হয়তো শারীরিক ও মানসিক ভাষা দিয়ে অপর একজনকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। একপর্যায়ে সে সফলও হলো। সেই আরেকজনের মানসিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলল সে। এরপর যদি তার সব কথা না শোনে, তবে শুরু হয় ব্ল্যাকমেলিং, মানসিক নির্যাতন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ‘গ্যাসলাইটিং’। এই গ্যাসলাইটিং শিকারকে কুরে কুরে খায়। তাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। লিখেছেন মনোরোগ চিকিৎসক আহমেদ হেলাল।

একপর্যায়ে আতিক সাহেব যেন নীরার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেন। কোনো একসময় অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে নীরার ওপর মানসিক চাপ দেওয়া শুরু করেন। নীরা যা করেননি বা বলেননি, সেটাও সত্য বলে তাঁর ওপর চাপাতে থাকেন। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং করা শুরু করেন। নীরার মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্নতা আর চাপের (স্ট্রেস) লক্ষণ দেখা দিতে শুরু হয়। বিপর্যস্ত নীরা নিজেকে মানসিক রোগী হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এভাবে মানসিক নির্যাতন করাকে বলা হয় ‘গ্যাসলাইটিং’। 

যেভাবে গ্যাসলাইটিং
তিরিশের দশকে প্যাট্রিক হ্যামিলটন রচিত গ্যাসলাইট উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এবং ১৯৪৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত গ্যাসলাইট থ্রিলারছবি থেকে এ শব্দটি এসেছে। সেই চলচ্চিত্রে নায়ক চার্লস বয়ার একজন স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করে ধীরে ধীরে তাঁর স্ত্রীর মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। স্ত্রীকে (বার্গম্যান) মানসিকভাবে নির্যাতন করতে থাকেন। একপর্যায়ে স্ত্রীকে ভাবতে বাধ্য করেন যে স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। যাঁরা এ ধরনের নিপীড়ন করেন, তাঁদের বলা হয় ‘গ্যাসলাইট’ আর প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ‘গ্যাসলাইটিং’। 

ভাবতে বাধ্য করা হয়
গ্যাসলাইটিং–প্রক্রিয়ায় শিকারকে ভাবতে বাধ্য করা হয় তিনি ভুল করেছেন বা ভুল ভেবেছেন। যেমন যে কাজটি তিনি করেননি, তাঁকে ভাবতে বাধ্য করা হয় সেই কাজটি তিনি করেছেন। আবার যা প্রকৃতপক্ষে ঘটে গেছে, কিন্তু শিকারকে ভাবতে বাধ্য করা হয় এমনটা আদৌ ঘটেনি। ফলে বাস্তবতা আর বিশ্বাসের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এই দ্বন্দ্ব থেকে মানসিক বিপর্যস্ততা দেখা দেয়। হয়তো একটি ই–মেইল ডিলিট করে দেওয়া হলো এবং যিনি মেইলটা পাঠিয়েছেন তিনি অস্বীকার করা শুরু করলেন যে আদৌ কোনো মেইল পাঠানো হয়নি! তখন মেইল প্রাপক একধরনের মানসিক যাতনায় পড়ে যান, নিজের ওপর বিশ্বাস হারাতে থাকেন।

যা করেননি তা ভাবতে েকউ যেন আপনাকে বাধ্য করতে না পারে
যা করেননি তা ভাবতে েকউ যেন আপনাকে বাধ্য করতে না পারে

নারী বা পুরুষ যে কেউ গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হতে পারেন, তবে নারীদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।দ্য গ্যাসলাইট ইফেক্ট বইয়ের লেখক ড. রবিন স্টার্ন, যিনি আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স) নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন, তিনি তিন ধরনের ‘গ্যাসলাইটার’–এর বর্ণনা তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন। প্রথম ধরনটি হচ্ছে যাঁরা অন্যকে বাধ্য করেন, ভয় দেখান বা ত্রাস সৃষ্টি করে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনেন। একধরনের নীরব ত্রাস তৈরি করেন।

দ্বিতীয় ধরনটি হচ্ছে খুব ভালো ভাবমূর্তি বা ইমেজের অধিকারী—যাঁরা সুদর্শন, আকর্ষণীয়, সামাজিক, বিভিন্ন গুণের অধিকারী। তাঁরা শিকারকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করেন, এরপর শিকারের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।

তৃতীয় ধরনটি হচ্ছে মোহনীয় আবেদনময়। তাঁরা প্রথম দিকে শিকারের প্রতি অতি যত্নবান হন, তাকে সম্মান করা শুরু করেন এবং একপর্যায়ে শিকারকে বাধ্য করেন কেবল তাঁর প্রতিই আকৃষ্ট থাকতে। একটা পর্যায়ে তিনি শিকারকে নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। 

কারা গ্যাসলাইটিং করেন

  • যাঁদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা রয়েছে, বিশেষ করে আত্মমগ্ন ব্যক্তিত্ব বা নার্সিসিস্ট পারসোনালিটি সমস্যা।
  •  যাঁরা শৈশবে শারীরিক বা মানসিক, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।
  •  যাঁরা সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে নিয়ে উদ্বিগ্ন বা সন্দেহপ্রবণ।
  •  যাঁদের সঙ্গী/সঙ্গিনী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হুমকি দিতে থাকেন।
  •  যাঁদের মধ্যে আবেদনময়তা বেশি।
  •  যাঁরা ‘মাইন্ডগেমে’ যথেষ্ট ঝুঁকি নিতে পারেন।
  •  যাঁরা মিথ্যা আবেগের অভিনয় করতে পারেন, প্রকৃত আবেগ তাঁদের মধ্যে কম থাকে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা বলেন বা মিথ্যা পরিবেশ সাজিয়ে তোলেন।
  •  যাঁদের আই কন্টাক্ট ভালো, বডি ল্যাংগুয়েজ ভালো, ননভার্বাল ল্যাংগুয়েজে যিনি দক্ষ।
  •  গ্যাসলাইটার আসলে ঠিক ভিলেন নন, অনেকটা অ্যান্টি ভিলেন। অর্থাৎ প্রকৃত খলনায়ক না হয়েও তাঁর কর্মকাণ্ড খলনায়কের মতোই।
  •  যিনি প্রতিনিয়ত শিকারের মনে দ্বন্দ্ব (কনফিউশন) তৈরি করেন। 

কীভাবে বুঝবেন আপনি গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হচ্ছেন
যখন দেখবেন কেউ আপনাকে বিভ্রান্ত করছেন, আপনার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা অলীক প্রমাণিত হচ্ছে বা যা হয়নি, তা হয়েছে বলে সবাইকে বিশ্বাস করাচ্ছেন। নিজের বিশ্বাসের ওপর আস্থা হারাতে থাকবেন এবং সন্দেহ শুরু হবে, ‘আসলেই কি এমনটা হয়েছে, নাকি হয়নি?’

আপনাকে মানসিক রোগগ্রস্ত হিসেবে বারবার চিহ্নিত করা হচ্ছে।

আপনি নিজেও ভাবতে থাকছেন যে আপনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন।

একটি অস্বাভাবিক ঘটনাকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখানো শুরু হবে, ‘গ্যাসলাইটার’ আপনাকে বোঝাবে যে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা আদৌ ঘটেনি।

 আপনি চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য উদ্বিগ্ন, হতাশ আর বিষণ্ন হতে থাকবেন।

 নিজেকে নিজের কাছে অপরিচিত মনে হবে।

 জনসমক্ষে আপনাকে হেয়প্রতিপন্ন করা হচ্ছে।

 ‘গ্যাসলাইটার’ আপনাকে প্রমাণ করে দিতে থাকবে যে আপনি ভুলে গেছেন বা ভুলে যাচ্ছেন।

 প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে থাকবে যে আপনি মিথ্যাবাদী অথচ আপনি মিথ্যা বলেননি।

 আপনি কোনো কিছু শোনার অভ্যাস হারিয়ে ফেলবেন। কারণ, আপনার মনে হবে, যা শুনবেন তা হয়তো আপনাকে আতঙ্কিত করবে।

 আপনি একটা সময় নিজেই নিজেকে ভয় পেতে থাকবেন—হয়তো আপনার মধ্যে আত্মহননের ইচ্ছাও জাগতে পারে।

কী করবেন
যদি মনে করেন যে আপনি গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তবে যা করতে পারেন—

 নিজের সিদ্ধান্ত আর বিশ্বাসে অটল থাকুন। মনে রাখুন, আপনি কারও মাধ্যমে গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হলেও হতে পারেন। তাই পরখ না করে কোনো কিছু বিশ্বাস করবেন না।

 সবকিছুর একটি ব্যাকআপ বা রেকর্ড রাখুন। কাউকে গ্যাসলাইটার হিসেবে যদি সন্দেহ করে থাকেন, তবে তাঁর সঙ্গে আপনার সব যোগাযোগের রেকর্ড আলাদা সংরক্ষণ করুন।

 নিজের জীবনকে নিজের করে ভাবতে শিখুন। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হবেন না। যদি দেখেন প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছেন, তখন নিজেই মনে মনে প্রভাবের বিপরীতে পাল্টা যুক্তি তৈরি করুন।

 আপনার দুর্বল জায়গাগুলো, যেমন আপনার সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।

 কেন একজন ‘গ্যাসলাইটার’ হিসেবে আপনাকে তাঁর শিকার বানাচ্ছেন, তা ভেবে দেখুন। হয়তো তাঁরও কিছু অপ্রাপ্তি আর হতাশা রয়েছে। তাই তাঁর প্রতি আক্রমণাত্মক না হয়ে নিজেকে রক্ষা করার দিকে বেশি সচেষ্ট হোন।

 আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু বা পরিবারের সদস্য বা বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে পারেন। তাঁদের কাছে পুরো বিষয়টি খুলে বললে আপনি উপযুক্ত নির্দেশনা পাবেন।

*আহমেদ হেলাল, সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।