দিন যায় কথা থাকে

বিপদ–আপদে ৯৯৯–এ ফোন করার প্রবণতা বেড়েছে
বিপদ–আপদে ৯৯৯–এ ফোন করার প্রবণতা বেড়েছে

‘দিন যায় কথা থাকে’ বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী সুবীর নন্দীর গাওয়া একটি জনপ্রিয় গান। সত্যি সত্যি দিন চলে যায়, পড়ে থাকে কথা, গান, স্মৃতি। জীবনের বালুকাবেলার পড়ে থাকা নুড়িপাথর নিয়েই আবার চলা শুরু হয় অসীম সম্ভাবনার দিকে। ২০১৯ সাল যাই যাই করছে। ২০২০ কড়া নাড়ছে দরজায়। এই উনিশ-বিশের ফাঁকে আমাদের জীবনযাপনের প্রণালিতে বেশ খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। পুরো বছর সে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলেছি আমরা। বছর শেষের সঙ্গে সব কি তার ভেসে গেছে? যায়নি আর যাবেও না; বরং এই সব অভ্যাসের সঙ্গেই বসবাস পোক্ত হবে সামনের দিনগুলোতে। 

স্থান–কাল–পাত্র যা-ই হোক হেডফোনে গান শোনা হচ্ছে বেশি
স্থান–কাল–পাত্র যা-ই হোক হেডফোনে গান শোনা হচ্ছে বেশি

গান শুধু শোনার বিষয় নয়
গান দিয়েই শুরু করা যাক। আমরা যারা গত শতকের আশির দশকে বড় হয়ে উঠেছি, গান শোনার যন্ত্র হিসেবে তারা দেখেছি গ্রামফোনের শেষ যুগ, বেতারের যৌবন, মাইকের প্রাদুর্ভাব, ক্যাসেটের রমরমা। ওয়াকম্যানের সঙ্গে ছোট আকারের সাউন্ডবক্স জুড়ে দিয়ে গাছতলায় কিংবা পাড়ার মোড়ে মোড়ে ক্যারম খেলার স্মৃতি এখনো আমাদের কাতর করে তোলে। সেই আমরাই যৌবনে এসে সিডির দেখা পেয়েছি। তারপরেই এসেছে এমপি–থ্রির বিপ্লব। বিভিন্ন যন্ত্রে সে মাধ্যমে গান শোনার চল হলো। সেই সঙ্গে এল হেডফোন। এল আরও শক্তিশালী যন্ত্র স্মার্টফোন। ইন্টারনেট সাশ্রয়ী হলো, ফোনে এল মেগা আর গিগাবাইটের বাহার। গান শোনার যে উদ্যম, সেটা ঢুকে গেল পকেটে, সেখান থেকে হেডফোনের মাধ্যমে কানে। পুরো ২০১৯ এই প্রক্রিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। এখন বাইরে বের হলেই বয়স–নির্বিশেষে কানে হেডফোন গোঁজা মানুষ চারদিকে গিজগিজ করে। যানজটে যখন মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ওঠে, তখন দেখা যায় ভিড়ের মধ্যে কোনো এক তরুণ বা তরুণী কানে হেডফোন লাগিয়ে শান্ত–নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শুনছেন তাঁর প্রিয় কোনো শিল্পীর গান। মনটাই ভরে ওঠে।

গান শোনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেছে বিভিন্ন অ্যাপকে কেন্দ্র করে। অ্যাপ স্টোর কিংবা গুগল প্লের মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপ পুরো বছর ধরে শুনিয়েছে বিভিন্ন ভাষায় বিচিত্র পদের গান। ইউটিউবের কথা ছেড়েই দিলাম এ বিষয়ে। যে বিষয়টাতে আমাদের মৌলিক পরিবর্তন হয়েছে সেটা হলো, গান দেখার প্রবণতা। এই ইন্দ্রিয়ভোগ্য গান দেখানোতে নির্দ্বিধায় বলা যায় ইউটিউব এগিয়ে। 

ঘরেই সিনেমা দেখা
গানের মতো একই পথে হেঁটেছে চলচ্চিত্র। বাংলাদেশে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা কমছে প্রতিবছর। ২০১৯ সালও তার বাইরে ছিল না, কিন্তু সিনেমা দেখা বন্ধ থাকেনি। ব্লক বাস্টার, সিনেপ্লেক্সের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে বিদেশি, বিশেষ করে হলিউড মুভির প্রদর্শন। বেড়েছে তার দর্শক। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষ ব্লক বাস্টার বা সিনেপ্লেক্সের পাশাপাশি বড় পর্দায় বাসায় বসে দেখছে নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইমের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর বিভিন্ন কনটেন্ট। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই কনটেন্টগুলো মানুষ দেখছে টাকা দিয়েই, মাসিক ভিত্তিতে গ্রাহক হয়ে। বাংলা উদ্যোগগুলোও বসে নেই। মানসম্পন্ন কনটেন্ট তৈরির প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে তারাও। ২০২০ অপেক্ষা করছে আরও মানসম্পন্ন কনটেন্টের সম্ভার নিয়ে। 

অ্যাপ দিয়ে খাবার আনা এখন নাগরিক অনুষঙ্গ
অ্যাপ দিয়ে খাবার আনা এখন নাগরিক অনুষঙ্গ

মুঠোফোনে বাড়তি কিছু 
বলে রাখি, প্রায় এক দশক ধরে আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে মুঠোফোন নামের একেবারে ব্যক্তিগত যন্ত্র কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট শোনার প্রবণতা। প্রতিদিনের খবর, বিভিন্ন খুদেবার্তা, জীবনযাপনের বিভিন্ন পরামর্শ, এমনকি চাকরির বিজ্ঞাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রয়েছে সেসব কনটেন্টের মধ্যে। এই প্রক্রিয়া আইভিআর নামে পরিচিত। যাঁরা ইন্টারনেট–নির্ভর জীবন যাপন করেন, তাঁদের সে ব্যাপারে খোঁজখবর খুব একটা না থাকলেও যাঁরা ইন্টারনেটের ‘লো সিগন্যাল’–এর যন্ত্রণায় থাকেন, তাঁদের কাছে এই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব বেড়েছে প্রবলভাবেই। পুরো বছর ধরে বিভিন্ন শর্টকোডের মাধ্যমে শ্রুতিনির্ভর গান, খবর, অডিও নাটক, চাকরির বিজ্ঞাপন, লাইফস্টাইল টিপস ইত্যাদি শুনছেন গ্রামীণ এবং আধা গ্রামীণ অঞ্চলের শ্রোতারা। এরই ধারাবাহিকতায় পডকাস্ট জনপ্রিয় হচ্ছে আমাদের দেশে। সামনের দিনগুলোতে আইভিআর (ইন্টারঅ্যাকটিভ ভয়েস রেসপন্স) এবং পডকাস্ট বিভিন্ন শ্রেণির শ্রোতার প্রয়োজন মেটাবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

ইন্টারনেট নিয়েই জীবনযাপন
(বিজ্ঞান) ইন্টারনেট দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ—সব সময় এ কথা বলা যায় না কিন্তু। আমাদের যাপনপ্রক্রিয়ার প্রায় পুরোটাই যে ইন্টারনেটের দখলে, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি চোখের সামনে। বিনোদনের পুরোটা প্রায় এখন ইন্টারনেট–নির্ভর। বলি, আপনার হাঁড়ির খবর নিয়েছেন তো? আজ যে রান্নাটা হয়েছে আপনার বাসায়, তা যে ইন্টারনেটের রেসিপি দেখে হয়নি, সে বিষয়ে নিশ্চিত আপনি? বিনোদনের মতো খানা–খাদ্যের ব্যাপারটাও চলে যাচ্ছে ইন্টারনেটের দখলে। অন্তত এ বছর আমরা সেটাই দেখলাম। দেশের যেকোনো প্রান্তে বসে নেটে খুঁজলেই পাওয়া যায় এক গাদা রেসিপি ভিডিওসহ। সেই ভিডিও দেখে প্রয়োজনীয় উপকরণ এপাশ–ওপাশ করে দিয়ে রান্না করলেই ভোলার চরফ্যাশনে বসেও খেতে পারবেন ট্রাম্পের দেশের খাবার।

সেই সঙ্গে ঘরে বসেই খেতে পারবেন আপনার পছন্দের যেকোনো রেস্তোরাঁর যেকোনো খাবার। অন্তত আপনার মুঠোফোনে থাকা বিভিন্ন অ্যাপ আপনাকে সে সুযোগই করে দিয়েছে। ২০১৯ আমাদের শিখিয়েছে, জ্যামের শহরে চাইলেই আপনি আপনার প্রিয় খাবার খেতে পারেন ঘরে বসে আলস্য করতে করতে, পরিবারের সবার সঙ্গে কিংবা ইয়ার দোস্ত মিলে। তবে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, মানুষের রান্না করার প্রবণতাও বেড়েছে। অন্তত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি আপলোড করার জন্য হলেও মানুষ রান্না করছে। এটা খুবই ভালো দিক। কারণ, রান্না শেখা হলো ‘লাইফ স্কিল’ বাড়ানোর প্রথম পাঠ, যা আপনাকে বেঁচে থাকার ভিন্ন রকম আনন্দ দেবে।

সুস্থ থাকার জন্য যোগব্যায়ামে ঝুঁকছেন অনেকে। একটি আসনে যোগব্যায়াম প্রশিক্ষক আনিক রব্বানি
সুস্থ থাকার জন্য যোগব্যায়ামে ঝুঁকছেন অনেকে। একটি আসনে যোগব্যায়াম প্রশিক্ষক আনিক রব্বানি

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল
খাবারের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে স্বাস্থ্যসচেতনতা। তবে এ বিষয়ে দুটি কথা বলার আছে। স্বাস্থ্যসচেতনতা বলতে ‘ডায়েট’ করার প্রবণতা এসেছে আমাদের মধ্যে। কিছু হলেই আমরা ডায়েট করে ফেলছি। কেউ কিছু বললেই গুগল ঘেঁটে একটা প্রবন্ধ বা নিবন্ধ ধরিয়ে দিচ্ছি চ্যালেঞ্জকারীকে। ব্যাপারটি বুঝতে হবে ঠিকমতো। গুগল, উইকিপিডিয়া কিংবা বিভিন্ন ওয়েবসাইটে কিংবা ভিডিও প্ল্যাটফর্মে কনটেন্ট প্রকাশ করার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয় না। কাজেই কে কোথায় কোন ধরনের ডায়েটবিষয়ক কনটেন্ট প্রকাশ করেছেন, সে কনটেন্ট তৈরি করার সঠিক শিক্ষা তাঁর আছে কি নেই, সেটা যাচাই না করে তা নিয়ে লাফালাফি করাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ডায়েট করতে হলে অবশ্যই চিকিৎসক কিংবা ডায়েট পরামর্শকের কাছে যেতে হবে। 

দেশে–বিদেশে পরিবার নিয়ে বেড়ানোর হার বেড়েছে
দেশে–বিদেশে পরিবার নিয়ে বেড়ানোর হার বেড়েছে

অনলাইন কেনাকাটা বিদেশ থেকেও
এ বছর প্রবলভাবে বেড়েছে অনলাইনে কেনাকাটা করার প্রবণতা। দেশে তো বটেই, দেশের বাইরে থেকেও অনলাইনে কেনাকাটা করা যায় এখন। বলা চলে, এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটায় অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো দিয়েছে ব্যাপক সুযোগ। দিয়েছে হোম ডেলিভারির সুবিধা। ফলে সময় বেঁচেছে আমাদের। সামনের বছরগুলোতে অনলাইনে এ সেবা বাড়বে প্রচুর। 

চলাচলে অ্যাপনির্ভরতা
রাইড শেয়ারিং ঢাকা শহর শুধু নয়, চট্টগ্রামের মতো শহরেরও জীবনযাত্রায় বিরাট প্রভাব ফেলেছে। মোটরবাইক কিংবা কার এ দুটি বাহনই জ্যামের শহরে সময় বাঁচানোতে ভীষণ কার্যকরী হয়ে উঠেছে। সময় বাঁচানোর সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিংয়ের এই ব্যবস্থা আমাদের আরামও দিয়েছে নিঃসন্দেহে। বলে রাখা ভালো, যেকোনো যানবাহনের টিকিট কাটার জন্য অনলাইন সেবাও বিস্তৃত হয়েছে। ঘরে বসেই এখন কেটে ফেলা যায় বাস, লঞ্চ, ট্রেনের টিকিট। সামনের দিনগুলোতে সম্ভবত অনলাইন টিকিটিং ব্যবস্থা আমাদের জন্য স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে।

অনেকেই এখন ইউটিউবে রেিসপি দেখে রান্না করেন
অনেকেই এখন ইউটিউবে রেিসপি দেখে রান্না করেন

সমানতালে চলছে
আমাদের জীবনের সবকিছুই যে ভার্চ্যুয়াল জগতে ঘটছে, তা নয়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভুবনেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। বেড়েছে সাইক্লিং এবং বাইকিংয়ের প্রবণতা। নারী-পুরুষ–নির্বিশেষে প্রচুর মানুষ এখন সাইকেল এবং মোটরবাইক চালায় আমাদের চারপাশে। প্রতিটি এলাকায় জিমের সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। আরো বেড়েছে যোগব্যায়ামের চর্চা।

বেড়েছে রেস্টুরেন্টের সংখ্যাও। ২০১৮ সালের দিকে চেইন ওষুধের দোকান ছিল কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। ২০১৯ সালে সেগুলো পাড়ায় পাড়ায় ঢুকে গেছে। হোম ডেলিভারিসহ প্রায় সারা রাত পাওয়া যায় তাদের সেবা। দল বেঁধে কিংবা একা একা দেশে এবং বিদেশে ভ্রমণের প্রবণতা এসেছে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। আরেকটা বিশেষ পরিবর্তন এসেছে, কফির ঘ্রাণে কিংবা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বই পড়া। বেঙ্গল বই, বাতিঘর, কবিতা ক্যাফে, দীপনপুরসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে এসেছে এ সুযোগ। প্রচুর মানুষ এ সুবিধা নিচ্ছে। 

২০০০ সালের পর আমরা ব্যাপকভাবে প্রযুক্তিগত জীবনযাপনের দিকে ঝুঁকলেও গত এক দশকে আমাদের জীবনে প্রযুক্তি প্রভাব ফেলেছে অত্যন্ত দ্রুত। বিনোদন থেকে কেনাকাটা, খানা–খাদ্য থেকে স্বাস্থ্য, পরিধান থেকে পঠন—সবকিছুতেই প্রযুক্তি এগিয়ে এসেছে। ভোক্তাদের জন্য সামনের দিনগুলোতে কনটেন্ট এবং প্রোডাক্ট নিয়ে অপেক্ষা করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরবর্তী প্রজন্ম। ২০১৯ সালে তার মহড়া হয়ে গেছে আমাদের সঙ্গে নিয়েই। 

দলবেঁধে, পরিবারসহ বেড়ানোর প্রবণতা গত কয়েক বছরের ধারায় এবারও তুঙ্গে। তবে একা একা ঘোরা বা রোমাঞ্চকর অভিযানের হারও কম নয়। 

খুব চুপি চুপি আমাদের যাপনে প্রবেশ করেছে ৯৯৯ নম্বরটি নিরাপত্তা আর সেবার নিশ্চয়তা নিয়ে। শুভ ইঙ্গিত। যাপনে পরিবর্তন আসুক। শুভ নববর্ষ।