ফোয়া গ্রা: আজও মন কাড়ছে সাড়ে চার হাজার বছরের প্রাচীন খাবার

খাদ্য, বস্ত্র, উপহারে উৎসব হয় বর্ণিল, হৃদয়গ্রাহী। খ্রিষ্টীয় সমাজে উপহার বিনিময় এবং সুস্বাদু খাবার বড়দিনকেন্দ্রিক উৎসবের প্রধান দুটি অনুষঙ্গ। উৎসব ঘিরে বস্ত্র এবং উপহারের যে প্রচলন সেটা নয়, বরং আজ খাদ্যের কথা হোক। এই উৎসবে হরেক পদের খাবারের মধ্যে ইউরোপের দেশগুলোতে বিশেষ স্থান দখল করে আছে একটি খাবার, তার নাম ‘ফোয়া গ্রা’। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন, দামি ও সুস্বাদু এ খাবার বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতির বিলাসী খাদ্যসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে সুদীর্ঘকাল ধরে। শুধু বড়দিনেই নয়, যেকোনো উৎসবে খাবার টেবিলে ফোয়া গ্রা থাকবে না, তা ভাবতে পারে না অনেকেই। বড়দিন সামনে রেখে ছোট-বড় সব বিপণিতে চকলেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফোয়া গ্রা সমানতালে উপস্থিত থাকে। বছরের এ সময়টিতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় উৎসবের খাবারের অন্যতম অনুষঙ্গ এই ফোয়া গ্রা।

ফরাসিতে ফোয়া (Foie) মানে কলিজা বা যকৃৎ। আর গ্রা (Gras) অর্থ হচ্ছে ফ্যাট বা চর্বি। তাহলে ফোয়া গ্রার অর্থ দাঁড়াচ্ছে চর্বিযুক্ত মোটা কলিজা। মজার বিষয় হলো ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, জাপান ও চীনের ভোজনরসিকেরা নাম না বদলিয়ে ফরাসিদের দেওয়া নাম ‘ফোয়া গ্রা’ বহাল রেখেছে।

ফোয়া গ্রা আসলে অতিরিক্ত খাবার খাইয়ে মোটাতাজা করা হাঁসের কলিজা বা যকৃৎ। বাছাইকৃত প্রজাতির রাজহাঁস এবং সাধারণ পাতিহাঁসকে নিয়মিত আকণ্ঠ খাবার গিলিয়ে এসব প্রাণীর যকৃৎ কলেবরে বৃদ্ধি এবং চর্বি সমৃদ্ধ করা হয়। জোর করে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ানোর পরে ত্রাসের যকৃৎ স্বাভাবিক আকারের থেকে প্রায়ই দশ গুণ বড় হয়। ফোয়া গ্রা তৈরি করার জন্য পাতিহাঁস ও রাজহাঁসকে সাধারণত ভুট্টা খাওয়ানো হয়ে থাকে।

হাঁসের গলায় ফানেলের সাহায্যে নল লাগিয়ে জোর করে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। ছবি: লেখকের সংগ্রহ।
হাঁসের গলায় ফানেলের সাহায্যে নল লাগিয়ে জোর করে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। ছবি: লেখকের সংগ্রহ।

ইতিহাস
ফোয়া গ্রার উৎপত্তির ইতিহাস ঘাঁটলে আমাদের ফিরে যেতে হবে আনুমানিক সাড়ে চার হাজার বছর আগে। মিসরের নীল নদের অববাহিকায় বসবাসরত প্রাচীন মানুষেরা হাঁসকে ভালো করে খাইয়ে নাদুসনুদুস বানিয়ে বেশ মজা করে চর্বিসমৃদ্ধ যকৃৎ অর্থাৎ ফ্যাটি লিভার অন্য খাবারে মাখনের মতো লাগিয়ে খেতে অভ্যস্ত ছিল। প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের গল্প, কাহিনিতেও এমন খাবারের বর্ণনা পাওয়া যায়। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রজার কারাটিনির মতে, প্রাচীন সভ্যতায় সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রাণীদের উপাদেয় অঙ্গগুলোকে দেবতাদের জন্য উৎসর্গ করা হতো। এসব উপাদেয় অঙ্গের মধ্যে ‘ফোয়া’ অর্থাৎ যকৃৎ ছিল উল্লেখযোগ্য।

ফোয়া গ্রা ও ফ্রান্স
প্রাচীন মিসর, গ্রিক ও রোমানরা এমন মজাদার খাবারের সঙ্গে পরিচিত থাকলেও ফরাসিরা এ খাবারের উপাদান এবং রন্ধনশিল্পে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। এ কারণে ফোয়া গ্রা ফরাসি খাদ্যসংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষিত। সারা পৃথিবীতে এ খাবারের মোট উৎপাদন প্রায় ২৭ হাজার টন। এর মধ্যে সিংহভাগ অর্থাৎ তিন–চতুর্থাংশ ফোয়া গ্রা ফ্রান্সেই উৎপাদিত হয়। মোট উৎপাদিত ফোয়া গ্রার মাত্র এক–চতুর্থাংশ রপ্তানি করা হয়। সোজা কথায়, ফ্রান্স হচ্ছে ফোয়া গ্রার প্রধান উৎপাদক এবং ভোক্তা দেশ। ফরাসিদের পছন্দের তালিকায় এ খাবারের অবস্থান অনেক ওপরের দিকে। আর বড়দিন উপলক্ষে খাবার টেবিলে নিঃশেষ হয় মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ ফোয়া গ্রা।

হাইপার শপে বিক্রির অপেক্ষায় কাঁচা ফোয়া গ্রা। এর আলাদা আলাদা রন্ধন প্রণালি আছে। ছবি: লেখক।
হাইপার শপে বিক্রির অপেক্ষায় কাঁচা ফোয়া গ্রা। এর আলাদা আলাদা রন্ধন প্রণালি আছে। ছবি: লেখক।

প্রণালি
এটি তৈরি করা খুব একটা কঠিন নয়। তবে বেশ সতর্ক হতে হয় এর রান্নার ক্ষেত্রে। উজ্জ্বল বাদামি রঙের যকৃৎ থেকে যত্ন করে শিরা, উপশিরা ছাড়িয়ে পরিমাণমতো লবণ, ক্ষেত্র বিশেষে গোলমরিচ মিশিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে খাবারের উপযোগী করা হয়ে থাকে ফোয়া গ্রা। আধা সেদ্ধ করতে হলে একটি পাত্রে পানি নিয়ে ৮০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ১০ মিনিট আর পুরো সেদ্ধ করতে হলে একই তাপমাত্রায় ১৫ মিনিট ফোটাতে হবে। ফোয়া গ্রা পানিতে সরাসরি রাখা যাবে না। বিশেষ ধরনের কাগজের আস্তরণে বা কাপড়ে মুড়িয়ে পানিতে রাখতে হবে। তাপমাত্রা ও সময়ের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, একটু এদিক-ওদিক হয়ে গেলে সুস্বাদু এ খাবারের আসল স্বাদ হারিয়ে যাবে। ফোয়া গ্রা সুবাসিত করার জন্য যোগ করা হয় বিভিন্ন উপাদান। তারপরও এটি রান্নার আলাদা আলাদা পদ্ধতি আছে।

পরিবেশন
ফোয়া গ্রা পরিবেশনায় নান্দনিকতার ছোঁয়া সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সালাদে, বিভিন্ন খাবারের সঙ্গে অনেকভাবে পরিবেশন করা হয় এটি। তবে পরিবেশনের নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। সাধারণত তিনভাবে ফোয়া গ্রা প্রস্তুত করা হয়—কাঁচা বা ক্রুড, আধা সেদ্ধ এবং পুরো সেদ্ধ। কাঁচা ফোয়া গ্রা সরাসরি স্বল্প আঁচে ভেজে বিভিন্নভাবে পরিবেশন করা হয়। আধা সেদ্ধ ও সেদ্ধ ফোয়া গ্রা রুটির ওপর মাখনের মতো প্রলেপ মাখিয়ে পরিবেশন করা হয়। গোল গোল চাকা করে কেটে বিভিন্ন খাবারের সঙ্গেও পরিবেশন করা হয় এটি। তবে ফোয়া গ্রার সঙ্গে পেঁয়াজের ও ফিগের জ্যাম বেশ জনপ্রিয়। সঙ্গে অনেকেই পছন্দ করেন খানিকটা মিষ্টি স্বাদের হোয়াইট ওয়াইন।

খাবার টেবিলে পরিবেশিত ফোয়া গ্রা। ছবি: লেখক।
খাবার টেবিলে পরিবেশিত ফোয়া গ্রা। ছবি: লেখক।

মূল্য
ফোয়া গ্রার মূল্য নির্ভর করে অনেকটা উৎপাদনকারীর সুনামের ওপর। গ্রামে যাদের এটি উৎপাদনে সুনাম আছে, তাদের কাছ থেকে কিনলে দাম পড়বে প্রতি কেজি ৮০ থেকে ১৫০ ইউরো। বড় বড় দোকানে ৫০ থেকে ১০০ ইউরোর মধ্যে পাওয়া যাবে। তবে দক্ষিণ ফ্রান্সের নামকরা উৎপাদনকারী মশিয়েঁ ডমিনিক দু ত্রিউ-র ফোয়া গ্রা কিনতে হলে গুনতে হবে কেজিতে ৯৯০ ইউরো। গুণগত মান বজায় রাখতে তারা খামারে প্রতিবছর ৩০০ রাজহাঁস লালন পালন করেন এবং প্রাকৃতিক খাবার খাইয়ে রাজহাঁসগুলোকে অনেক যত্নে মোটাতাজা করে বড়দিন উপলক্ষে মাত্র ২০ কেজি ফোয়া গ্রা উৎপাদন করে থাকেন।

ফোয়া গ্রা। ছবি: সংগৃহীত
ফোয়া গ্রা। ছবি: সংগৃহীত

পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্য উপকারিতা
ফোয়া গ্রার প্রায় ৮৫ শতাংশ ক্যালরির উৎস হচ্ছে লিপিড। এই লিপিডের ৬০ শতাংশ হচ্ছে একক-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড আর ৩৩ শতাংশ হচ্ছে সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড। যেহেতু ফোয়া গ্রার লিপিড একক-অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ, তাই হৃদ্‌রোগীরা খাবার তালিকায় রাখলে স্বাস্থ্যের ওপর তা তেমন খারাপ প্রভাব ফেলবে না। অন্যদিকে আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, তা হলো ফোয়া গ্রাতে কোলেস্টেরলের পরিমাণ মোটেই কম নয়। তবে যে বিদগ্ধজনেরা কোলেস্টেরলের খবর রাখেন, তাঁদের কথা হলো, এমন কোনো প্রমাণ আজও পাওয়া যায়নি যে নিয়মিত ফোয়া গ্রা খাওয়ার ফলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়েছে। তাই কোলেস্টেরলের আধিক্যের অজুহাতে চমৎকার সুস্বাদু এ খাবারকে দূরে সরিয়ে রাখা ঠিক হবে না। তবে যেহেতু হাঁসের এমন যকৃৎকে মজাদার করতে কেজিপ্রতি ১২ গ্রাম খাবার লবণ ব্যবহার করা হয়, তাই উচ্চ রক্তচাপের অস্বস্তিকর চাপের মধ্যে যাঁরা আছেন, তাঁদের লবণবিহীন ফোয়া গ্রা খুঁজে নিতে হবে। খাদ্যবিলাসীদের কাছে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা আরও যেসব ভালো খবর দিচ্ছেন, তা হলো মোটাতাজা করা হাঁসের লিভারে প্রচুর ভিটামিন এ, বি ১২, ফসফরাস, সেলেনিয়াম ও আয়রন রয়েছে। তবে আধা সেদ্ধ, সেদ্ধ অর্থাৎ হালকা আঁচে খাবারের জন্য প্রস্তুত করা হয়, তাই ডাক্তাররা গর্ভবতী নারীদের খাবারটি না খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

নিষিদ্ধ
পশুপাখিপ্রেমীরা পাতিহাঁস ও রাজহাঁসকে জোর করে খাওয়ানো মোটেই পছন্দ করেন না। তাই এই প্রাণীদের এমন কষ্ট দিয়ে ফোয়া গ্রা উৎপাদনে জোর করে গেলানোর বিরুদ্ধে জোর আপত্তি জানান অনেকেই। সে জন্য আর্জেন্টিনা, ইসরায়েল, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড ও আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় এর উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। খোদ ফ্রান্সে অনেকেই ফোর্স ফিডিং বা জোর করে খাওয়ানো পছন্দ করছেন না। বিজ্ঞানীরা তাই বিকল্প পথ খুঁজছেন।

সে যা–ই হোক, ফ্রান্সে বেড়াতে এসে ফোয়া গ্রার মনমাতানো স্বাদ না নিলে খাদ্যসংস্কৃতির তীর্থ ভ্রমণ অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

লেখক: অণুজীববিজ্ঞানী এবং ফরাসি বিচার বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত।