লক্ষ্য ছুঁতে বাবার দেশে

অ্যান্টার্কটিকায় বরফরে রাজ্যে পেঙ্গুইনের সঙ্গে মেলিসা সুমিত্রা রায়। ছবি: সংগৃহীত
অ্যান্টার্কটিকায় বরফরে রাজ্যে পেঙ্গুইনের সঙ্গে মেলিসা সুমিত্রা রায়। ছবি: সংগৃহীত

সৈকতের বালুতে ইংরেজিতে লেখা ১৯৩। দুই হাতে লাল-সবুজ প্ল্যাকার্ড ধরে বঙ্গোপসাগরের দিকে মুখ করে দাঁড়ানো একজন মেয়ে। প্ল্যাকার্ডের মাঝখানে ছাপার হরফে ইংরেজিতে লেখা ‘কান্ট্রি # ১৯৩’। তখন গোধূলিবেলা। হোয়াটসঅ্যাপে কক্সবাজার থেকে ছবিটি এসেছিল ২ জানুয়ারি সন্ধ্যায়। এর আগেই জানি ১৯৩ সংখ্যার মাহাত্ম্য। 

সেই ছবির নারীর নাম মেলিসা সুমিত্রা রায়। মার্কিন নাগরিক পর্যটকের বয়স মাত্র ৩৪ বছর। এই বয়সেই মেলিসা ঘুরে ফেলেছেন ১৯৩টি দেশ। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রের সংখ্যাও ১৯৩। পর্যবেক্ষক আরও দুটি দেশেও ঘোরা আছে তাঁর। 

ঢাকার রিং রোডের ফুটপাতে মেলিসা। ছবি: খালেদ সরকার
ঢাকার রিং রোডের ফুটপাতে মেলিসা। ছবি: খালেদ সরকার

১৯২তম দেশ হিসেবে সৌদি আরব ঘোরা শেষে মা মিনতি রায়সহ মেলিসা বাংলাদেশে আসেন গত ২৭ ডিসেম্বর রাতে। ২৯ ডিসেম্বর সকালে তাঁদের সঙ্গে কথা হয় ঢাকার একটি রেস্তোরাঁয়। ‘বাংলাদেশ দিয়েই আমার ১৯৩টি দেশ ঘোরা শেষ হবে।’ আলাপের শুরুতেই বলেন মেলিসা। স্বাভাবিক প্রশ্ন, বাংলাদেশ দিয়ে শেষ কেন?

‘কোন দেশ এই ভ্রমণের শেষ গন্তব্য হবে, এ নিয়ে ভাবনা কম ছিল না। পরে বাংলাদেশকেই বেছে নিলাম। কারণ বাংলাদেশ আমার বাবার দেশ।’ মেলিসার প্রয়াত বাবা সুভাষ চন্দ্র রায়ের বাড়ি নেত্রকোনায়। পড়াশোনা করতে যান ভারতে। তারপর পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। মিনতি রায় দেন কিছু তথ্য—কলকাতার পত্রিকায় পাত্র-পাত্রী কলামে বিজ্ঞাপন দেন সুভাষ। তারপরই বিয়ে। সুভাষ-মিনতি দম্পতি চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ১৯৮৫ সালে জন্ম মেলিসার। 

নেত্রকোনায় মেলিসা গেছেন বাবার স্মৃতি কুড়াতে
নেত্রকোনায় মেলিসা গেছেন বাবার স্মৃতি কুড়াতে

২০০৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সফরে আর্জেন্টিনা যান মেলিসা রায়। এরপর ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু শিক্ষার্থী ১০০ দিন থাকেন একটা বড় জাহাজে। ‘এটা ছিল সমুদ্রপথে বিশ্বভ্রমণ। ১২টি দেশে আমরা নেমেছিলাম। এই অভিজ্ঞতা থেকে ঘোরার শখটা আর মাথা থেকে নামাতে পারিনি।’ বললেন মেলিসা। স্নাতক হওয়ার পর ইউরোপ ঘুরে ফেললেন ‘ব্যাকপ্যাক ট্যুর’ দিয়ে। মানে একটিমাত্র ব্যাগ নিয়ে কম খরচে দেশ-বিদেশ ঘোরা। 

২০১৪ সালে আবার শুরু হলো মেলিসার দেশ ঘোরা। এর আগে চাকরি-বাকরি করেছেন। টাকা জমিয়েছেন, লক্ষ্য সব দেশ ঘুরে ফেলা। ’১৪-তেই এলেন ভারতে। সেই ভ্রমণেই খবর এল, সুভাষ চন্দ্র সাহা আর নেই। মেলিসা আবার ফিরে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে। শোক কাটানোর পর আবার শুরু হলো মেলিসার দেশ ঘোরা। 

ইচ্ছা ছিল ৩০ বছর বয়সের আগেই শততম দেশে যাবেন। মেলিসা তা গিয়েছেনও। সে দেশটি ছিল শ্রীলঙ্কা। এত দেশ ঘুরছেন, টাকাপয়সার সংস্থান হয় কীভাবে? প্রশ্ন করার আগেই মেলিসা বলেন, ‘সব সময় বাজেট এয়ারলাইনসে যাতায়াত করি। থাকি একেবারে ন্যূনতম খরচে।’ মেলিসা থাকেন ক্যালিফোর্নিয়ায়, হলিউডে। সেখানে টিভি বিজ্ঞাপনের জন্য মডেলিং করেছেন। মাইক্রোসফট, ইনটেল, টি-মোবাইলের মতো কোম্পানির বিজ্ঞাপনে মডেল হয়েছেন। করেছেন চাকরিও। মডেলিং ও চাকরি থেকে পাওয়া অর্থ বিনিয়োগ করেছেন নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে। ফেসবুক, অ্যাপলের মতো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনেছেন। সেগুলোর লভ্যাংশ দিয়েই চলছে মেলিসার বিশ্বভ্রমণ। 

লক্ষ্য ছিল ১৯৩ দেশ ঘোরার। বাবার দেশে সেই লক্ষ্য ছুঁেলন মেলিসা।  ২ জানুয়ারি, কক্সবাজার
লক্ষ্য ছিল ১৯৩ দেশ ঘোরার। বাবার দেশে সেই লক্ষ্য ছুঁেলন মেলিসা। ২ জানুয়ারি, কক্সবাজার

মেলিসা একজন স্কুবা ডাইভার। প্যাসিফিক আইল্যান্ডের সাগরতলের এক বিশেষ ডাকঘরে নেমে চিঠি পোস্ট করেছিলেন মাকে। মায়ের ঠিকানায় সেটি পৌঁছেও ছিল। এমনই রোমাঞ্চকর সব অভিজ্ঞতা আছে তাঁর ঝুলিতে। ‘আমি বানজি জাম্প, স্কাই জাম্প করেছি। স্কিইং করি। অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে পেঙ্গুইনদের সঙ্গে খেলা করেছি। টোঙ্গার সাগরে তিমি মাছ আর দক্ষিণ আফ্রিকায় হাঙরের সঙ্গেও সাঁতার কেটেছি।’

কোথাও কোনো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন? ‘কোনো দেশেই কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। স্থানীয়রা সব সময় সহযোগিতা করে। আফগানিস্তানে যাওয়ার আগে অনেকে অনেক আশঙ্কার কথা শুনিয়েছিল, কিন্তু কাবুলে আমার জন্মদিনও উদ্​যাপন করা হয়।’

২৯ ডিসেম্বর দুপুরেই বাসে নেত্রকোনা রওনা দেন মেলিসা আর তাঁর মা। ‘সেখানে এখন আমাদের আর কোনো আত্মীয় থাকেন না। তবে বাবার বন্ধুরা আছেন। আমি বাবার স্মৃতি সংগ্রহ করতে এসেছি।’ দুই দিন নেত্রকোনা কাটিয়ে বছরের প্রথম দিন ছিলেন ঢাকায়। রাতেই আবার চেপে বসেন কক্সবাজারের বাসে। 

মেলিসা পুরো পৃথিবী ভ্রমণ শেষ করলেন বাবার ভিটেয়। জানালেন, এটাই তাঁর কাছে বড় এক প্রাপ্তি হয়ে রইল।

মা–বাবার সঙ্গে ছোটবেলায়
মা–বাবার সঙ্গে ছোটবেলায়