গত দশকের পোশাকধারা

পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কাপড়ের পোশাক জনপ্রিয়তা পেয়েছে গত দশকে। পোশাক: শাড়ি ক্লাব, মেকআপ: অরা বিউটি লাউঞ্জ, ছবি: কবির হোসেন
পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কাপড়ের পোশাক জনপ্রিয়তা পেয়েছে গত দশকে। পোশাক: শাড়ি ক্লাব, মেকআপ: অরা বিউটি লাউঞ্জ, ছবি: কবির হোসেন
>আমাদের বসবাস এখন ডিজিটাল সময়ে। গত ১০ বছরে আমাদের জীবনযাত্রায় ভিন্নতা এনে দিয়েছে নানা ধরনের তথ্য। প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের নানা দেশের চলতি ধারার খোঁজ আমরা খুব সহজেই পেয়ে যাচ্ছি। গ্রহণ করছি নানা দেশের ফ্যাশনকে। এই নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারা বজায় রেখেই গত দশকে (২০১০-১৯) ফ্যাশনে যোগ হয়েছে ভিন্নতা। লিখেছেন ফ্যাশন ডিজাইনার মাহিন খান। নকশার এই বিশেষ আয়োজনে মডেল হয়েছেন অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিম।
দশকজুড়ে গাউনে দেখা গেছে নানা নকশার কাজ ও কাট। অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিম নকশার এই বিশেষ আয়োজনে গত দশকের নানা ধরনের পোশাক উপস্থাপন করেছেন
দশকজুড়ে গাউনে দেখা গেছে নানা নকশার কাজ ও কাট। অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মিম নকশার এই বিশেষ আয়োজনে গত দশকের নানা ধরনের পোশাক উপস্থাপন করেছেন

গত এক দশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের পোশাকের বেশ কিছু ধারা দেশীয় ফ্যাশন জগতেও প্রতিফলিত হয়েছে। তরুণ-তরুণীরা পাশ্চাত্য ফ্যাশনের ধারাগুলো অনুসরণ করেছে। প্রযুক্তির পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব পোশাকশিল্পের প্রসারের মাধ্যমেও আমরা জানতে পেরেছি বিশ্বের চলতি ফ্যাশন–ধারা। জারা, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, গ্যাপের মতো বড় বড় পোশাকপ্রতিষ্ঠান আমাদের এখান থেকেই বানিয়ে নেয় তাদের পোশাক। একটু ভেবে দেখলে গত দশকে পুরো বিশ্বেই পাশ্চাত্য ঘরানার পোশাক জায়গা করে নিয়েছে। দৈনন্দিন কাজের সুবিধা এখানে কারণ হিসেবে বেশ বড় একটা ভূমিকা পালন করছে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার। আগে দেশের বাইরে গেলে সে দেশের বই, ম্যাগাজিন দেখে জানা যেত সেখানকার পোশাকের চলতি ধারা। ওই দেশের পোশাক কিনে নিয়ে এলে দেশের মাটিতে বসে তার নকশা অনুসরণ করা যেত। এখন ইতালির ফ্যাশন শোতে নতুন কাটের কোনো পোশাক আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনে যায় পুরো বিশ্ব। টি-শার্ট, পালাজ্জো, অফ শোল্ডার, কোল্ড শোল্ডার পোশাক, ক্যাজুয়াল ও আনুষ্ঠানিক গাউন, কেপ, জ্যাকেট-কোট, অসমান কাটের পোশাক, মম জিনস, বাইকার শর্টস, জগারস, নারীদের স্যুট প্রভৃতি পোশাক পাশ্চাত্যের ফ্যাশন–ধারায় নাম কুড়িয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ধারার ওপর আমাদের দেশীয় পোশাকের অঙ্গনেও কাজ হয়েছে অনেক।

পাশ্চাত্য ঘরানার পোশাকগুলো আমরা অনেকটাই নিজেদের মতো করে বানিয়ে নিয়ে পরে থাকি। এ কারণে ফিউশনধর্মী স্টাইল বেশ দেখা যায় এখানে। বাংলাদেশে ৯ মাস বেশ গরম থাকে। সুতির তৈরি পোশাকগুলো নিয়ে আসে আরাম। সুতির শাড়ি বা সুতির পোশাক বেশ ভিন্নতা নিয়ে পরছেন এখন সবাই। তৈরি হচ্ছে স্টাইলিশ লুক। শাড়ির সঙ্গে অনেকেই কোট কিংবা বেল্ট পরছেন। এতে করে দেশীয় পোশাকেই যোগ হয়ে যাচ্ছে নতুন চাহনি। গত এক দশকের এমন কিছু ধারাই তুলে ধরা হলো।

ক্রপ টপ

ফেলে আসা দশকে ভালোই জনপ্রিয় হয়েছে ক্রপ টপ। সাধারণত হাই ওয়েস্ট (কোমরের একটু ওপর থেকে পরা হয়) জিনস, স্কার্ট, লেহেঙ্গা, ঘাগরা, কলিদার স্কার্ট, ফ্লেয়ারড স্কার্ট দিয়ে ক্রপ টপগুলো পরা হয়েছে। দেখতে বেশ ফ্যাশনেবল লাগে।

হাই ওয়েস্ট প্যান্ট

ক্রপ টপের সঙ্গে হাই ওয়েস্ট জিনসও গত দশকের ফ্যাশন। বিভিন্ন রং ও নকশা তুলে ধরা হয়েছে প্যান্টে। হাই ওয়েস্ট প্যান্টের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে বেলবটম জিনস, ফ্লেয়ারড জিনস, ড্রেইন পাইপ জিনস, বেলবটম ক্লিপ জিনস। এই প্যান্টগুলোর ওপরের অংশের কাট অনেকটা হয়তো ছিল একই রকম। তবে নকশার খেলা দেখা গেছে নিচের অংশে। নানা রকম নকশার সঙ্গে বেল্টেও ছিল বৈচিত্র্য। যেমন, বো করা বেল্ট। গত দশকের আরেকটি প্যান্ট কিশোরী ও তরুণীদের পোশাকের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল—জেগিংস, যা লেগিংস ও জিনসের সংমিশ্রণ।

দশকের শেষ দিকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সিকোয়েন্সের ব্যবহার। পোশাক: এক্সট্যাসি
দশকের শেষ দিকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সিকোয়েন্সের ব্যবহার। পোশাক: এক্সট্যাসি

কোট-জ্যাকেটের স্টাইলে

যেহেতু আমরা পাশ্চাত্যের ফ্যাশন ও কাজের পোশাক (ফাংশনাল ক্লথিং) অনুসরণ করে থাকি, তাই অন্যান্য পোশাকের সঙ্গে যোগ হয়েছে জ্যাকেট ও কোট। এর মাধ্যমে পুরো লুকে ভিন্নতা চলে আসতে পারে। হাই কলার কিংবা বোলেরো জ্যাকেট, এমনকি ক্ল্যাসিক ল্যাপেলও। কিন্তু সত্তর দশকের স্টাইল অনুসরণ করে গেলবার মানুষ চওড়া কলারের জ্যাকেট পছন্দ করেছে। জ্যাকেট ও কোটে ছিল নানা ধরনের নকশা। জ্যাকেট বলতে সাধারণত খাটো মাপেরগুলোই ধরা হয়ে থাকে। সাধারণত সারা দিনের নানা কাজে জ্যাকেটটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, ক্যাজুয়াল লুক নিয়ে আসে। টেইলরড, বম্বার্ড, ক্যাজুয়াল কাট জনপ্রিয়তা পেয়েছে গত দশকে। কোটের কাট সাধারণত হয় লম্বা। এটি পোশাকের সঙ্গে পরলে লুকে আনুষ্ঠানিক ভাব চলে আসে।

ছিল পোশাকের সঙ্গে কটি পরার চল। কটি ও শাড়ি: শাড়ি ক্লাব
ছিল পোশাকের সঙ্গে কটি পরার চল। কটি ও শাড়ি: শাড়ি ক্লাব

কেপের সময়

গত দশ বছরে দেখা গেছে কেপ খুব জনপ্রিয়। আমি নিজেই বিভিন্ন ধরনের কেপ ব্যবহার করেছি ফ্যাশন শোতে। এটা বেশ ক্ল্যাসিক আউটার ওয়্যার (ধ্রুপদি ঘরানার)। তবে কেপ পরার চর্চা খুব আধুনিক নয়, শত বছর পুরোনো। বিশের দশকে কেপ পরার প্রচলন জনপ্রিয়তা পায়। ওই সময় মেয়েরা একটু খাটো, ঢিলা পোশাক পরার প্রচলন শুরু করেন। চিন্তা করে দেখলে ১৯২০ ও ২০২০ সালের মধ্যে পোশাকধারায় মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। গত ১০ বছরে আমরা দেখেছি, কেপ পরা হয়েছে প্রায় সব ধরনের পোশাকের সঙ্গেই। শাড়ি, কামিজ, টপ—বাদ যায়নি কিছুই। খাটো ও লম্বা দুই রকম কেপই পরেছে মানুষ। গত দুই-তিন বছরে লোমশ পাড়ঘেঁষা ও ফ্রিঞ্জের কেপের জনপ্রিয়তা ছিল সবচেয়ে বেশি। কেপের কাপড়ে ভিন্নতা দেখা গেছে। উল, অ্যাক্রিলিক, নিটের কেপগুলো ক্যাজুয়াল হিসেবে বেশ চলেছে। আবার অরগ্যাঞ্জা, সিল্ক, সাটিন, মসলিন, ভেলভেটের কেপগুলো মানিয়েছে সান্ধ্য দাওয়াতে। এগুলোর মধ্যে ভেলভেটের কেপ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই কেপের ওপর করা জারদৌসি, সিক্যুইন বা এমব্রয়ডারির কাজগুলোও ছিল নজরকাড়া।

কাঁধ কাটার চল

কোল্ড ও অফ শোল্ডার পোশাকের বেশ ভালোই চল দেখা গেছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেককেই শাড়ি বা লেহেঙ্গার সঙ্গে পরতে দেখা গেছে কোল্ড অথবা অফ শোল্ডারের ব্লাউজ। দেখতে খুব সুন্দর ও সহজ। একই সঙ্গে আবেদনময় ও অভিজাত। আবার প্রিন্সেস গাউন বা প্রিন্সেস কাটের পোশাকে এই ধরনের নকশা করা হয়েছে।

ব্লাউজে স্টাইলিশ

ব্লাউজের নকশায় কম নিরীক্ষা চলেনি। কোল্ড ও অফ শোল্ডার ব্লাউজের পাশাপাশি চলেছে পেছন খোলা ব্লাউজ, চোলি ব্লাউজ, জ্যাকেট ব্লাউজ। যাঁরা ফ্যাশন নিয়ে খুব নিরীক্ষা করেন, তাঁরাই আধুনিক কাটের ব্লাউজ ব্যবহার করেছেন। অনেকে ক্রপ টপকেও ব্লাউজ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। দশকজুড়েই এর নকশা নিয়ে বেশ গবেষণা চলেছে। ফলে দেখা গেছে নানা কাট ও নকশা।

র​্যাফেল নকশা

র​্যাফেল নকশার পোশাক গত দশকের অন্যতম জনপ্রিয় নকশা। র​্যাফেল দিয়ে সাজানো হয়েছিল শাল, স্কার্ফ, শাড়ি, আনস্টিচ পোশাক, কলার, হাতা, গলা, কাঁধে কিংবা পুরো কলার, টপ। অর্ধেক বা পুরো পোশাকেও ঘুরেছে এই নকশা। চওড়া ও চিকন—দুই ধরনের র​্যাফেলের বাহার দেখা গেছে পোশাকে।

পোশাকে উঁচু–নিচু কাট। পোশাক: আইরিসেস
পোশাকে উঁচু–নিচু কাট। পোশাক: আইরিসেস

অসমান কাটের পোশাক

সোজাসাপ্টা নয় বরং অমসৃণ বা অসমান (আনইভেন) কাটের পোশাকের চল ছিল বেশি। আঁকাবাঁকা কাটের পোশাকগুলো লম্বা ও খাটো—দুই রকমই ব্যবহার করা হয়েছে। যাঁদের উচ্চতা একটু বেশি, তাঁদের সহজেই মানিয়ে যায়। আবার যাঁরা একটু স্বাস্থ্যবান, তাঁদের সুন্দর করে ঢেকে রাখে। কাটগুলো এ রকম, যেন মনে হয় পোশাক ভেসে থাকে। কোথাও কাপড় বের হয়ে থাকে, কোথাও ঢুকে থাকে, কোথাও গোল হয়ে থাকে, কোথাও স্তরে স্তরে সাজানো থাকে। মজার বিষয় হচ্ছে অমসৃণ কাটের পোশাক কিন্তু থ্রিডি লুকও দেয়।

রঙিন দশক

গত দশ বছরে ঘুরেফিরে কিছু নির্দিষ্ট রঙের পোশাক প্রাধান্য পেয়েছে। ক্যান্ডি রং, শকিং গোলাপি বা কমলা রং খুব চলেছে। আবার আধিপত্য ছিল প্যাস্টেল রংগুলোর। চকলেট ও ছাই রং বা প্রাকৃতিক বিভিন্ন রঙের ভিন্ন ভিন্ন শেড দেখা গেছে পোশাকে। ঋতু অনুযায়ী বদলেছে পোশাকের রং। শীতে মেরুন, বার্গেন্ডি, লাল, এমারেল্ড সবুজের মতো ভারী রংগুলো খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গ্রীষ্মে খুব বেশি দেখা গেছে কমলা, হলুদ ও টিয়া সবুজ রং। ঠান্ডা রং হিসেবে নীলও পিছিয়ে ছিল না। চলেছে ফিরোজার নানা শেড।

পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পোশাক

বাংলাদেশ এখন পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কাপড় তৈরিতে মনোনিবেশ করেছে। কেননা সাধারণ মানুষ সচেতন হচ্ছে। তারা জানতে চাইছে তাদের পোশাক কোথা থেকে আসছে, কী দিয়ে এবং কীভাবে তৈরি হচ্ছে, কোনো গোষ্ঠীকে সহায়তা দিচ্ছে কি না, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে কি না। মোট কথা, এ ধরনের পোশাক তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এ ব্যাপারে অনেক ভাবছে। পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পোশাকের ফ্যাশন নতুন দশকের বিশ্ব ফ্যাশনে বেশ বড় ভূমিকা পালন করবে। বিশ্ব পরিবেশকে বাঁচাতেই এই উদ্যোগ। আবহাওয়া দূষিত হওয়ার ৭০ শতাংশ দোষ পড়ে পোশাক ব্যবসার ওপরেই। রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করে কাজ করতে হবে আমাদের। এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে গ্রামাঞ্চলের দক্ষ জনশক্তি। এই ধারায় ফ্যাশনে বিনিয়োগ করে আমরা আমাদের কারিগরদের জীবিকা নির্বাহেও অবদান রাখতে পারি।

লেখক: প্রেসিডেন্ট, ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ