মা-বাবাকেই তো শেখাতে হবে

গত বছর সায়েন্স প্রজেক্ট করার জন্য আমার বড় ছেলের বন্ধুরা বাসায় এল একদিন। একদল গলাভাঙা, হালকা গোঁফ ওঠা কিন্তু এখনো শিশুসুলভ কমনীয়তায় ভরা ১৩–১৪ বছরের আট–দশজন ছেলে। তাদের মায়েরাও এলেন। দৌড়াদৌড়ি করে তাঁদের পছন্দের রান্নাবান্না করলাম।

এর কিছুদিন পরে এক মায়ের সঙ্গে স্কুলে দেখা। তিনি ভীষণ উদ্বিগ্ন। কারণ, তাঁর ছেলেকে নাকি অন্য ছেলেরা বাজে কথা বলেছে। বুলি করেছে ভেবে প্রথমে মন খারাপ হলো। পরে উনি যা বললেন শুনে আমি হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

সারমর্ম হচ্ছে তাঁর ছেলেকে স্কুলের বন্ধুরা নারী–পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক নিয়ে বেশ কিছু বলেছে। তা–ও সায়েন্স ক্লাসের পর। আর কীভাবে নেটে পর্নো খুঁজে দেখা যায়, তা–ও মনে হয় শিখিয়েছে।

তিনি এসব বুঝতে পেরে স্কুলে জানিয়েছেন আর যে বন্ধুরা বলেছে, তাদের মা–বাবাদের জানিয়েছেন। বয়ঃসন্ধিতে গিয়ে যেকোনো মানুষের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আগ্রহ তৈরি হবে। ছেলেদের মেয়েদের প্রতি আর মেয়েদের ছেলেদের প্রতি। জীববিজ্ঞান বলে তাই স্বাভাবিক। লুকিয়ে নিষিদ্ধ বিষয় জানার চেষ্টা এ বয়সের বাচ্চারা করবেই। তা করতে গিয়ে তারা বেশির ভাগ ভীষণ ভুল কিছুই জানবে অথবা অনেক সময় ভুল জিনিসের প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরি হবে।

আমাদের সময়ে না ছিল ইন্টারনেট, না ছিল টিভি দেখার অবাধ সুযোগ। সিনেমায় চুমুর দৃশ্যে বা নায়ক–নায়িকার গাছের আড়ালে চলে যাওয়ার দৃশ্যে ফ্যানের দিকে তাকানো ছিল আমাদের ভাইবোনদের রেওয়াজ। শুরুর দিকে আমি দুই ভাইয়ের চোখে হাত দিয়ে রাখতাম। পরে তারা মনে করল, সে কেন একা মজা নিচ্ছে? তারা তখন দুহাত দিয়ে আমার চোখ ঢাকা শুরু করল। একটু বড় হওয়ার পর সবাই মিলে ফ্যানের সৌন্দর্য অবলোকন করার অলিখিত এক চুক্তি করে নিয়েছিলাম।

স্কুলে টিফিনের সময়ে পেকে যাওয়া বান্ধবীরা নিজেরা গোপন আলোচনা করত। আমার মতো অনেককে সেই আলোচনায় রাখা হতো না। ভীষণ মন খারাপ হতো ওরা আমাকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করায়। কড়া মা–বাবার কারণে আমার জানার আর কোনো উপায়ও ছিল না সেসব কিছু।

যাহোক, সেই ভাবি (ছেলের বন্ধুর মা) বলছিলেন, ছি ছি, এই বয়সে এরা এসব কীভাবে জানল! এদের মা–বাবাদের কি কোনো দায়িত্ববোধ নাই! কীভাবে এসব নিষিদ্ধ কারবার তাঁদের বাচ্চারা বুঝল! তিনি ওদের সঙ্গে তাঁর ছেলেকে আর মিশতে দেবেন না ইত্যাদি। আমি প্রমাদ গুনলাম। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর ছেলে আমার ছেলের খুব কাছের বন্ধু। আমি মনে মনে আশা করলাম যেন আমার ছেলের এখানে কোনো অবদান না থাকে। তাই কয়েকবার জিজ্ঞেসও করলাম আমার ছেলে কিছু বলেছে কি না। ভাবি ‘ক্লিন চিট’ দিয়ে দিলেন আমার ছেলেকে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

এরপর তিনি যা–ই বলছিলেন, তাতেই আমার বেশ হাসি পাচ্ছিল। কারণ, তার আগের বছর আমি ছেলেকে ডেকে মেয়েদের পিরিয়ড সম্পর্কে জানিয়েছি। বাচ্চা হওয়ার প্রসেস সম্পর্কেও হালকা ধারণা তাকে দেওয়া হয়েছে। তার বাবাকে ফোন করে বলেছি এ ব্যাপারে যেন ভালো করে বুঝিয়ে বলা হয় ছেলেকে। তার বাবা ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে ছেলেকে এসব বুঝিয়েছে। আর আমি ছেলেকে এরপর থেকে সব সময় বোঝানোর চেষ্টা করেছি নারী সে যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, তাকে সম্মান করতে হবে। হোক সে তার মেয়েবন্ধু, সহকর্মী, স্ত্রী, রাস্তার খেটে খাওয়া মজদুর বা বাসায় কাজের সহকারী। গায়ে হাত তোলা যাবে না বা বাজে কথা বলা যাবে না। ভীষণ রাগ হলেও সেটা গিলে খেয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু কোনোভাবে গায়ে হাত তোলা যাবে না। তাকে বিপদে দেখলে রক্ষা করতে হবে। স্কুলে কোনো মেয়ের পিরিয়ড হলে তাকে নিয়ে ফান করা যাবে না। এমন হলে তার কোনো বোন বা তার মাকে নিয়েও ছেলেরা হাসতে পারে। ছেলে মেনে চলার অঙ্গীকার করেছে। মেয়েদের সম্মান করার এই কথাগুলো আমি সপ্তাহে একবার হলেও তাকে মনে করিয়ে দিতাম।

অসম্মতিতে দৈহিক নির্যাতনের খবর পত্রিকায় দেখিয়ে তাকে বলেছি, এ ভীষণ অন্যায়। তাকে মাদকের ক্ষতিকর ও ভয়ংকর দিকগুলো জানানো আমার কর্তব্য মনে করেছি। যাতে কেউ তাকে ও পথে নিয়ে না যেতে পারে।

তো এসব সেই ভাবি জানলে তো অবিলম্বে আমার বাচ্চার বন্ধুত্ব শেষ! একজন ১৪ বছরের ছেলের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বা বৃদ্ধি সম্পর্কে একজন শিক্ষিত মায়ের এমন ধারণা আমাকে বেশ অবাকই করেছিল। তাঁকে আমি সেদিন এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারিনি। পরে অনেকবার মনে হয়েছে তাঁকে যদি বুঝিয়ে বলতে পারতাম তবে তিনি হয়তো এত কষ্ট পেতেন না। তাঁর ছেলেরও এ ব্যাপারে এত অন্যায় কৌতূহল থাকত না। ক্লাসের ‘দুষ্ট’ সহপাঠীদের কাছ থেকে এগুলো জানার চেষ্টাও হয়তো থাকত না। হয়তো এভাবে ভুল কিছু জানার সুযোগ কমে যেত।

সবকিছু নিয়ে প্রথম আলোচনা তাই পরিবার থেকেই শুরু হওয়া উচিত। পরে তা স্কুলে শেখানো দরকার। স্কুলের পাঠ্যবইয়ে নারী–পুরুষের সম্পর্ক এবং নারীদের কীভাবে সম্মান করাতে হয় তা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। প্রযুক্তির এই যুগে কোনোভাবেই আমরা বাচ্চাদের এর খারাপ দিক থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারব না। তাদের যদি সঠিক শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে তারা সহজে বেছে নিতে পারবে কী গ্রহণ করা উচিত আর কী উচিত নয়। ভুল কিছু জানার আগে তাদের প্রাথমিক ধারণা বাড়ি থেকেই দেওয়া উচিত। তাহলে হয়তো আমাদের মেয়েরাও কিছুটা নিরাপদে বেড়ে উঠতে পারবে আর তাদের রাস্তায় চলার ভয়ও কিছুটা কমে যাবে। হ্যাপি প্যারেন্টিং।