বেদনাহীন প্রসব

সন্তানের মুখ দেখার আনন্দ আকাঙ্ক্ষিত এক অনুভূতি। মডেল: পূর্ণ, ছবি: অধুনা
সন্তানের মুখ দেখার আনন্দ আকাঙ্ক্ষিত এক অনুভূতি। মডেল: পূর্ণ, ছবি: অধুনা

প্রতীক্ষায় নতুন মা, নতুন বাবা। সন্তানের মুখ দেখার পরমানন্দ বহু আকাঙ্ক্ষিত এক অনুভূতি। পৃথিবীর আলোয় সেই কাঙ্ক্ষিত মুখটা দেখার আগের সময়গুলো কেমন যায়, তা সবচেয়ে ভালো জানেন একজন মা। গর্ভে বড় হতে থাকা সন্তান আর নিজের শারীরিক পরিবর্তন—মা হওয়ার জন্য কত-না আত্মত্যাগ। মা হওয়ার পরেও জীবনভর সন্তানের মঙ্গলের জন্য কষ্ট করেন। আর সন্তান জন্মদানের সময়টা? নাড়িছেঁড়া ধন পৃথিবীর আলোয় আসার মুহূর্তটাকে মায়ের জায়গা থেকে উপলব্ধি করার চেষ্টাটুকুও কেউ যদি করেন, অশ্রু ধরে রাখা তাঁর পক্ষে কঠিন হবে।

তীব্র ব্যথা আর সন্তানকে নিয়ে নানান দোলাচল, শরীর ও মনের এক নিদারুণ সংকটময় পরিস্থিতি। সন্তানের কল্যাণচিন্তায় মা নিমগ্ন থাকবেনই, তা সে নাড়ির সঙ্গেই জুড়ে থাক, আর বিদেশ-বিভুঁইয়েই থাক। এই চিন্তা মুক্তির তো আর ‘সমাধান’ নেই। তবে প্রসববেদনা থেকে মাকে বাঁচানোর উপায় আছে।

রাজধানীর ইমপালস হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহীর আল-আমিন বলেন, ‘প্রসবযন্ত্রণা উপশমে বছরের পর বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে এ পৃথিবীতে। বহু চেষ্টার পর বিশেষ এক পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছে। উন্নত বিশ্বে একজন নারী মা হতে গেলে সাধারণত এ পদ্ধতিতেই মা হয়ে থাকেন। প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে না বলে এ পদ্ধতি ঝুঁকিমুক্ত।’ ইমপালস হাসপাতালে এই ‘পেইনলেস ডেলিভারি’ সেবা প্রদানের সার্বিক পরিকল্পনা তাঁরই। সেখানে ২৪ ঘণ্টা এই সেবা প্রদান করা হয় এবং সেবার মান অক্ষুণ্ন রাখতে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও তাঁদের দল সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকেন।

দ্য আমেরিকান গাইনিকোলজিক্যাল অ্যান্ড অবসটেট্রিক্যাল সোসাইটির ভাষ্যমতে, আধুনিক যুগে প্রসবের বেদনা মায়েদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাহলে বাংলাদেশে মায়েরা কেন এই যন্ত্রণায় ভুগবেন? এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরিতে সাধারণ মানুষ ও সরকারকে পাশে চান জাহীর আল-আমিন।

কী সেই উপায়?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নার্গিস আক্তার জানালেন, প্রসবের সময় যখন জরায়ুমুখ খুলতে থাকে, তখন পিঠে ওষুধ প্রয়োগ করার মাধ্যমে প্রসবকে ব্যথামুক্ত করা হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করতে গেলে যেভাবে অবশ করার ওষুধ দেওয়া হয়, প্রক্রিয়াটি অনেকটা সে রকম। তবে অস্ত্রোপচার করতে গেলে যেমন শরীরের নিচের অংশ অবশ করা হয়, এ ক্ষেত্রে এ রকম হয় না। এ প্রক্রিয়ায় শুধু জরায়ুর নির্দিষ্ট স্নায়ুর ওপর প্রভাব পড়ে, ফলে মা ব্যথা অনুভব করেন না; সন্তান জন্মের আগ পর্যন্ত মা অনায়াসেই চলাফেরা করতে পারেন।

কেন বেছে নেবেন?

ব্যথার ভয়ে অস্ত্রোপচার করানো কোনো সমাধান নয়। অস্ত্রোপচারের সময়ের এবং অস্ত্রোপচার পরবর্তী ঝক্কি ও কষ্টের কথা ভুলে গেলে চলবে না। অস্ত্রোপচারের পরে ব্যথা হতে পারে। অস্ত্রোপচারের স্থানে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে সেলাইয়ের স্থান ফেটেও যেতে পারে। অস্ত্রোপচার মানেই প্রাকৃতিক নিয়মের অদলবদল (যা শুধু গুটিকয়েক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়)। তাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বেছে নেওয়ার বিপক্ষে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।

কার জন্য?

যে মায়ের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের কোনো প্রয়োজন নেই, যার অন্য কোনো জটিলতা নেই, অর্থাৎ যিনি স্বাভাবিক প্রসব বা নরমাল ডেলিভারির উপযুক্ত, তিনিই এ পদ্ধতিতে সন্তান প্রসব করাতে পারেন। উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিস থাকলেই যে অস্ত্রোপচার লাগবে, এমন ধারণাও ঠিক নয়।

কার জন্য নয়?

যিনি কোনো সমস্যার কারণে স্বাভাবিক প্রসব করাতে অসুবিধায় পড়তে পারেন বলে বোঝা যায় (যেমন জন্মের পূর্বে সন্তানের অবস্থান অস্বাভাবিক হওয়া, আগে দুজন সন্তান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া, গর্ভফুলের অবস্থান স্বাভাবিক প্রসবের উপযোগী না হওয়া, গর্ভের সন্তানের সার্বিক পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি প্রভৃতি), তাঁর জন্য স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা করা যায় না। তাই ব্যথামুক্ত প্রসবের এ পদ্ধতিও তাঁর জন্য নয়।

ক্ষতি হবে না তো?

ব্যথামুক্ত প্রসব মা ও শিশুর জন্য নিরাপদ। কেউ কেউ ধারণা করতে পারেন, প্রসবের সময় মা ব্যথা টের না পেলে নির্দিষ্ট সময়ে নিজে থেকে চাপ প্রয়োগ করতে পারেন না (তাতে সন্তান জরায়ুমুখে দীর্ঘ সময় আটকে থাকতে পারে)। এমন ধারণা ভিত্তিহীন। সন্তান জন্ম নিতে সামান্য দেরি হলেও তা সন্তানের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। কেউ কেউ মনে করেন, ব্যথামুক্ত প্রসব পদ্ধতির কারণে পরে কোমরে ব্যথা হয়। এটাও ঠিক নয়, গর্ভাবস্থায় শরীরের বাড়তি ওজন বহনের কারণে কোমর বেঁকিয়ে রাখতে হয়। ফলে ব্যথা হতে পারে, যা ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে নিরাময় সম্ভব।