সন্তানের বন্ধু হোন

শহর ও গ্রাম—দুই জায়গাতেই মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের মানসিক দূরত্ব বাড়ছে। তবে এই দূরত্ব শহুরে জীবনে প্রবল। কারণও অনেক। এখনকার সময়ে প্রথম ও প্রধান কারণ, মুঠোফোন ও ইন্টারনেট-নির্ভরতা। একটা বড় সময় ধরে এখন সন্তানেরা এই মাধ্যমে থাকে। ফলে যখন আমরা সচেতন হই, তখন বড্ড দেরি হয়ে যায়। যে কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

সন্তানের হাতে প্রথম মুঠোফোন তুলে দেওয়ার কাজটা কিন্তু আমরা মা-বাবারাই করে থাকি। তারপর যখন আমাদের টনক নড়ে, তত দিনে সন্তান বেপরোয়া হয়ে যায়। মা–বাবার অবাধ্য হয়ে সন্তানের জীবনে শুরু হয় মানসিক টানাপোড়েন।

নগরজীবনে অতি ব্যস্ত মা–বাবা ভুলো মনেই সন্তানের ওপর নানা মানসিক চাপ তৈরি করতে থাকি। লক্ষ্য একটাই, পরীক্ষায় ভালো ফল করানো। আমরা ভুলে যাই আমাদের সন্তানকে একজন মানবিক মানুষ হিসেবে তৈরি করার কথা। আমরা ভুলে যাই তাকে একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে, একজন আত্মনির্ভরশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কথা। শিশুদের ওপর শুধু বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আমাদের সুবিধা অনুযায়ী তাদের ছুটতে বাধ্য করি। আর কী চমৎকারভাবে ভুলে যাই আমাদের দায়িত্বগুলো।

মা-বাবা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব তাদের অনুকূল পরিবেশ দেওয়া। প্রথমত বাড়িতে যা সম্পূর্ণ আমাদের এখতিয়ারের মধ্যে। কিন্তু অনেক শিশুকে দেখি বাড়ি যেন তার কাছে সবচেয়ে ভয়ের জায়গা। বাড়ি মানে শুধু পড়ার টেবিল–চেয়ার, নির্দিষ্ট সময়ে খাবারের থালা, তারপর আবার টেবিল–চেয়ার। অনেকেই বাসায় অতিথি এলে বিরক্ত হন। শিশুকে ডাকেন না পড়ায় ব্যাঘাত ঘটবে বলে। কেউ কেউ আবার সন্তানের পরীক্ষার সময়ে অতিথিকে না বলে দেন কয়েক মাসের জন্য। একই ভাবে আমরা সময়ের অভাবে আমাদের সন্তানদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাই না, যার ফলে আমাদের সন্তানেরা তাদের আত্মীয়–পরিজনদের অনেককেই চেনে না। কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না তাদের সঙ্গে। ফলে আসলে তারা একা হয়ে যায় এবং সেই একাকিত্ব কাটানোর জন্যও তারা অনলাইননির্ভর হয়। অনেক সময় খারাপ বন্ধুদের সাহচর্যে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। কোনো কোনো মা–বাবাকে দেখেছি কাজের কথা, হুকুম করা, উপদেশ দেওয়ার বাইরে সন্তানের সঙ্গে সহজভাবে কোনো কথাই বলেন না। সন্তানের সঙ্গে খেলাধুলা করেন না, তাদের সঙ্গে মানসিক সম্পর্ক তৈরি করেন না।

আমরা বলি, এই সময়ের সন্তানেরা মা-বাবার দায়িত্ব নিতে চান না। কিন্তু একটু ভেবে দেখা দরকার, কেন তাঁরা দায়িত্ব নিতে চান না। সামাজিক দায়িত্ববোধের অভাব রয়েছে, সেটা আমরা হরহামেশাই বলছি। কিন্তু সেই ঘাটতি মেটাতে কাজ করছি কি? তাদের পরিপূর্ণ শৈশব নিশ্চিত হচ্ছে কি? আসুন একটু ভেবে দেখি। সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাই, তার বন্ধু হই, যাতে যেকোনো সংকটে সে পরিবারকেই সবচেয়ে আপন ভাবে।

লেখক: দুরন্ত টেলিভিশনের ব্যবস্থাপক (গবেষণা)