পাখির ঐকতানে পর্দা নেমেছে দ্বিতীয় আসরের

ভারতের গুজরাটের ফ্যাশন ডিজাইনার আসিফ শেখের নকশা পাখির ঐকতানে পর্দা নেমেছে ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০২০-এর। গতকাল শনিবার রাতে সূচিকর্মের চূড়ান্ত মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন এই তরুণ ডিজাইনার। হাতে বোনা সিল্ক কাপড়ের ওপর সুঁইয়ের কাজ সৌন্দর্যের মুগ্ধতা ছড়িয়েছে।

বাংলাদেশে উপস্থাপিত আসিফের এই কাজ আসলে ভারতের ধ্রুপদি সূচিকর্ম আর সূচিশিল্পীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ। এই সংগ্রহ নিয়ে তিনি দেশে-বিদেশে গেছেন। ভবিষ্যতে এটা স্থায়ীভাবে জাদুঘরে স্থান পাবে বলে জানালেন। এই সংগ্রহের জন্য কাপড় বোনা থেকে শুরু করে সূচিকর্ম, সব মিলিয়ে ৫০ হাজার ঘণ্টার বিশাল কর্মযজ্ঞ। অসাধ্যসাধন করে তিনি যা বানিয়েছেন, তা জমিনজুড়ে নিশ্চিত করেছে কেবল পাখির উপস্থিতি। আর কিছু নয়। প্রতিটি পাখি তিনি নিজে এঁকেছেন। আর কোনো মোটিফ নয়, শুধু পাখি কেন?—এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, ‘পাখিদের কোনো সীমান্ত থাকে না। তারা মুক্ত। বিশ্বের লোকজ শিল্প, কারুশিল্পও তাই। এখানে কোনো বাধার প্রাচীর থাকতে পারে না।’ সব মিলিয়ে কাপড়ের ক্যানভাসে আসিফের পাখি কেবল মোটিফ নয়, শুভবুদ্ধির বার্তাবাহক।

ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকের তৃতীয় দিনের আসর শুরু হয় ট্রেসেমে কিউ দিয়ে। এরপর বাংলাদেশ, ভারত ও ভুটান মিলিয়ে মোট ১০ জন ডিজাইনার তাদের সংগ্রহ উপস্থাপন করেন। সমাপনী দিনে ছিল গ্র্যান্ড ফিনালে কিউ। তিন দিনের তিনজন ডিজাইনারের সংগ্রহ আবার দেখানো হয়।

ট্রেসেমে কিউতে গতকালও অভিনেত্রী আফসানা মিমির উচ্চারণের ছন্দে হাঁটেন ৯ জন বিভিন্ন পেশার নারী। প্রতিদিনের বিষয়ের ওপর নির্ভর করেই স্ক্রিপ্ট করা হয়েছে। এই দিনের বিষয় ছিল ভ্যাকেশন বা ছুটি। দেশের অগ্রগণ্য সৌন্দর্যবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খানের রূপ ও কেশসজ্জায় মঞ্চে হেঁটেছেন সংগীতশিল্পী জেফার, ফুটবলার মৌসুমী, অভিনয়শিল্পী ও উপস্থাপক নাবিলা, সংবাদপাঠক তরি, পাইলট মালিহা, নৃত্যশিল্পী হৃদি শেখ, অভিনয়শিল্পী সুনেহরা ও চিকিৎসক তানজিনা ইয়াসমিন। আগের দুই দিনও ছিলেন তাঁরাই, তবে পৃথক থিমে।

অনুষ্ঠান শেষে কানিজ আলমাস খান বলেন, ‘পেশাদার নারীদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ নিয়মিতই হয়ে থাকে। তবে এবারের অভিজ্ঞতা একেবারেই আলাদা। প্রত্যেকেই চমৎকারভাবে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছেন। আমার বিষয় যেহেতু ছিল ছুটি, তাই সেভাবেই আমি তাদের লুক তৈরি করার চেষ্টা করেছি।’ ছুটি কাটাতে গেলে নারীরা এই লুক নিতে পারেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

আগের দুই দিনের মতো এদিনও ট্রেসেমের কিউর পরই শুরু হয় ফ্যাশন কিউ। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কাগজ কাটা শিল্পের থিমে নিজের সংগ্রহ উপস্থাপন করেন লিপি খন্দকার। সাদা আর অফ হোয়াইট কাপড়েই তিনি কাজ করেছেন। কাগজ কাটা শিল্প বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় কারুশিল্প। এক সময় প্রচুর দেখা গেলেও এখন টিকে আছে খুব সামান্যই। এর মধ্যে মণিপুরী সম্প্রদায় তাদের নানা আচার-অনুষ্ঠানে স্বল্প পরিসরে এটি ব্যবহার করে থাকে। পোশাকে সেই ফরম ফুটিয়ে তোলার জন্য জমিন অলংকরণের মাধ্যম হিসেবে লিপি বেছে নেন অ্যাপলিককে। বললেন, এই বিষয় নিয়ে যথেষ্ট খোঁজখবর করতে হয়েছে। আর সাদাকেই তিনি মনে করেছেন সংগ্রহের জন্য সেরা রং।

দ্বিতীয় ডিজাইনার হিসেবে আসেন কুহু। তাঁর বিষয় ছিল সুন্দরবন। বলা যায়, প্রায় দুই যুগ পর একই থিমে কাজ করলেন তিনি। ১৯৯৭ সালে তিনি সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে কাজ করেছিলেন। সেই সৃজনে ছিল সুন্দরবনের বাঘ বাঁচানোর দাবি। এবারও তিনি সেটাই করলেন। আগের বারের সঙ্গে এবারের তফাত হলো, সেবার ছিল কেবল বাঘ। আর এবার আদ্যন্ত সুন্দরবন।

শখের হাঁড়ির রং আর মোটিফের সৌন্দর্যকে পোশাকের জমিনে তুলে ধরেন চন্দনা দেওয়ান। তিন বাংলাদেশির ডিজাইনারের পর আসেন ভারতের অলকা শর্মা। তিনি সাগরের বহমানতাকেই প্রাধান্য দেন। সাগরের অণুজীব তাঁর নকশার অনুষঙ্গ। আধুনিক আর মুঘল ঘরানার পোশাকে সূচিকর্মে মূর্ত করেছেন নানা মোটিফ। দিল্লির এই ডিজাইনারের রয়েছে ইতিহাস-অনুরাগ। ফলে তাঁর সংগ্রহে সেটাই স্পষ্ট ছিল।

সারা করিম জামদানি আর রিফাত রেজা রাকা কাগজ কাটা শিল্প থিমে তাদের পোশাক সংগ্রহ উপস্থাপন করেন। এরপর ক্যাটওয়াকে নিজের সংগ্রহ তুলে ধরেন ভুটানের চন্দ্রিকা তামাং। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য মিলিয়েই ছিল তাঁর পোশাক। দেশীয় সূচিশিল্প আর বুননকে তিনি আধুনিক পোশাকে সন্নিবেশের চেষ্টা করেছেন।

কাঠের নকশায় অনুপ্রাণিত হওয়ার স্পষ্ট ছাপ ছিল ফারাহ দিবার সৃষ্টিতে। আর ফায়জা আহমেদ উপজীব্য করেছেন বিলুপ্তির পথে থাকা মৃৎশিল্পের ধারা টেপা পুতুলকে। একই সঙ্গে তিনি চেষ্টা করেছেন প্রকৃতি সংরক্ষণের বার্তা দেওয়ার।

সমাপনী সন্ধ্যার নিয়মিত আয়োজন শেষে ছিল গ্র্যান্ড ফিনালে। তিনজন ডিজাইনার মাহিন খান, ফায়জা আহমেদ ও আসিফ শেখের পোশাক সংগ্রহ দেখানো হয়। আর এর মধ্যে দিয়েই পর্দা নামে ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকের দ্বিতীয় আসরের।