বাঁচার আনন্দে বাঁচি

ক্যানসার জয় করেছেন, আবার আক্রান্ত হয়েছেন, দুরারোগ্য ব্যাধিকে আবারও হারিয়ে হাসি মুখে মডেলিং করে যাচ্ছেন ফওজিয়া আফরিন। ছবি: সুমন ইউসুফ
ক্যানসার জয় করেছেন, আবার আক্রান্ত হয়েছেন, দুরারোগ্য ব্যাধিকে আবারও হারিয়ে হাসি মুখে মডেলিং করে যাচ্ছেন ফওজিয়া আফরিন। ছবি: সুমন ইউসুফ
>মডেল ফওজিয়া আফরিন। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা প্যানটিন ইউ গট দ্য লুক–২০০১–এ হয়েছিলেন সেরা। ১৯৯৯ সালে রানারআপ হয়েছিলেন লাক্স–আনন্দধারা মিস ফটোজেনিক প্রতিযোগিতায়। বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেছেন মডেল হিসেবে। ছন্দময় সেই জীবনেই আচমকা হাজির হয় ক্যানসার। জীবনে ছন্দপতনের সুর যখন বাজছিল, তখন তা সামলে নিয়েছেন হাসিমুখে, মনের জোরে। ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যানসার দিবস। ক্যানসারজয়ী ফওজিয়া আফরিনের কথা থাকছে এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে। 

শেষ বিকেলের লালচে রোদ পাতার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল। ধুলোমলিন সবুজ পাতার ফাঁক গলে তারই কিছুটা এসে ঠিকরে পড়ছিল ফওজিয়া আফরিনের মুখে। ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো ফওজিয়া আলোকচিত্রীর নির্দেশনায় হাসছিলেন, সেই হাসিতেও যেন ভেসে উঠছিল প্রাণের স্পন্দন। 

পরিচিত মানুষের কাছে সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষ তিনি। এই যে সাতটি বছর ধরে ক্যানসারের সঙ্গে লড়ে গেলেন। প্রতিনিয়ত ফেরা না–ফেরার দোলাচল মনের কোণে তাঁর, নতুন নতুন উপসর্গে শরীরে তাঁর অসুস্থতা বাড়ে, ভোগায় সময়ে-অসময়ে, তবু মন খারাপের বাক্সটা বন্ধ করে তিনি হাসেন। উচ্ছলতায় ভরিয়ে রাখেন পাশের মানুষদের।

হাসিই কি এই প্রাণশক্তি? 

ক্যামেরার সামনে এগিয়ে এসে নিজের সদ্য তোলা ছবিটা দেখতে দেখতে ফওজিয়া বলেন, ‘অসুস্থতা, কষ্ট বা মন খারাপ আমি প্রকাশ করি না। এ তো একান্তই আমার।’

তিনি যে অসুস্থতা আর কষ্টকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারেন, সেটুকু অবশ্য তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে বোঝা গেছে। পুরো টাইমলাইনে দেখা মেলে আনন্দে ভরপুর একজন ফওজিয়াকে। ক্যানসারের মতো ব্যাধিকে তিনি যে বয়ে বেড়াচ্ছেন দীর্ঘদিন, তার ছিটেফোঁটা নেই ছবিতে, স্ট্যাটাসে। ফওজিয়া বলেন, ‘কষ্টের কথা, অসুস্থতার কথা প্রচার করে কী হবে। আমি তো বাঁচার আনন্দে বাঁচি। আমি তো রাঙা সকাল দেখেও মুগ্ধ হই, সবুজ গাছের দিকে তাকিয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারি।’ 

ফওজিয়ার কথায় যেন শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী পার্কের বৃক্ষরাজি হেসে ওঠে, আহ্লাদে, স্তুতিতে। রাজধানীর গুলশানের এই পার্কেই ২৬ জানুয়ারি ছবি তোলার ফাঁকে আমাদের কথা এগোয়, পার্কের আটপৌরে বেঞ্চে বসে, কখনো হাঁটতে হাঁটতে। শুনি ক্যানসার জয়ের কথা।

আনন্দ নিয়েই জীবনকে উদ্‌যাপন করেন ফওজিয়া
আনন্দ নিয়েই জীবনকে উদ্‌যাপন করেন ফওজিয়া

হঠাৎ জ্বর

ফওজিয়া আফরিনের পরিবারের ওপর যেন আচমকা ঝড় নেমে এল ২০১৩ সালে। বাবা মীর আলতাফ আলী অসুস্থ হয়ে পড়লেন, টানা কয়েক মাস তাঁকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হলো। বাবার পাশে নিয়ম করে থাকেন ফওজিয়াসহ তাঁর মা আর ভাই। এমনই একদিন হুট করে জ্বর এল ফওজিয়ার। শরীরে প্রচণ্ড তাপ। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন। রক্তের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলল। জ্বর থামল কিন্তু অসুস্থতা কমল না।

ফুসফুসে সংক্রমণ আছে জানিয়ে চিকিৎসক বললেন এক্স-রে, এমআরআই, সিটি স্ক্যান করার জন্য। তারপর চিকিৎসক কিছু হয়তো আঁচ করতে পারলেন। তাই পরামর্শ এল ম্যামোগ্রাম (বিশেষ ধরনের এক্স-রে। যার সাহায্যে স্তনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন ধরা পড়ে) করার। ম্যামোগ্রামে শনাক্ত হলো স্তন ক্যানসার, আছে তা দ্বিতীয় ধাপে। 

ফওজিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। দ্রুত ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু করার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক। এদিকে প্রিয় বাবাকে হারিয়েছেন কিছুদিন আগেই। ‘কিছুটা দমে গিয়েছিলাম। বাবাকে খুব ভালোবাসতাম। শোকের সময়ে এমন সংবাদ সত্যিই কষ্টের।’ বললেন ফওজিয়া।

সেই শোক সঙ্গী করেই শুরু হলো তাঁর চিকিৎসা। দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নিলেন। কেমোথেরাপি দেওয়া হলো। দুঃসহ সেই দিনগুলো এখনো তাড়া করে ফওজিয়াকে, ‘পানিও হজম করতে পারতাম না। দেখা যাচ্ছে অনবরত বমি করে যাচ্ছি। কী ভয়ংকর সে সময়। তখন কাউকে সহ্য করতে পারতাম না।’ 

সে সময় একটু সুস্থ হলেই আবার যেন চিরচেনা ফওজিয়া হয়ে যেতেন। বেরিয়ে পড়তেন তেহারি ঘরের তেহারি কিংবা প্রিয় কোনো খাবার খেতে। সেই মুহূর্তেই যেন দুনিয়ার সবকিছু করা চাই তাঁর। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন কিংবা বাড়ির পাশেই নৌকায় ভেসেছেন হাতিরঝিলের জলে। ফওজিয়া বলেন, ‘আমি তত দিনে সত্যকে মেনে নিয়েছি। মেনে নিয়েছি বলেই অসুস্থতাকে আর পাত্তা দিতে চাইতাম না। মনে মনে বলতাম, কী হবে অসুস্থতা নিয়ে ভেবে।’

তাই নিজের কাজটুকু নিয়ম মেনে করতেন। বাসায় বই পড়তেন কিংবা উনুনে চড়াতেন নিজের প্রিয় কোনো রান্নার পদ। চিকিৎসকেরাও প্রাণোচ্ছল ফওজিয়াকে দেখে সাহসী হতেন। তিনি যেমনটি বলেন, ‘কেউ কেউ তো বলেন, আমার মতো রোগীকে কোনো অসুস্থতাই আসলে কাবু করতে পারবে না।’ তবে কোনো চিকিৎসক অবশ্য সতর্কবার্তা দিয়ে দিতেন, “এই যে এখান থেকে বের হয়েই কিন্তু তেহারি খেতে যাবেন না।”’ 

আবার ফওজিয়া নিজেকে খাদক শ্রেণির মনে করেন। ‘রাস্তার পাশে ফুচকা দেখলে বসে থাকা যায়!’ 

এভাবে দুই দফা কেমোথেরাপির পর ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন ফওজিয়া। ক্যানসার থেকে নিরাময় লাভ করেন। চলতে থাকে চিকিৎসকের পরামর্শমতো নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

আবারও ঝড়

ফওজিয়া আফরিনের মডেলিং শুরু স্কুলজীবনেই। ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী স্কুল ও কলেজে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়েছেন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময় ১৯৯৯ সালে রানারআপ হয়েছিলেন ‘লাক্স–আনন্দধারা মিস ফটোজেনিক প্রতিযোগিতায়। ২০০১ সালে হয়েছিলেন ‘প্যানটিন ইউ গট দি লুক’ প্রতিযোগিতায় সেরা। বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হিসেবে কাজ করেছেন নামকরা প্রতিষ্ঠানের নানা পণ্যের। তবে ২০০৪ সাল থেকে মডেলিংয়ে অনেকটা অনিয়মিত হলেন ফওজিয়া আফরিন। 

কেন?

প্রশ্নটা যখন করি, ততক্ষণে পার্ক ছেড়ে গুলশানে তাঁর বাড়ির বসার ঘরে আমরা। তিনি বলেন, ‘আমার নানুকে খুব ভালোবাসতাম আমি। অনেকে তো বলত, আমি নাকি আমার নানুর মেয়ে! সেই নানু তখন শয্যাশায়ী, তাঁকে সময় দিতাম।’ সে বছর বিয়েও করেন ফওজিয়া। তারপর কাজ করেছেন বেছে বেছে। এমনই বাছাই করা কাজেই ২০১৮ সালে হাজির হয়েছিলেন নির্মাতা পিপলু আর খানের শুটিং সেটে। একটি মুঠোফোন অপারেটরের বিজ্ঞাপন ছিল সেটা। প্রচারিত হওয়ার পর বেশ সাড়াও পেলেন। আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন নিজেকে নিয়ে। সেই ভাবনাতেও ঝড় উঠল।

ফওজিয়া বলেন, ‘গত বছরের অক্টোবরে হঠাৎই মা বলছিলেন মুটিয়ে যাচ্ছি। আমিও খেয়াল করলাম কিছুটা যেন অসুস্থ হয়ে পড়ছি। ওজন মেপে দেখি ৫২ থেকে ৬৮ কেজিতে হয়ে গিয়েছে।’

চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত যাওয়াটা তখন অনিয়মিত হয়ে এসেছিল। গড়িমসি না করে আবার গেলেন চিকিৎসকের কাছে। এই পরীক্ষা, সেই পরীক্ষার পর স্তনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিউমার চিহ্নিত হলো। বায়োপসি (শরীর থেকে গ্রথিত কোষ কেটে নিয়ে পরীক্ষা) করা হলো। ধরা পড়ল ক্যানসার।

২০১৯ সালের এপ্রিলে শুরু হলো দ্বিতীয়বারের মতো ক্যানসারের চিকিৎসা। কেমোথেরাপি শুরু হলো। পাঁচ মাস চলল রেডিওগ্রাফি, হরমোন প্রতিস্থাপনসহ ক্যানসারের চিকিৎসা। 

ফওজিয়া বললেন, ‘এবার আমি আগেরবারের চেয়ে বেশি ভুগেছি। কিন্তু যখনই ভেবেছি আমি বুঝি হেরে যাব, তখনই কোথায় থেকে যেন শক্তি ফিরে পেতাম। পরিবারের মানুষেরা পাশে থেকে সেই শক্তিকে আরও বাড়িয়ে দিত।’

২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘বর্ণিল বিয়ে’ ম্যাগাজিনে মডেল হয়েছিলেন ফওজিয়া
২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘বর্ণিল বিয়ে’ ম্যাগাজিনে মডেল হয়েছিলেন ফওজিয়া

নতুন স্বপ্নে বিভোর
ফওজিয়া আফরিন এখন সুস্থ। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে হয়। যেগুলোর অনেক কিছু মানেন, কিছু কিছু হয়তো মানে না! ডুবে থাকেন কাজে, নিজের ভালো লাগায়। নতুন উদ্যমে কাজের হিসাব কষেন। তাঁর ভাষায়, ‘অনেক কাজ বাকি আছে আমার। এখন নতুন করে ভাবছি গন্তব্য নিয়েও। যেসব কাজ করব বলে করা হয়নি, সেসব নিয়েই ব্যস্ত থাকব।’

জীবন নিয়ে এমন আরও অনেক পরিকল্পনা শোনালেন এই ক্যানসারজয়ী। দৃপ্ত কণ্ঠে বলা সেসব পরিকল্পনায় মিশে থাকল দৃঢ়তা। মনে হলো, কে বলবে মানুষটা এই তো কিছুদিন আগেও ক্যানসারে ভুগেছেন, এক অনিশ্চিত সময়ের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। তাই তো আমাদের সহজেই বিশ্বাস হয় ফওজিয়ার গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা। যে গন্তব্য শুধুই কাজের, উচ্ছ্বাসের, স্বপ্ন দেখার, স্বপ্ন দেখানোর।