সঙ্গী যখন বিষণ্ন

তোমার কী হয়েছে—এমন প্রশ্ন না করে সহযোগিতা করুন বিষণ্ন সঙ্গীকে। মডেল: অন্তরা ও ইয়াসির, ছবি: কবির হোসেন
তোমার কী হয়েছে—এমন প্রশ্ন না করে সহযোগিতা করুন বিষণ্ন সঙ্গীকে। মডেল: অন্তরা ও ইয়াসির, ছবি: কবির হোসেন

এই তো কিছুদিন আগে নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছেন নাহিদ। বহুজাতিক সংস্থা। কাজের চাপ অনেক বেশি। ইদানীং তাঁর মেজাজ সারাক্ষণই থাকে সপ্তমে। কমবেশি প্রতি সপ্তাহের শেষেই যাঁর বেড়ানোর শখ ছিল, তিনি কিনা কিছুতেই বের হতে চাইছেন না ঘর থেকে। মনমরা হয়ে বসে থাকেন ঘরেই। তাঁর স্বামী হিমেল বুঝতেই পারছেন না হঠাৎ করে নাহিদের হলোটা কী?
রুমানার সঙ্গে একটি বিষয়ে তাঁর মা-বাবা কিছুতেই একমত হতে পারছেন না। রুমানাও সেটা মেনে নিতে পারছেন না। ফলাফল সংসার, কাজ—সবকিছুই রুমানার কাছে বিস্বাদ হয়ে উঠেছে। এমনকি স্বামী আসাদের সঙ্গেও ঠিকমতো কথা বলছেন না। ডুবে গেছেন বিষণ্নতায়।
অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে আসিফ সব সময়ই দেরি করেন। এই নিয়ে স্ত্রী শাহানা আগে টুকটাক রাগ করলেও ইদানীং একদমই চুপ মেরে গেছেন। অভিমানটা তো নেই-ই, বরং নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। আর সংসারের কোনো কিছুতে খুব একটা উৎসাহ বা আগ্রহ পাচ্ছেন না।
আমাদের চারপাশে এমন ঘটনা ঘটছে। দম্পতিদের ক্ষেত্রে একজনের আচরণ এমন হয়ে গেলে, তার প্রভাব অপরজনের ওপর গিয়েও পড়ে। সারাক্ষণ মন খারাপ, হীনম্মন্যতায় ভোগা, সবকিছু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা—এসবই বিষণ্নতার লক্ষণ। একজন বিষণ্ন থাকলে পুরো দাম্পত্যই যেন বিষণ্নতায় ডুবে যায়। এটা তখন দাম্পত্য জীবনের মানসিক ও শারীরিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিষাদগ্রস্ত দম্পতিদের বিচ্ছেদের ঝুঁকি অনেক বেশি। তাই সময় থাকতে সঙ্গীকে যেভাবেই হোক বের করে আনতে হবে বিষণ্নতা থেকে। এ কাজে মূল ভূমিকা অপরজনের।
বিশ্বখ্যাত সাময়িকী রিডার্স ডাইজেস্ট পরিচালিত ‘ম্যারেজ ইন আমেরিকা’ জরিপে বেরিয়ে এসেছে এক কোটি নব্বই লাখ আমেরিকান বর্তমানে বিষণ্নতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এই জরিপে উত্তরদাতাদের ৪২ শতাংশই মনে করেন দাম্পত্যে বিষণ্নতা একটি প্রতিবন্ধকতা।
নানা কারণে এই বিষণ্নতা হতে পারে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মেহতাব খানম বলেন, যদি কোনো দম্পতির একজনের মধ্যে বিষণ্নতা দেখা দেয়, তবে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

সঙ্গীর বিষণ্নতায় কী করবেন?
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো একজনকে বিষণ্নতায় পেয়ে বসলে, তাঁকে সে অবস্থা থেকে বের করে আনার চেষ্টাটা করতে হবে অপরজনকে। কী করবেন তিনি? নানা কারণে একজন মানুষ বিষণ্ন হতে পারেন। তাঁকে বিষণ্নতা থেকে বের করে আনবেন অবশ্যই বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সঙ্গীর কিছু দায়িত্ব রয়েছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মেখলা সরকার বললেন, প্র্রথমেই লক্ষ করতে হবে সঙ্গী বিষণ্ন কি না। যদি হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে প্রশ্ন করা যাবে না যে তুমি বিষণ্ন কেন? বরং বলতে হবে, ‘তোমার শরীরটা একটু খারাপ মনে হচ্ছে, খাওয়াদাওয়াও করছ না ঠিকমতো। চল, একবার ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে আসি। তুমি কবে যেতে পারবে? আমার জন্য শনি বা সোমবার হলে ভালো হয়।’ এ ধরনের আলাপে প্রাথমিক আড়ষ্টতা কেটে যাবে।
বিষণ্ন মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। সব সময় তাঁর মন খারাপ থাকে। নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করেন। এ ক্ষেত্রে অপর সঙ্গীকে বাড়িয়ে দিতে হবে সহযোগিতার হাত। বিষণ্ন সঙ্গী যখন রাগের মাথায় কোনো কিছু বলে ফেলেন, তখন কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বরং ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা সামাল দিতে হবে। মেখলা সরকার মনে করেন, এই সময়ে সঙ্গীকে সবকিছুতে উৎসাহ দিতে হবে। তাঁর মনের ভেতরে যা বাষ্প জমে আছে, তা বের করার একটা সুযোগ করে দিতে হবে। সংসার, চাকরি বা অন্য কোনো জটিলতার কারণে বিষণ্ন হলে এভাবেই একে অপরকে সহযোগিতা করে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেন।
কিন্তু যখন স্বামীর আচরণে বা অন্য কোনো কারণে স্ত্রী আবার স্ত্রীর আচরণে স্বামী বিষণ্ন থাকেন—তখন? মেখলা সরকার মনে করেন, এ ক্ষেত্রে যাঁর কারণে সঙ্গী বিষণ্ন, তাঁকেই এগিয়ে যেতে হবে। দুজনের মনে যত প্রশ্ন, যত সংশয়, যত সন্দেহ—সব খোলাখুলি বলে ফেলতে হবে। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।
বর্তমান সময়ে বিষণ্নতা কিছুটা সংক্রামকের মতোই দেখা যাচ্ছে; যা যেকোনো সুস্থ দাম্পত্যে ছন্দপতনের কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই সব সময়ই সঙ্গীর দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া উচিত। কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখামাত্রই সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়া দরকার।

বিষণ্নয়তার লক্ষণ
 সারাক্ষণ মন খারাপ
 হীনম্মন্যতায় ভোগা
 সবকিছু নেতিবাচক চোখে দেখা
 আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলা

সঙ্গী যা করতে পারেন
 বিষণ্ন সঙ্গীর দিকে আন্তরিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
 কোনো কথায় প্রতিক্রিয়া না দেখানো।
 তুমি বিষণ্ন কেন? এ ধরনের প্রশ্ন সরাসরি না করা।
 মনের ভেতরে জমে থাকে বাষ্প বের করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।
 বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া