কিএক্টাবস্থা

মডেল: তন্ময়, অনন্যা, আবীর, ইতি ও জেবা। ছবি: সুমন ইউসুফ
মডেল: তন্ময়, অনন্যা, আবীর, ইতি ও জেবা। ছবি: সুমন ইউসুফ
>সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলা ভাষা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রূপান্তর ঘটছে শব্দ ও বাক্যের। কথা চালাচালির সময় দশ কথার এক কথা হয়ে উঠছে নানান ধরনের ইমোটিকন ও ইমোজি। আবার অনেকেই কিছু লেখার সময় না জেনে করছেন বিচিত্র সব ভুল। এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলা ভাষার বর্তমান হালচাল নিয়ে। লিখেছেন মাহফুজ রহমান

‘বাবু, খাইসো?’ বেশ কয়েক বছরে বাক্যটির দুটি অর্থ দাঁড়িয়েছে। এক. বাবু নামক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সে খেয়েছে কি না, দুই. প্রেমিক অথবা প্রেমিকাকে তার সঙ্গী জিজ্ঞেস করছে সে খেয়েছে কি না। দ্বিতীয় অর্থটি কারও কারও কাছে অদ্ভুত ঠেকতে পারে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত ওঠাবসা থাকলে আপনি হয়তো মন্তব্য করবেন, ‘বল্লেন তো এক্টা কথা! এ আর নতুন কী?’ ঠিক, প্রেমিক–প্রেমিকাকে ‘বাবু’ ডাকার চল একেবারে নতুন নয়। তবে বহমান ভাষায় নবীনতর সংযোজন হলো ‘ছ’–এর বদলে ‘স’। ‘আমি এটা লিখসি’, ‘তুমি সেটা পড়সো’, ‘সে ওটা দেখসে’...। এটা নিশ্চিত, ‘স’–এর এমন প্রয়োগে কারও কারও মাথা টিকটিক ‘করসে’! কেউ কেউ হয়তো চোখমুখ কুঁচকে বলে বসছেন, ‘কী একটা অবস্থা!’

এই ‘কী একটা অবস্থা’–ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন ‘কিএক্টাবস্থা’। অর্থাৎ ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপসহ আরও নানান মাধ্যমে শব্দটি নতুন এই রূপ পেয়েছে। এর ব্যবহার অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্রেফ মজা করার জন্যই। উৎপত্তি কার হাত দিয়ে বা কোথা থেকে, তা উদ্‌ঘাটন করা বেশ কঠিন। তবে অনুমান করা চলে। ধ্বনিভিত্তিক (ফোনেটিক) টাইপিংয়ের কারণে বাংলা বর্ণ অনেক সময় যুক্ত হয়ে যায়। পেয়ে যায় বিচিত্র আদল। আলোচ্য বাক্যটিও হয়তো সেভাবেই সামনে এসেছিল। পরিচিত মানুষ বিচিত্র চেহারায় সামনে হাজির হলে আমরা কৌতুক বোধ করি। বাক্যটির বেলায়ও একই ঘটনা ঘটেছে। দেখলেই হাসি পায়।

দশ কথার এক ছবি
কারও কারও মুখ থেকে আবার হাসি উবেও যায়। ফেসবুক–জমানার ভাষায়, ‘সেন্টিও খাইতে পারেন।’ মানে ভাষার এই পরিবর্তন অনেকের আঁতে ঘা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা কী বলেন? তাঁদের মতামত জানার আগে ছোট্ট একটি তথ্য জানিয়ে রাখি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধিকাংশ মানুষ নেতৃস্থানীয় কারও মেসেজে ইমোজির ব্যবহার সহজভাবে নেয় না। গত বছর কানাডার ইউনিভার্সিটি অব অটোয়ার যোগাযোগ বিভাগের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

আবার গত বছরই ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের (ইউনিকোডের নিয়ন্ত্রক সংস্থা) জরিপ থেকে জানা গেছে, হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ার ইমোজিটি (ফেস উইথ টিয়ারস অব জয়) গোটা বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয়। এর কারণ আবার ব্যাখ্যা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের চ্যাঠাম ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক মনিকা রিওরড্যান। তাঁর বক্তব্যের বঙ্গানুবাদ হলো, মানুষে মানুষে যে যোগাযোগ হয়, তার মধ্যে শরীরী ভাষার (বডি ল্যাঙ্গুয়েজ) ভূমিকা ৫৫ শতাংশ। মেসেজে কথা চালাচালির সময় শরীরী ভাষা হয়ে পড়ে নিষ্ক্রিয়। ফলে অন্যের কাছে আমাদের অনেক কথাই অপ্রকাশিত থেকে যায়। অনেক চেষ্টা করেও আমরা নিজেদের ঠিক খোলাসা করতে পারি না। কিন্তু মনের গহিনের কথা খুব সহজে প্রকাশ করতে ওস্তাদ ছোট্ট একটি ইমোজি।

ফলে ইমোজির গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। ২০১৫ সালে তো ‘হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলা’র ওই ইমোজিটিকে ‘ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় অক্সফোর্ড ডিকশনারি। সেটাই ছিল ‘বছরের শব্দ’ হিসেবে কোনো পিকটোগ্রাফ বেছে নেওয়ার প্রথম ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে কোনো সংস্কৃতিই এখন আর ‘বিদেশি’ নয়। তাই সেই ব্লগিংয়ের শুরু থেকে আজ অব্দি, বাংলায় লেখালেখিতে ইমোজির প্রয়োগ ক্রমবর্ধমান। বিশ্বের বহু দেশে ছাপার অক্ষরে এদের ব্যবহার শুরু হয়েছে। দেশে কেউ করে থাকলে অভিনন্দন!:)

যা টেকার টিকবে
আর যাঁরা শব্দের রূপান্তর করছেন, তাঁদেরকে কি অভিনন্দন জানাতে ‘মুঞ্চায়’? মানে অভিনন্দন জানাতে মন চাইছে? চাইলে জানাতে পারেন। কারণ, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। ভাষা সদা পরিবর্তনশীল। আমরা কথা বলেছিলাম লেখক সুমন রহমানের সঙ্গে। তাঁর বক্তব্য, ‘আগে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ বা ইনস্টাগ্রাম ছিল না। ফলে আমরা মানুষের মৌখিক সংস্কৃতির সঙ্গে সেভাবে পরিচিত হতে পারিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে প্রত্যেকেই এখন নিজের কথা লিখিত আকারে প্রকাশ করছেন। শুরুতে চলতি ভাষাকেও অনেকে অগ্রহণযোগ্য বলেছিলেন। এখনো নতুন নতুন শব্দের বেলায় তা–ই হচ্ছে। তবে আমি মনে করি, এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মৌলিক সংস্কৃতির কোনো মাধ্যম নয়। ফলে যেসব শব্দ টেকার, সেগুলো টিকবে। ঠেকানোর উপায় নেই। এর প্রভাব মৌলিক মাধ্যমগুলোর ওপরেও পড়বে। ভাষা তো প্রতীক, তা সহজে এবং দ্রুত প্রকাশ করার উপায় পেলে মানুষ অবশ্যই গ্রহণ করবে।’

ভুল তো ভুলই
শব্দের রূপান্তর গ্রহণযোগ্য, তবে না জেনে যে ভুলগুলো আমরা করছি, সেগুলোর বেলায় কী হবে? ভুল বানান কিংবা উচ্চারণের তো কোনো শেষ নেই। ফেসবুকের ভাষায় বলতে গেলে ‘হাগার হাগার’ (মানে হাজার হাজার)! এই লেখাতেও দু–একটি ভুল থেকে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যখন অনেকেই ‘কত দিন বাড়ি যায় না’ লেখেন, তখন তা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ‘ই’–এর বদলে ‘য়’ আর ‘য়’–এর জায়গায় ‘ই’–এর প্রয়োগ আজকাল বেশি বেশি চোখে পড়ছে। ‘এ’ আর ‘ত্র’–এর বেলায়ও একই অবস্থা। ‘ছাএজীবনে ত্রকি প্যারা!’ একেই বুঝি বলে মাত্রাজ্ঞান। এর সমাধান কী? যাঁরা ভুল বানান লিখছেন, তাঁদের আপনি ‘হেল্পান’, মানে হেল্প (সাহায্য) করুন।

সাহায্য করতে পারেন বয়সীদেরও, যাঁরা সদ্যই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পদার্পণ করেছেন। কারণ, প্রেমিক যে আজকাল ‘বফ’ আর প্রেমিকারা সব ‘গফ’ হয়ে গেছে, তা তো তাঁরা জানেন না! কিংবা ‘বাই দ্য ওয়ে’র বাংলা যে ‘বত্ব’, সেটা কাউকে বলে না দিলে এর সঙ্গে হিব্রু ভাষার তফাত কোথায়? আর কেউ যদি লেখেন, ‘শ্রদ্ধেয় অমুক স্যারকে মনে পড়ছে, সে ছিল বড় মনের মানুষ’, তখন অবশ্যই বলতে হবে, শ্রদ্ধাভাজনকে ‘সে’ বললে শ্রদ্ধার শ্রাদ্ধ হয়।

শেষ নাহি যে
না জেনে করা ভুলগুলোর বেলায় আমরা আরও কী কী করতে পারি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘না জানাগুলো জেনে ফেলা।’ আর ভাষার রূপান্তর কিংবা পরিবর্তনের বেলায় তাঁর মন্তব্য হলো, ‘সাধারণের চর্চায় ভালো–মন্দের বিচার হয় না। ফেসবুকে তো কোনো কিছু সম্পাদনা করে প্রকাশ করা হয় না। মানুষ এসব ক্ষেত্রে মুখের ভাষায় লেখে। তাই এতে উদ্বেগের কিছু নেই। বরং সচেতনভাবে পরীক্ষা–নিরীক্ষার বিষয় এটি। চলতি ভাষা কোনো জনগোষ্ঠীর এজমালি সম্পত্তি। আর প্রমিত ভাষা বা অভিধান গোষ্ঠীর প্রয়োজনের জন্য তৈরি করা হয়। পৃথিবীর সব দেশে ভাষা এভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে।’

অতএব, ভাষার রূপান্তর মেনে নিতেই হবে। এই প্রক্রিয়ার শেষ নেই। তবে ভুলের বেলায় ছাড়ও নেই। নাহলে হয়তো একসময় লিখতে হবে ‘কিত্রক্টাবস্থা!’