চুইয়ের ঝাল, আব্বাস হোটেল


স্টিলের বড় গামলায় ভর্তি করা তেল চুপচুপে লালচে খাসির মাংসের মধ্যে হাসিমুখে উঁকি দিচ্ছে আস্ত রসুন আর ইঞ্চি দেড়েক লম্বা করে কাটা চুই। তেল-নুন-মসলায় জারিত মাংসের ঝোল সাদা ধোঁয়া ওঠা ভাতের ওপর ছড়িয়ে দিলে যে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, তার তুলনা এই নশ্বর পৃথিবীতে বিরল। ঝোলে মাখা ভাতের প্রথম গ্রাস যখন আপনার জিব স্পর্শ করবে, চুইয়ের নরম ঝাল তখন আচ্ছন্ন করে রাখবে স্বাদগ্রন্থি। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ হয়ে যাবে অমৃতের পরশে। এমনি তুলনাহীন খুলনার আব্বাসের চুই ঝালের খাসির মাংস।

খুলনা ভ্রমণের শুরুতেই স্থানীয় লোকদের মুখে জেনেছিলাম আব্বাস হোটেলের চুইঝাল দিয়ে রান্না করা খাসির মাংসের সুখ্যাতির কথা। গর্বভরে সবাই বলেছিল, ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বাজারে গিয়ে যে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে আব্বাসের হোটেল। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজনের কথা না শোনা পাপ। উপস্থিত হলাম সেখানে। প্রথমেই জানা গেল, শুধু সাদা ভাত, ডাল আর খাসির মাংস ছাড়া এই হোটেলে অন্য কোনো খাবার রান্না হয় না।

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বাজারের আব্বাস হোটেল। দীর্ঘদিন এই রেস্তোরাঁটি তাদের স্বকীয়তা ধরে রেখে খাদ্যরসিকদের রসনার স্বাদ মিটিয়ে চলেছে। ছবি: সাদ্দাম হোসাইন, খুলনা
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বাজারের আব্বাস হোটেল। দীর্ঘদিন এই রেস্তোরাঁটি তাদের স্বকীয়তা ধরে রেখে খাদ্যরসিকদের রসনার স্বাদ মিটিয়ে চলেছে। ছবি: সাদ্দাম হোসাইন, খুলনা

আব্বাস হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চুকনগরের বাসিন্দা আব্বাস আলী মোড়ল। খুলনার রেস্টুরেন্ট–জগতে কিংবদন্তিতুল্য আব্বাস আলী আনুমানিক ৭০-৭৫ বছর আগে ভারতের মাদ্রাজ থেকে রান্না শিখে ফিরে আসেন নিজের এলাকায়। পরে তাঁর সঙ্গে নিজস্ব রান্নার কৌশলের মিশেল ঘটিয়ে এ অঞ্চলের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ইতিহাসের জন্ম দেন তিনি। রেস্টুরেন্ট ব্যবসার প্রথম থেকে তিনি নিজেই রান্না করতেন। মজাদার রান্নার কারণে অল্প দিনেই সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে আব্বাস আলী মোড়ল এর। পরবর্তী সময়ে তাঁর তিন ছেলেকে শিখিয়ে দেন রান্নার কৌশল। ২৭ বছর আগে আব্বাস আলী মোড়লের মৃত্যু হলে হোটেলের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন ছেলেরা। সহকর্মী সঙ্গে থাকলেও আব্বাস আলীর তিন ছেলে আবদুল জলিল মোড়ল, আবদুল হালিম মোড়ল ও মো. সেলিম মোড়ল পালাক্রমে মূল রান্নার কাজে অংশ নেন। এখন তিন ভাইয়ের সন্তানেরাও এসেছে হোটেল পরিচালনায়। চুকনগর বাজারের মূল রেস্টুরেন্টের বিপরীতে আছে ‘আব্বাস হোটেলে’–এর আরও একটি শাখা। এ ছাড়া খুলনা জিরো পয়েন্টেও আছে আর একটি শাখা। মোট তিনটি শাখায় সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রতিদিন খাবার খেতে পারবেন। শুধু দুই ঈদে পাঁচ দিন করে বন্ধ থাকে হোটেলটি। এখানে মাংস বিক্রি হয় পিস হিসেবে। প্রতি পিস মাংস ১২৫ টাকা, ভাত প্রথমবার ১৫ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি বাটি ভাতের জন্য গুনতে হবে ১০ টাকা করে।

রেস্টুরেন্টের সামনে সারি করে রাখা ব্যক্তিগত গাড়ি আর মোটরসাইকেলের বাঁধা পেরিয়ে ভেতরে ঢোকাটাই এক যুদ্ধ। পরের যুদ্ধ টেবিল খালি পাওয়া। এত যুদ্ধকে কোনো যুদ্ধই মনে হয় না মাংস মুখে দিলে। এ জন্য প্রতিদিন খুলনার বিভিন্ন এলাকা তো বটেই, দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই খাবারের স্বাদ নিতে ছুটে আসেন ভোজনরসিকরা। অনেকে যাওয়ার সময় চুইঝালে রান্না করা মাংস বেঁধে নিতে ভোলেন না প্রিয়জনের জন্য।

চুই দিয়ে রান্না করা ঝাল ঝাল খাসির মাংস। আব্বাস হোটেলে খাসির মাংসই রান্না হয় শুধু। ছবি: সাদ্দাম হোসাইন, খুলনা
চুই দিয়ে রান্না করা ঝাল ঝাল খাসির মাংস। আব্বাস হোটেলে খাসির মাংসই রান্না হয় শুধু। ছবি: সাদ্দাম হোসাইন, খুলনা

রান্না কীভাবে হয় দেখার আগ্রহ প্রকাশ করতে সানন্দে রাজি হয়ে যান হোটেলটির একজন স্বত্বাধিকারী সেলিম মণ্ডল। রসুইঘরের দিকে পা বাড়াতেই ভেসে এল মাংস রান্নার সুঘ্রাণ। বড় কড়াইয়ে করে মাটির চুলায় কাঠ পুড়িয়ে রান্না হচ্ছে মাংস। মাঝেমধ্যেই বড় লম্বা হাতায় নেড়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে তলায় লেগে না যায়। পাশের অন্য চুলায় বড় হাঁড়িতে বসানো হয়েছে ভাত। বেশ কয়েকটি বাটিতে আছে বেটে রাখা মসলা, ধুয়ে রাখা আছে আস্ত রসুন, কেটে ঝাঁজরিতে পানি ঝরাতে দেওয়া চুইঝাল, কিছু চুই আঁটি বেঁধে রাখা আছে পাশের বালতিতে। কথায় কথায় সেলিম জানালেন, প্রতিদিন পশু ডাক্তার দিয়ে খাসি পরীক্ষা করিয়ে তবে সেই খাসিকে জবাই করে মাংস রাখেন তাঁরা। তাঁদের প্রয়োজনীয় অংশ রেখে পায়া, মাথা, ভুঁড়িসহ অন্য অংশ পাঠিয়ে দেন স্থানীয় বাজারে। সকাল সাতটা থেকে প্রতিদিন কয়েকবার চলে রান্নার আয়োজন। যারা ঝাঁ চকচকে রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে অভ্যস্ত, তাদের জন্য আব্বাস হোটেল মোটেও সুখকর পরিবেশ দিতে পারবে না। সাধারণ মানের হাত ধোয়ার জায়গা, খাবার পরিবেশনসহ প্রতিটি ধাপ খুব সাদামাটা। কিন্তু এই সাধারণ থেকেও আব্বাস হোটেল হয়ে উঠেছে খাদ্যপ্রেমীদের জন্য অসাধারণ স্বাদের উৎসস্থল।

চুইঝাল মূলত বাংলাদেশের দক্ষিণ–পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলোয় মসলা হিসেবে খুব জনপ্রিয়। চুইগাছ দেখতে পানের লতার মতো। পাতা কিছুটা লম্বা ও পুরু। পাতায় ঝাল না থাকলেও এর কাণ্ড ও ডালের স্বাদ ঝাল। মূলত গরু, খাসি, হাঁস ও মুরগির মাংস, মাছ, সবজিসহ যেকোনো ঝোলজাতীয় রান্নায় মসলা হিসেবে চুইগাছের কাণ্ড বা লতার ব্যবহার করা হয়। দেড় থেকে দুই ইঞ্চি টুকরা করে কেটে কাণ্ড বেশি মোটা হলে মাঝখান দিয়ে ফেড়ে ২, ৪ বা ৬ টুকরা করে খাবার রান্নার সময় যোগ করতে হয়। রান্নায় চুইয়ের ব্যবহারে খাবারে কিছুটা ঝাল স্বাদ বাড়ে। আর সেই সঙ্গে রান্নায় আলাদা সুঘ্রাণ তৈরি হয়। এর কাণ্ড, শিকড়, পাতা, ফুল ও ফল ভেষজ গুণসম্পন্ন। চুই গ্যাস্ট্রিক সমস্যার সমাধান করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, খাবারের রুচি বাড়ায়, রক্তস্বল্পতা দূর করে, ক্ষুধামান্দ্য দূর করে, শরীরের ব্যথা সারায়, কাশি, কফ, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া সারাতে কার্যকর ও সদ্যপ্রসূতি মায়েদের শরীরের ব্যথা দ্রুত কমাতে সাহায্য করে বলে জানা যায়।

এখানে আছে পছন্দের মাংসের পিস বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা। ছবি: সাদ্দাম হোসাইন, খুলনা
এখানে আছে পছন্দের মাংসের পিস বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা। ছবি: সাদ্দাম হোসাইন, খুলনা

ভালোবেসে বেশ কিছু ক্রেতা আব্বাস হোটেলের রান্না মাংস কিনে সৌদি আরব, জাপান, স্পেন, ভারত, ইতালি, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশে নিয়ে গেছেন। অনেকেই সে দেশ থেকে ফোন করে সানন্দে জানিয়েছেন, রান্নার অসাধারণ স্বাদ সম্পর্কে। তা ছাড়া এ দেশের বিনোদন ও খেলার জগতের অনেক তারকা খুলনায় এসে ছুটে গেছেন আব্বাস হোটেলের খাবার কেমন তা পরখ করতে।

লালমনিরহাট থেকে হোটেলের খাবার খেতে আসা ব্যবসায়ী মিঠু মোল্লার সঙ্গে কথার একপর্যায়ে জানালেন, যতবার খুলনা এসেছেন, ততবার আব্বাস হোটেলের মাংস না খেয়ে ফেরত যাননি। প্রায় ১২-১৫ বার নিজে খেলেও একবার কী মনে করে মায়ের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের জেলায়। মা বেঁচে নেই, তবে সেদিন খাবার সময় মায়ের মুখে যে তৃপ্তির আভা তিনি ফুটে উঠতে দেখেছিলেন, সেই তৃপ্তিময় খাওয়ার দৃশ্য তাঁর চিরকাল মনে থাকবে। পরে যতবার এখানে খেতে এসেছেন, মাংস খাবার সময়ের মায়ের মুখটা তাঁর বারবার মনে হয়েছে।

আব্বাসের হোটেল খুলনার এক বিস্ময়কর রেস্টুরেন্ট। দীর্ঘদিন এই রেস্টুরেন্টটি তাদের স্বকীয়তা ধরে রেখে খাদ্যরসিকদের রসনার স্বাদ মিটিয়ে চলেছে।

আব্বাস হোটেলের ভেতরে ঢুকে বসার জায়গা পাওয়া এক যুদ্ধই বটে। ছবি: সাদ্দাম হোসাইন, খুলনা
আব্বাস হোটেলের ভেতরে ঢুকে বসার জায়গা পাওয়া এক যুদ্ধই বটে। ছবি: সাদ্দাম হোসাইন, খুলনা