এই শীতে বিলেতে

স্কটল্যান্ডের ডান্সট্যাফনেজ ক্যাসেলের সামনে লেখক
স্কটল্যান্ডের ডান্সট্যাফনেজ ক্যাসেলের সামনে লেখক

গত বছরের নভেম্বরের কথা। একই বছরে দ্বিতীয়বারের মতো গেলাম লন্ডনে। জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপ যখন দেখতে গিয়েছিলাম, তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। এবার এলাম শীতের সময়। একেবারে জেঁকে বসা শীত।

শহুরে জীবন আমার পছন্দের। খাব, কেনাকাটা করব, জাদুঘরে যাব—এই তো মজা। তাই এবার উঠেছিলাম পূর্ব লন্ডনের স্টার্টফোর্ড এলাকার এক হোটেলে। স্টার্টফোর্ডে থাকার কারণ ওয়েস্টফিল্ড একদম কাছে। এই বিপণিবিতানে কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়া, সিনেমা দেখা—সব একসঙ্গে মেলে। প্রথম দিনেই কেনাকাটা করতে চলে গেলাম। শীতের কাপড় কিনতে হবে। ঢাকা থেকে যা এনেছি, তাতে এই শীত ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। কেনাকাটা শেষ হতেই ফারহা এসে হাজির। সে আমার স্কুলবন্ধু। দুই বন্ধু মিলে হুটহাট পরিকল্পনা করে চলে গেলাম সাউথেন্ড সি দেখতে।

ট্রাফোর্ড সেন্টারের সামনে
ট্রাফোর্ড সেন্টারের সামনে

শীতে বরফের মতো জমে যাচ্ছিলাম। সাউথেন্ডে গিয়ে আশপাশে তাকিয়ে দেখি, এক কি দুই বছরের শিশুদের নিয়ে এসেছেন মায়েরা। দেখে কেমন যেন মনোবল ফিরে পেলাম! যাক এই শীত শীত নয়। সৈকতের আশপাশে অনেক রোমাঞ্চকর রাইড আছে, আমার ভীষণ ভয় লাগে এসব রাইডে চড়তে। পাশেই ছিল অ্যাডভেঞ্চার আইসল্যান্ড নামে বিশাল জায়গা নিয়ে একটি বিনোদন পার্ক। সেখানে বিভিন্ন ধরনের রাইড, খাবারের জায়গা আছে, আছে জাহাজ। ঠান্ডায় পাগল হওয়ার অবস্থা বলে কফি খুঁজছিলাম। দেখি, সেখানে কফির মতো করে সবাই স্যুপ খাচ্ছে। আমিও স্যুপই নিলাম। ঠান্ডায় না বুঝেই দিলাম চুমুক, জিহ্বা গেল পুড়ে! স্যুপ খেতে খেতেই এক ভারতীয় নারীর সঙ্গে আলাপ। বয়স্ক এই নারী থাকেন ইতালিতে। লন্ডনে একাই এসেছেন। মনে মনে ভাবি, কী পাগল রে বাবা, এত শীতে তারা আবার একা একা ঘোরে কেন!

এরই ঘোষণা এল সবাইকে জাহাজের বাইরে আসতে। আতশবাজি ফোটানো হবে। বন্ধু ফারহা তো খুশিতে লাফিয়ে উঠল। এরপর টানা ২৫ মিনিট আতশবাজি ফোটানো হলো। নানা রঙের আলোয় উদ্ভাসিত হলো আকাশ। তার ঝলসানিতে আমরা যখন উদ্ভাসিত, তখন আমাদের স্কুলের কথা মনে পড়ল। এমন আতশবাজির দিন ছিল তখন।

আইল অব স্কাইয়ের মুগ্ধতা
আইল অব স্কাইয়ের মুগ্ধতা

দারুণ একটা অভিজ্ঞতা নিয়ে লন্ডনে আরও দুই দিন কাটল। এরপরের গন্তব্য ছিল ম্যানচেস্টার। ট্রেনে লন্ডন থেকে তিন ঘণ্টা লাগল। বিদেশের যাতায়াতব্যবস্থা আর মানুষের ব্যবহার দেখলে খুব ঈর্ষা হয়। মনে হয়, আমাদের দেশে যদি এমন হতো। আমিও ট্রেনে শুটিংয়ে চলে যেতাম। কেউ আমাকে বিরক্ত করত না, বাজে মন্তব্য করত না।

সেদিন ট্রেনে যেতে যেতে দেখেছিলাম দুপাশের সবুজ মাঠ। বিশাল মাঠে শুধু ভেড়া আর ভেড়া। একটা ভেড়াও মাথা উঁচু করে নেই, সব সারা দিন ঘাস খাচ্ছে। মনে হলো, এদের কী আকাশও দেখতে ইচ্ছা করে না!

ম্যানচেস্টারে নেমেই মনে হলো কী শান্ত একটা শহর। এত সুন্দর রাস্তা, দুপাশে ডুপ্লেক্স বাড়ি। ওকল্যান্ড হোটেল নামের একটা হোটেলে উঠলাম। পুরো কাঠের দোতলা বাড়ি। ব্যাগ রেখেই চলে গেলাম দর্শনীয় বিপণিবিতান ট্রাফোর্ড সেন্টার। পুরো ইংল্যান্ডের মধ্যে অন্যতম একটি বিপণিবিতান। রাজবাড়ির মতো দেখতে। পুরো বিপণিবিতানের প্রতিটি তলায় একেকটি দেশকে তুলে ধরা হয়েছে। কোনো তলায় চীন, কোনো তলায় আরব আমিরাত, কোনোটায় ইতালি। অনেকটা সময় কেটে গেল বিপণিবিতানেই। সেদিন আর কিছুই করা হলো না।

ট্রেনে লন্ডনে
ট্রেনে লন্ডনে

পরদিন সকালে গাড়িতে চলে যাই লিভারপুল। নেমেই হাজির হই লিভারপুর জাদুঘরে। জাদুঘর আমার সবচেয়ে আগ্রহের জায়গা। প্রথমবার যখন লন্ডনে এলাম, তখন অনেক জাদুঘর ঘুরে দেখেছি। শহরটায় অসংখ্য জাদুঘর আছে। কীভাবে এত দেখব, ভেবে কূলকিনারা করতে পারছিলাম না। তবুও কয়েক দিনে যা দেখেছি, তাতেই আমার মনে হয়েছে সব জাদুঘর দেখে ফেলেছি!

সেদিন লিভারপুল জাদুঘরে ঢুকতেই নজর কাড়ল ছোট ছোট ট্রেনের বগি। জাদুঘরে বিশাল আকৃতির ইগল। মনে হচ্ছিল একদম সত্যি দাঁড়িয়ে আছে পাখিটা। বিশ্বের অনেক দুষ্প্রাপ্য জিনিস লিভারপুল জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। দেখলাম আর মুগ্ধ হলাম।

রাতের লন্ডন টাওয়ার ব্রিজে
রাতের লন্ডন টাওয়ার ব্রিজে

জাদুঘর থেকে বেরিয়েই নদীর তীর। তীর জুড়ে সীমানা খুঁটি পোঁতা। এসব খুঁটির তারে মানুষ অসংখ্য তালা লাগিয়েছে। এটাকে বলা হয় ‘লাভ লক’। আমিও একটা তালা কিনে আমার ভালোবাসাকে তালাবদ্ধ করে লিভারপুল থেকে রওনা দিলাম স্কটল্যান্ডের পথে। স্কটল্যান্ডে যাওয়ার সময় যা হলো তা পুরোপুরি সিনেমা যেন! আমার বান্ধবী চলে যাবে লন্ডনে, আমাকে স্কটল্যান্ডের পথে ট্রেনে তুলে দিল। এই ট্রেন নাকি সোজা স্কটল্যান্ড যাবে। আমিও উঠে পড়লাম। ঘণ্টাখানেক না যেতেই শুনি, ট্রেনটি লন্ডনের ইউস্টনের পথে যাত্রা শুরু করবে। এটাই গন্তব্য। আমি বান্ধবীকে ফোন করলাম। সে তখনো বলছে ঠিক আছে, স্কটল্যান্ডের পথেই আছি। আমি ট্রেন থেকে নেমে পড়ি। এরপর তথ্যকেন্দ্রে জিজ্ঞেস করলে তারা আমার টিকিট দেখে জানাল, আমি ভুল ট্রেনে ছিলাম। স্কটল্যান্ডে যেতে আরও দুটি স্টেশন পার করতে হবে। আবার টিকিট কেটে আমি স্কটল্যান্ডের পথ ধরি।

লিভারপুল জাদুঘর
লিভারপুল জাদুঘর

স্কটল্যান্ডে গ্লাসগো হয়ে গিয়েছিলাম অবানে। পাহাড়–সমুদ্রের মায়ায় কয়েক দিন কাটিয়ে ফিরেছিলাম আবার লন্ডনে।

লন্ডন এসে ঠিক করলাম মঞ্চনাটক দেখতেই হবে। যে দেশেই যাই, চেষ্টা করি একটি মঞ্চনাটক দেখার। লন্ডনে দেখলাম দ্য উইমেন ইন ব্ল্যাক। ৩০ বছর ধরে এই নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। মাত্র তিনজন অভিনয়শিল্পীকে দিয়েই কী অসাধারণ নাটক মঞ্চস্থ করা সম্ভব, এটা না দেখলে বুঝতাম না।

নাটক দেখে ফিরলাম হোটেলে। পরদিনই হোটেল ছেড়ে সোজা বিমানবন্দরে, বাংলাদেশ বিমানে একসময় পৌঁছাল আমার শহর ঢাকায়, আমার দেশ বাংলাদেশে।

লেখক: অভিনেত্রী