তুমি হও গহিন গাঙ

একেক দেশে ভালোবাসার প্রকাশ একেক রকম। মডেল: অভিনয়শিল্পী তানজিন তিশা ও রোশান। ছবি: নকশা
একেক দেশে ভালোবাসার প্রকাশ একেক রকম। মডেল: অভিনয়শিল্পী তানজিন তিশা ও রোশান। ছবি: নকশা

আবেগের সীমা থাকে না, তবে প্রকাশের কিছু তরিকা থাকে। এসব তরিকা দেশে দেশে, কালে কালে বদলেছে, বদলাবে ভবিষ্যতেও। আমরা যাঁরা ‘নার্ভাস নাইন্টিজে’ বেড়ে উঠেছি, তাঁদের কাছে ভালোবাসার আবেগ ছিল নিষিদ্ধ ওষুধের মতো। তারও আগে মৈমনসিংহ গীতিকার যুগে যখন নদের চাঁদ–মহুয়ার ভালোবাসা জোছনার আলোর মতো ভেসে যাচ্ছে, তখন তাদের দেখা হচ্ছে পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটে। মহুয়ার প্রত্যাখ্যানে তৈরি হচ্ছে প্রগাঢ়তম রোমান্টিক কবিতা, ‘তুমি হও গহিন গাঙ, আমি ডুইব্যা মরি।’ এরপর ‘দুজন দুজনার’ না হয়ে কি পারে, যতই ঝঞ্ঝা আসুক জীবনে! কোকিলের কুহু তান, ফুলের সুবাস, মৃদু মৃদু বাতাস—এসব না হলে পূর্বরাগে ঘনীভূত হয়ে গহিন গাঙে ঝুপ করে ডুব দেওয়া যায় না।

২.

মেক্সিকোর মায়েদের কাজ হচ্ছে বাবাদের রক্তচাপ ঠিক রাখা। কোন সুযোগে কোন রাজপুত্তুর এসে তার ষোড়শ বর্ষীয়া মেয়েকে তারই বাড়ির সামনে হল্লা করে আবেগঘন কথা বলে ফেলবে, তার তো কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তখন কার রক্তচাপ ঠিক থাকবে? 

‘বাংলা ভ্যালেন্টাইন’ সরস্বতী পূজায় প্রথম শাড়ি পরা মেয়েটিকে প্রথম গোঁফ ওঠা কোনো ছেলে ফুলের তোড়া দিয়ে ফেলবে উপহার! কিংবা আলাভোলা, চশমা পরা ছেলেটিকে কোনো ষোড়শী লজ্জা ভেঙে টেনে নিয়ে যাবে জীবনের নতুন আহ্বানে, তা ভেবে পশ্চিমবঙ্গের বাবা–মায়েরাও বিস্তর টেনশনে থাকেন শুনেছি। বাংলাদেশে? সামাজিক ট্যাবু থাকলেও ফল্গুধারার মতো বহমান আছে ভালোবাসা প্রকাশের ঘটনা। যদিও সেটা ঠিক স্বাধীন এবং সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি এখনো। যেমন উঠেছে চীনে। চীনের ভালোবাসার উৎসব চিসি। এটি উদ্​যাপিত হয় চীনা বর্ষপঞ্জির সপ্তম মাসের সপ্তম দিনে। স্বর্গের অপ্সরী ট্রিমি ভালোবেসে ফেলেছিল নিউলাং নামে পৃথিবীর এক রাখালকে। এটা মেনে নিতে পারেননি স্বর্গের দেবতারা। তাঁরা তাদের শাস্তি দেন, ছায়াপথের দুই প্রান্তে অসম্ভব দূরত্বে থাকবে তারা, যেন কেউ কারও কাছে আসতে না পারে। কিন্তু তাদের প্রতিটি বছরের সপ্তম মাসের সপ্তম দিন মিলিত হওয়ার অনুমতি ছিল। চীনের এই পৌরাণিক কাহিনিকে কেন্দ্র করেই পালিত হয় চিসি উৎসব। চীনের মানুষ ভালোবাসার প্রতি বিশ্বস্ততার এ কথা স্মরণ করে সুখের কামনা করে এই দিনে।

জাপান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, কম্বোডিয়ায় ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবসের পাশাপাশি ‘হোয়াইট ডে’–ও উদ্​যাপন করা হয়। এই দিনটি উদ্​যাপন শুরু হয় জাপানে, ১৯৭৮ সালে। পরে এটি পাশের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ ভ্যালেন্টাইনস ডেতে জাপানি নারীরা পুরুষদের চকলেট উপহার দেন। আর ঠিক এক মাস পর মার্চ মাসের ১৪ তারিখ পুরুষেরা নারীদের উপহার দেওয়ার মাধ্যমে পালন করেন হোয়াইট ডে। উপহার হিসেবে জাপানে গিরি ও হোনমো চকলেট দেওয়া হয়। বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, প্রতিবেশী—এ রকম সম্পর্কের ক্ষেত্রে উপহার দেওয়া হয় গিরি চকলেট। আর হোনমো চকলেট প্রিয় মানুষকে উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। জাপানে ভ্যালেন্টাইনস ডে ও হোয়াইট ডে—দুটি দিবসই পালনের সূত্রপাত হয় মূলত চকলেট–শিল্পের কারণে। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার যুগলরা বিভিন্ন মাসের ১৪ তারিখ উদ্​যাপন করে ভালোবাসার বিভিন্ন উপলক্ষ। যেমন মে মাসে গোলাপ দিবস, জুন মাসে চুম্বন দিবস ইত্যাদি। আবার একাকী থাকা তরুণ-তরুণীরা এপ্রিল মাসে কালো দিবস পালন করেন ব্ল্যাক বিন সস দিয়ে তৈরি একধরনের কালো নুডলস খেয়ে।

চেক প্রজাতন্ত্রে ভালোবাসার দিন উদ্​যাপনের রীতি কিন্তু ভ্যালেন্টাইনস ডেকে কেন্দ্র করে নয়। বরং ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাড়াও এই দেশটিতে ১ মে ‘সোয়াতেক জামিলোভানি’ নামে একটি অনুষ্ঠান উদ্​যাপন করা হয়। এদিন চেকের অধিবাসী প্রেমিক তরুণ-তরুণীরা ফুটন্ত চেরিগাছের নিচে একে অপরকে চুম্বন করে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এ ছাড়া প্রাগ শহরের তরুণ-তরুণীরা সেদিন পেট্রিন হিল নামের একটি জায়গায় যান। সেখানে চেক প্রজাতন্ত্রের বিখ্যাত রোমান্টিক কবি ক্যারেল হায়েনেক মাখার ভাস্কর্য আছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা এই রোমান্টিক কবির ভাস্কর্যের নিচে ফুল বিনিময় করে এবং একে অপরকে চুম্বন করেন। চেক প্রজাতন্ত্রের বাসিন্দাদের বিশ্বাস, ফুটন্ত চেরি ফুলের গাছের নিচে প্রেমাস্পদকে চুম্বন করলে সারা বছর চেরি ফুলের মতো সুন্দর থাকা যায়। খুব সম্ভবত এই প্রথা শুরু হয়েছিল উনিশ শতকের বিখ্যাত চেক রোমান্টিক কবি ক্যারেল হায়েনেক মাখার হাত ধরে। ক্যারেল ‘মে’ নামে চেক ভাষায় একটি বিখ্যাত রোমান্টিক কবিতা লিখেছিলেন। এর ইংরেজি অনুবাদে কয়েকটি লাইন হলো:

‘ইট ওয়াজ লেট ইভনিং, 

অন দ্য ফার্স্ট অব মে,

দ্য ইভ অব মে ওয়াজ 

দ্য টাইম অব লাভ।

দ্য টার্টল-ডোভস 

ভয়েস কলড টু লাভ, 

হয়্যার রাইস অ্যান্ড 

সুইট পাইনউডস লে।’ 

ব্রাজিলে ১২ জুন উদ্​যাপন করা হয় লাভারস ডে হিসেবে। আর্জেন্টিনায় জুলাই মাসের পুরো একটি সপ্তাহই উদ্​যাপন করা হয় ‘সুইটনেস উইক’ নামে। ইংল্যান্ডের ওয়েলসে ২৫ জানুয়ারি ভালোবাসার দিন, যাকে বলা হয় ‘ডে অব সান ডোয়েইনোয়েন’। ১৬ শতক থেকে সাধু ডোয়েইনোয়েনের নামে প্রবর্তিত এ দিনে যুগলরা কাঠের তৈরি চামচ উপহার দেন একে অপরকে। স্পেনের রোমান্টিক তারিখ ৯ অক্টোবর। দিনটিকে বলা হয় ‘ডে অব সেন্ট ডায়নোসিয়াস’। ২৪ ফেব্রুয়ারি রোমানরা পালন করে দ্রাগোবেতে উৎসব। বিশ্বাস করা হয়, এ উৎসবে অংশ নেওয়ার ফলে সামনের এক বছর নীরোগ থাকা যাবে।

দিন যেটাই হোক কিংবা মাস, সুর একটাই; ক্যারেল হায়েনেক মাখা অথবা দ্বিজ কানাই, বিভিন্ন ভাষায় সেই একটাই কথা লিখেছেন—তুমি হও গহিন গাঙ, আমি ডুইব্যা মরি।