এইতো হেথায়, কুঞ্জছায়ায়

২৫ বছর আগে বিয়ের আসরে স্বামী বি কে বোস ও কান্তা রিমি রায়। ছবি: সংগৃহীত
২৫ বছর আগে বিয়ের আসরে স্বামী বি কে বোস ও কান্তা রিমি রায়। ছবি: সংগৃহীত

‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই...

 শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই...।’

দুটো হাত ধরে পথ চলছি। এখনো মন ভরেনি তাকে ভালোবাসার কথা বলে। মনে হয়, দুচোখ ভরে তার দিকে চেয়ে থেকেও হাজারো ভালোবাসার কথা বলা বাকি রয়েই গেছে। রজতজয়ন্তীর বছর পার করছি ‘সাত পাকে বাঁধা’র। তারও প্রায় এক দশক আগে শুরু হয়েছে মন দেওয়া–নেওয়ার পথচলা।

ছোটবেলা থেকেই মেধাবী, কৃতী শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ কাজ করত। সেই ব্যক্তিসত্তা থেকেই তার সেসব গুণের জন্যই ভালো লাগার সূত্রপাত। তবে সেই এক দশক সময়টি ছিল কণ্টকাকীর্ণ।

পরিবারে প্রথম সন্তান আমি, ছিলাম কঠোর শাসনে। নিজের মধ্যে দৃঢ় চাওয়া ছিল, কখনো যেন আমার কাজকর্মে মা–বাবা কষ্ট না পান। মনের শিকড়ে কঠোরভাব, ‘যাকে ভালোবাসব, তার সঙ্গেই ঘর বাঁধব।’ সে কারণে পরিবার ও সমাজের জন্য দৃষ্টিকটু হতে পারে দুজনের সম্পর্ক, এমন কিছু থেকে দূরে ছিলাম, যাতে ভালোবাসার মানুষটিকে দুই পরিবারের সম্মতিতে বরণ করা নিয়ে কোনো বাধা না আসে।

সেই সময়ে মন দেওয়া–নেওয়ার একমাত্র অবলম্বন ছিল ডাকযোগের চিঠি। যত দূর মনে পড়ে, সবচেয়ে বড়টি ছিল ৯৯ পৃষ্ঠার একটি চিঠি। সে সময়ে হোস্টেলজীবনে মন খারাপ হলে টেপরেকর্ডারে পাগলের মতো শুনতাম দুটো গান—সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ‘তোমাকে চাই...’ ও মান্না দের ‘যদি হিমালয় আল্পসের সমস্ত জমাট বরফ...’। দেড় ঘণ্টার ক্যাসেটজুড়ে শুধু এ দুটি গান রেকর্ড করে রেখেছিলাম আর লাগাতার শুনতাম।

ময়মনসিংহ ও রাজশাহী—এই দুই মেডিকেল কলেজের মধ্যে চলত ডাক যোগাযোগ। রাজশাহী শহরে আমার আত্মীয়স্বজন ছিল প্রচুর, ফলে সে রাজশাহীতে দেখা করতে এলে এক রিকশায় চড়া সম্ভব ছিল না। এভাবেই চলেছে আমাদের ভালোবাসার কাল। অবশেষে সে কর্মক্ষেত্রে যোগদানের পর আমার ইন্টার্নশিপের সময় দুই পরিবারের সম্মতিতে আড়ম্বরপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো।

ক্যারিয়ার ও সংসার

এরপর শুরু হলো ক্যারিয়ার গড়া। স্নাতক চিকিৎসক থেকে বিশেষজ্ঞ হয়ে গড়ে ওঠা দুজনের, এখানেও শুরু হলো কঠিন জীবন—জীবনের প্রায় সব আড়ম্বরপূর্ণ ইচ্ছাকে গিট্ঠু বেঁধে রেখে তাকে তার পোস্টগ্র্যাজুয়েট কোর্সে মনোনিবেশের জন্য দৈনন্দিন রুটিনকে পরিচালনা করা। এরই মধ্যে কোলজুড়ে এল প্রথমে পুত্র, পরে কন্যা। তার স্নাতকোত্তর সম্পন্ন হওয়ার পর, আমি তখন শুরু করেছি নিজের স্নাতকোত্তর। সে পেশাগত জীবনে অত্যন্ত দক্ষতার ছাপ শুরুতেই রেখেছিল। আমি সংসারের জন্য পর্যাপ্ত সময় যেন পরে দিতে পারি এবং সন্তানদের তৈরি করতে পারি, তাই বেসিক বিষয় অ্যানাটমিতে স্নাতকোত্তর করি। মন দিয়ে উপভোগ করি শিক্ষকতার জীবন।

প্রতিটা দিন শেষে বাসায় ফিরে পেশাগত ও পারিবারিক বিষয়ে একে অপরের কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছি। সারা দিনের পথচলায় কোনো ভুল হয়েছে কি না বা শিক্ষণীয় কিছু আছে কি না—এসব বিষয়ে দুজনেই সতর্ক থাকার চেষ্টা করেছি আপ্রাণ।

চিঠিই ছিল ভালোবাসার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম
চিঠিই ছিল ভালোবাসার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম

আমরা দুজনই প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি পেশাগত জীবনে। আমার পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের কাছ থেকে অপরিসীম সহযোগিতা পেয়েছি। একইভাবে তার পেশাগত জীবন এবং দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের প্রতি যত্নশীল থেকেছি সদাই। ভুল–বোঝাবুঝির বিষয় এলে তৃতীয় পক্ষ নয়, দুজন সরাসরি নিজেদের ভুল বা কী করা যেত বা কী করলে ভালো হতো, তা নিয়ে খোলাখুলি নিজেদের মধ্যে সরাসরি সমালোচনা করেছি।

নিজেদের বিশেষ দিনগুলো ভালোবাসা-স্নেহ-সময়-পরিকল্পনা দিয়ে মন ভরে পালন করেছি। নিজেদের সামর্থ্য বা সাধ্যের জন্য কোনো শখ পূরণ করা কষ্টকর হতে পারে, এমন উদ্যোগ নিইনি। দুজনের বাবার বাড়ির দায়িত্ব ও সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডে সদানন্দে সচেষ্ট থেকেছি। আমাদের সমাজে একজন নারী হয়ে আমার জীবন প্রশান্তিতে ভরপুর। কারণ, যখন আমার শ্বশুরবাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠজন বলেন, ‘বউমা, তোমার ব্যক্তিত্ব নিয়ে আমি, আমার পরিবার গর্বিত।’

আমাদের পুত্র–কন্যা প্রকৌশলবিদ্যায় পড়ছে বুয়েট ও এমআইএসটিতে। আমার সে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার মেডিসিন দিনাজপুরের পরিচালক। একজন মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ।

 সবকিছুর ঊর্ধ্বে বলব কিশোর কুমার ও রুমা গুহঠাকুরতার গাওয়া—

‘এইতো হেথায়, কুঞ্জছায়ায়, স্বপ্ন মধুর মোহে;

এই জীবনে যে কটি দিন পাবো,

তোমায় আমায় হেসেখেলে কাটিয়ে যাবো দোঁহে।’

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, অ্যানাটমি বিভাগ এবং সাবেক অধ্যক্ষ, এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর।