নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ

নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। এই নিয়ন্ত্রণ নিজের আচার–আচরণ ও কর্মকাণ্ডের ওপর অথবা কথাবার্তার ওপর। আমাদের চারদিকে পরিচিত–অপরিচিত মানুষের মধ্যে আজকাল যে আচরণগুলো অনেক বেশি চোখে পড়ে, তা হলো ধৈর্যহীনতা, ক্ষমাহীনতা, আক্রমণাত্মক, পরিহাস ও প্রতিহিংসা। বাড়িতে, অফিসে, স্কুল-কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় বা রাস্তাঘাটে এ বিষয়গুলো যেন সব জায়গাতেই দৃশ্যমান। 

ধৈর্যহীনতা নয়

একটি টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী রাকিবের (ছদ্মনাম) উদাহরণটা দেখি। সহকর্মীর পদোন্নতি দেখে রাকিবের মনে হলো এমন পদোন্নতি তাঁরও পাওনা। বিষয়টি নিয়ে রাকিব যখন তাঁর বিভাগের সুপারভাইজারের কাছে গেলেন, সুপারভাইজার রাকিবকে বুঝিয়ে দিলেন যে তাঁর সহকর্মীর কর্মদক্ষতা যাচাই করেই তাঁকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ রাকিবের কর্মদক্ষতা এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি, তাই তিনি পদোন্নতিও পাননি। কিন্তু বিষয়টি রাকিব মেনে নিতে পারলেন না। এর ফলে তাঁর কাজের ব্যাপারে তৈরি হলো অনীহা। যে কারণে অনেকটাই অমনোযোগী হয়ে গেলেন রাকিব। অন্য সহকর্মীকে সহযোগিতা করতে তাঁর আর ইচ্ছা তো করতই না বরং তাঁদের ভুলত্রুটি রাকিব সবার সামনে তুলে ধরে তাঁদের ছোট করতে লাগলেন।

এটা আসলে ছিল ধৈর্যহীনতার একটি সর্বজনীন উদাহরণ। কেউ আমার পছন্দমতো কথা না বললে, কাজ না করলে আমার নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ী না চললেই প্রচণ্ড রাগে আমার মাথা এলোমেলো হয়ে গেল। মনঃকষ্টে আমার নীতিমালা নষ্ট হয়ে গেল। সেই মানুষকে নিয়ে পরিহাস করা, কখনো লাগামহীন ভাষায় তাদের আক্রমণ করা, এসব যেন খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কারণ জানতে চাইলে খুব সহজে আমরা এর যথার্থতা বোঝাতে চেষ্টা করি। 

অভ্যাসে চাই পরিবর্তন

প্রথমত আসি আমাদের অভ্যাসবশত আচার–আচরণের বিষয়টাতে। আমাদের অভ্যাসে পরিবর্তন নিয়ে আসা কি সম্ভব? অবশ্যই তা সম্ভব। যদি আমরা আমাদের অভ্যাসে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারি, তবে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টাও তৈরি করা সম্ভব। আমরা আমাদের অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে পারি খুব সহজ একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে ওপরের উদাহরণটি নিয়ে যদি বলি, রাকিব একটু আত্মসচেতনতার সঙ্গে ভাবতে পারেন, এ বছর আমি যদিও পদোন্নতি পাইনি, সামনের বছর তো পেতেও পারি। কাজেই ভবিষ্যতে পদোন্নতির জন্য নিজের উন্নয়নে যা করা দরকার আমি তাই করব। এমন যদি হয় যে এই প্রতিষ্ঠানে রাকিবের কখনোই পদোন্নতি হওয়ার সুযোগ নেই, তবে রাকিব এমন করে ভাবতে পারেন, আমি এখানে পদোন্নতি পাই আর না পাই, আমার কাজ ও আচরণে সুনাম বাড়ানোর চেষ্টা করব। যা হয়তো আমাকে কোনো একদিন অন্য কোথাও একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে। কাজেই এই সুনাম অর্জন করতে আমার দরকার কর্মদক্ষতা বাড়ানো। সবাইকে সহযোগিতা করা এবং সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক টিকিয়ে রাখা। এ ভাবনাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কল্পনা করতে হবে আমি আমার আচরণে কী পরিবর্তন আনছি। 

আবার ধরুন, আমার অফিসের একজন সহকর্মীর সঙ্গে আমি প্রায়ই বিরক্ত হয়ে অথবা আক্রমণ করে কথা বলি। বিশেষ করে যখন সে নতুন কোনো পদ্ধতিতে কাজ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। এ ক্ষেত্রে আমি যদি আমার এই অভ্যাস বদলাতে চাই তবে আমি ভাবব সেসব মুহূর্তের কথা যখন আমার মনে সেই সহকর্মীর প্রতি সহানুভূতি তৈরি হয়েছিল। এই চিন্তা করতে গিয়ে আমার তখন আরও মনে হবে যে আমার সেই সহানুভূতিশীল আচরণটিকেই আমার বেশি পছন্দ করছি। এই পর্যায়ে এসে আমি আমার কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগাব। মনে মনে ভাবব যে আমি সেই সহকর্মীর মঙ্গল কামনা করি। তার জন্য এমন কিছু করছি যার ফলে সে হাসিখুশি থাকবে। কীভাবে কথা বললে বা বোঝালে সে মন খারাপ করবে না, বরং খুশি হয়ে পদ্ধতিগুলো মেনে নেবে সেটা ভাবতে হবে। এই ভাবনা বাস্তব করতে আমাদের স্বভাবে ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন একাধিকবার চর্চা করতে হবে। এভাবে কমপক্ষে ছয় সপ্তাহ ধরে চর্চা করার পর আমরা সুফল পেতে শুরু করব।

বিজ্ঞান কী বলে?

নিউরোসায়েন্স বলে, আমরা চাইলেই কোনো একটি বিষয়ের ওপর ফোকাস বাড়িয়ে এবং বারবার তা নিয়ে চিন্তা, কল্পনা ও চর্চার মাধ্যমে সেটাকে আমাদের অভ্যাসে পরিণত করতে পারি। মানুষের অভ্যাস এভাবেই তৈরি করা সম্ভব।

আমরা যারা ভাবি যে অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, তাদের জন্য বলি, এই নিয়ন্ত্রণ বিষয়টি আমাদের মধ্যে জেনিটিক্যালি অবস্থান করে। নিয়ন্ত্রণ এমনভাবে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে যে আমরা আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ রাখতে পারি কিন্তু নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া তার নিজ গতিতে চলতেই থাকে। আমরা যখন নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করি না, সেটাকেও মনোবিজ্ঞানের ভাষায় নিয়ন্ত্রিত আচরণ বলা হয়। তবে এই নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া শুরু হয় অভ্যাস তৈরি করা দিয়ে, যার জন্য আমাদের প্রয়োজন আত্মসচেতনতা।

লেখক: দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষক