ভাসা-ভাসা ভাষা

>

ভাষায় অযথা বাংলা ইংরেজির মিশেল করার দরকার নেই। মডেল: তারেক, রুহি ও আকাশ, ছবি: সুমন ইউসুফ
ভাষায় অযথা বাংলা ইংরেজির মিশেল করার দরকার নেই। মডেল: তারেক, রুহি ও আকাশ, ছবি: সুমন ইউসুফ

আমাদের ভাষাচিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন বাংলা যখন বলা হয়, বাক্যও যেন সমাপ্ত হয় না। বাংলার মধ্যে ঢুকে যায় ইংরেজি, ভাষাটা হয়ে যায় ‘বাংলিশ’। ফলে আমরা শুদ্ধভাবে না শিখছি বাংলা, না ইংরেজি। লিখেছেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। 

ক. 

গত কুড়ি বছরে আমাদের ভাষাচিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন সব ভাষাতেই আসে। যেহেতু পরিবর্তন ভাষার চরিত্রগত। তা ছাড়া এই কুড়ি বছরে দৃশ্য মাধ্যমের প্রাবল্য বেড়েছে, অন্তর্জালের বিপুল পৃথিবী এক ভিন্ন বাস্তবে আমাদের ঠেলে দিয়েছে—যে বাস্তব চিত্রময়, চিহ্নময়, যে বাস্তব চমকের। কুড়ি বছরে বাজার আমাদের শিক্ষার এবং চিন্তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে এবং বাজার জিনিসটাকে আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি বলে এর ভাষা দখলের চালগুলোও আমরা ধরতে পারিনি। বাজার কেন ভাষা দখল করবে? করবে এ কারণে যে ভাষা হচ্ছে যোগাযোগের প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। ভাষা দুর্বল হলে প্রকাশ দুর্বল হয়। যোগাযোগ অসম্পূর্ণ থাকে। ভাষার শক্তি চলে গেলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ফাঁক থেকে যায়। বাজার সেই ফাঁক ভরাট করে ফেলে তার তৈরি ভাষা দিয়ে। মানুষ তখন তার সক্ষমতাটা ধরে রাখতে পারে না।

খ. 

কুড়ি বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থী পূর্ণ বাক্যে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারত। দশটি বাক্য লিখলে অন্তত আটটি শুদ্ধ হতো। তার কাছে তথ্য তখন সহজলভ্য ছিল না। আজকের একজন শিক্ষার্থীর মতো সে তথ্যসমৃদ্ধ ছিল না। কিন্তু সে ভাষার সংস্কৃতিটা বুঝত। সীমিত তথ্য দিয়ে সে তার যা বোঝার বুঝে নিত, যা বলার তা বলে নিত, ব্যতিক্রম ছিল, কিন্তু এ ছিল সাধারণ চিত্র।

এখন বাংলা যখন বলা হয়, বাক্য সমাপ্ত হয় না। এখন ‘আসলে’ আর ‘কিন্তু’র ক্রাচ ছাড়া আমাদের ভাষা চলতে পারে না। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীকে দশটি বাংলা বাক্য লিখতে দিলে বেশ কিছু অশুদ্ধ থেকে যায়। এ হচ্ছে সাধারণ চিত্র, ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।

আমরা মাতৃভাষাটাকেই নিজেদের দখলে আনতে পারছি না। অন্য একটা ভাষা, যথা ইংরেজি, কীভাবে আয়ত্তে আনব। ফলে এখন ভারতীয় বা শ্রীলঙ্কার ব্যবস্থাপকেরা এসে বড় বেতনের চাকরিগুলো নিয়ে নিচ্ছে। তারা বাজারের ভাষাটা জানে, বাজার তাদের সমর্থন দেয়। আর ভাষা-দুর্বলতা নিয়ে আমরা পণ্য বাজারের ভোক্তা হই এবং বাজারের তৈরি একটা ভাষা ব্যবহার করি। এর নাম বাংলিশ।

মাতৃভাষা আয়ত্তে না এলে অন্য ভাষাও শুদ্ধ করে শেখা যায় না
মাতৃভাষা আয়ত্তে না এলে অন্য ভাষাও শুদ্ধ করে শেখা যায় না

একটি ভাষায় অন্য ভাষার শব্দ থাকে; এক ভাষা ধার করে অন্য ভাষা থেকে। কিন্তু সেই গ্রহণটা হয় প্রকাশ বৈচিত্র্যের জন্য, ভাষার পৃথিবীর বিস্তার ঘটানোর জন্য। গ্রহণ—অথবা ঋণ—আত্মীকৃত্য হয়ে যায়, যেমন হসপিটাল হয়ে যায় হাসপাতাল। কিন্তু যে বিদেশি শব্দের বিপরীতে দেশীয় একাধিক এবং প্রচলিত শব্দ থাকে, সেই শব্দ কেন ব্যবহার করব? কেন ভাষার ক্রিয়াপদ এবং বিশেষগুলো অন্য ভাষার হাতে তুলে দেব? বাংলিশ হচ্ছে চমকের জন্য ইংরেজি শব্দ ও পদের অকারণ ব্যবহার; বাংলায় ইংরেজি উচ্চারণের মেজাজটা ধরে এ রকম একটি তৃপ্তি নেওয়া যে আমি বাংলা বলছি বটে, কিন্তু ভাই, আমার ইংরেজিটাই বেশি আসে। ইংরেজরা যে ভাষা ব্যবহার করবে অনানুষ্ঠানিক আড্ডায়, তাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়ে আমরা একটা ভাসা ভাসা ভাষায় কথা বলে যাই।

বাংলাতে ইংরেজি শব্দ আসবে, অবশ্যই কিন্তু তার একটা অনিবার্যতা থাকবে, তাদের ব্যবহারটাও সীমিত থাকবে। কিন্তু বাংলিশে সেই অনিবার্যতা নেই, অথবা থাকলেও থাকে ভিন্ন মাত্রা, যেন কেউ পণ করে ফেল যে ইংরেজির চমকটা না দেখালে বাংলাটা খুব ‘আনস্মার্ট’ হয়ে যাবে। আমাদের এফএম রেডিওগুলো বাংলিশটাকে বৈধতা দিয়ে দিলে বাংলিশওয়ালাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

এই যে আমরা না শিখতে পারছি বাংলা, না ইংরেজি, এতে লাভটা তুলে নেয় বাজার। কারণ, প্রকাশের সক্ষমতা না থাকায় আমরা চমকটাকে সার ভেবে ওই বাজারের দাবিগুলোর কাছে নিজেদের সক্ষমতা বন্ধক দিয়ে দিই। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের ভাষায় যে নৈরাজ্য, যে বিশৃঙ্খলাও তার প্রভাব পড়ে আমাদের জীবনাচরণে। আমাদের কাজেও এখন শৃঙ্খলা নেই। বাংলিশ বাজারই তৈরি করেছে। এর উদ্দেশ্য আমাদের ভাষা-অক্ষম করে আমাদের ভোক্তা করে রাখা। যারা ভাষার শক্তিটা কাজে লাগায়, তারা এর প্রতিরোধ করে। অথবা বাজার থেকে ফায়দা তুলে নেয়, যেমন নানা দেশ থেকে আসা আমাদের দেশের করপোরেট বাজারের ব্যবস্থাপকেরা।

যদি বুঝতাম, বাংলিশের অবস্থান ভাষার অনেক রূপের মাত্র একটি, তাহলে আপত্তি ছিল না। কিন্তু আমাদের ভাষা ব্যবহার তালগোল পাকিয়ে গেছে। আঞ্চলিক ভাষাগুলোও স্বাতন্ত্র্য হারাচ্ছে। এখন মিডিয়ার ভাষা, ঢাকা-র ভাষা, রাজত্ব করছে। এই ভাষাও তো তৈরি করা। এই ভাষাও, মনে রাখতে হবে বাজারের তৈরি। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এক ভাষা হলে যে সামান্যীকরণ হয়, তাকে পশ্চিমের আগ্রাসী ম্যাকডোনাল্ডাইজেশনের সঙ্গে তুলনা করা যায়। বৈচিত্র্য না থাকলে সবাই একই খাবার খাবে, একই বিনোদন চাইবে এবং একসময় একই চিন্তা করবে। মন্দ কী?

এই ভাষার মাসে একটু ভাবতে হবে আমাদের। বাংলা ভাষার সব রকমের রূপকে আমরা সম্মান করব। কিন্তু যে রূপটি আমাদের প্রকাশ–কুশলতা কেড়ে নেয়, যা আমাদের উদ্ভাবক না করে ভোক্তা বানায়, তা যতই চমকের হোক, এর উত্থান নেই। শুধু একটা আপাতবিস্তার ছাড়া।

গ্রামের কৃষক এখনো তাঁর ভাষা ধরে রেখেছেন। ভয় হয় একদিন বাজারের ভাষা তাঁকেও গ্রাস করবে। 

তাঁর থেকেও আমি শিখতে পারি, ইংরেজির আগ্রাসনে না পড়ে তিনি কীভাবে তাঁর ভাষাটাকে ব্যবহার করে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ।