সাধারণ তাপসের অসাধারণ উদ্যোগ

তাপস রাহার বেকারি ‘মায়ের দান’। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
তাপস রাহার বেকারি ‘মায়ের দান’। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

খুন, ধর্ষণ, লুটপাট ইত্যাদি নেতিবাচক খবর শুনতে শুনতে আমাদের মনের ওপর যখন চাপ বাড়তে থাকে, যখন আমরা ভাবতে থাকি সমাজটা গেল রসাতলে, তখনই কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো মানুষ প্রমাণ করেন, আসলে মানুষ মানুষেরই জন্য। তখন আবার ভরসা জাগে মানুষের ওপর। তেমনি একজন ভরসা–জাগানিয়া মানুষ থাকেন খুলনার ডুমুরিয়ায়। তিনি ছোট্ট একটি ব্যবসা করেন। তাঁর নাম তাপস রাহা।

‘এই দোকান থেকে প্রতি মাসে ৩০ জন গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীর জন্য তিনটি খাতা, একটি করে কলম ফ্রিতে দেওয়া হয়।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রথম একটি ব্যানারের ছবিতে চোখ আটকে গিয়েছিল। এরপর খুলনা গিয়ে ব্যানারে থাকা নাম ও ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে দেখা করতে গিয়েছি ডুমুরিয়া বাজারে, তাপস কুমার রাহার কর্মস্থলে। এক সন্তানের জনক তাপস মূলত বেকারির মালিক। মালিক হলেও শ্রমিকদের সঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে ময়দা মাখেন, গরম চুল্লিতে থরে থরে ট্রে সাজিয়ে কেক ও বিস্কুট তৈরি করেন, নকশা ফুটিয়ে তোলেন কেকের ওপর। সেই সঙ্গে বেকারির কর্মচারীদের সুখ–দুঃখের কথা শোনেন। তাঁর বেকারির সামনের টেবিলে থরে থরে সাজানো খাতা–কলম। এগুলো বিক্রির জন্য নয়, উপহার দেওয়ার জন্য।

৩০ থেকে ৫০
শুরুটা ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে। সে বছর থেকে ৩০ জন দরিদ্র শিক্ষার্থীকে প্রতি মাসে একটি করে বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক খাতা ও একটি কলম দেওয়া শুরু করেন তিনি। সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা যেন নতুন খাতার সাদা চকচকে পাতায় আনন্দের সঙ্গে লিখতে পারে, এই ছিল ভাবনা। স্থানীয় শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে তাপস খুঁজে বের করেন দরিদ্র পরিবারের শিশুদের। দরিদ্র শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরাও যোগাযোগ করেন তাঁর সঙ্গে। এভাবে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সালের শুরুতে উপকরণের সংখ্যা বেড়ে যায়, উপহার পাওয়া শিশুর সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ থেকে ৫০ জনে।

বেকারিতে কাজ করছেন তাপস। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
বেকারিতে কাজ করছেন তাপস। ছবি: সাদ্দাম হোসেন



দারিদ্র্যের আশীর্বাদ
দারিদ্র্যের সঙ্গে বসতি ছিল তাপস রাহার পরিবারের। টাকাপয়সার ঘাটতি মেটাতে বিভিন্ন কাজ করতে হয়েছে তাঁর বাবা শান্তিপদ রাহাকে। অবশেষে ডুমুরিয়া বাজারে মায়ের দেওয়া জমিতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘মায়ের দান’ নামের একটি ছোট্ট বেকারি। সেখানে শুধুই বিস্কুট বানানো হতো। অংশীদারি ভিত্তিতে তিনি এ ব্যবসা চালাতেন। এ কারখানার সামনে কিছুটা বাড়তি উপার্জন করে বাবাকে সহায়তা করার জন্য তাপস রাহা বিভিন্ন বেকারি থেকে ভাঙা বিস্কুট কম দামে কিনে এনে বিক্রি করতেন, স্কুলের পরে। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে অংশীদারের বিশ্বাসঘাতকতায় নিজের অংশীদারি ব্যবসায় শান্তিপদ রাহা মার খেলে পরিবারে অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসে চরমভাবে এবং কারখানাটি বন্ধ করতে বাধ্য হন তিনি। এরপর কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে দিন কাটতে থাকে শান্তিপদ রাহার আট সদস্যের পরিবারটির। এ সময় তাপস রাহা টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও পরিবারের অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে পড়াশোনা বন্ধ করার কথা ভাবেন নিজেই। পরিবারকে সহায়তা করার জন্য তিনি ব্যবসা শুরু করেন বাবার বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকান খুলে। মূলত বিভিন্ন বেকারি থেকে ভাঙা বিস্কুট কম দামে কিনে এনে বিক্রি করতে থাকেন তাপস। এরপর এক দশকের বেশি সময় ধীরে ধীরে শ্রম দিয়ে দাঁড় করিয়ে ফেলেন নিজের ছোট্ট বেকারি। বাবার দেওয়া নামটি পরিবর্তন করেননি দোকানের। চার ভাইয়ের মধ্য মেজ ভাই ছাড়া বাকি সবাই তাঁকে সহায়তা করেন। তবে বড় ভাই এবং তাপস রাহা নিজে লেখাপড়া করার সুযোগ না পেলেও ছোট ভাইকে লেখাপড়া করিয়েছেন। তিনি এখন ঢাকায় চাকরি করেন।

খাতা ও কলম দেওয়া হচ্ছে বিনা মূল্যে। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
খাতা ও কলম দেওয়া হচ্ছে বিনা মূল্যে। ছবি: সাদ্দাম হোসেন



কেন এমন উদ্যোগ নিলেন
শিশুকাল থেকেই লেখাপড়া করতে ভালোবাসতেন তাপস। বছরের শুরুতে যখন নতুন বই দেওয়ার সময়, তখন কোনো একবার স্কুল থেকে জানানো হয়েছিল, টাকা দিলে নতুন বই দেওয়া হবে, না দিতে পারলে পুরোনো বই দিয়ে লেখাপড়া করতে হবে। দারিদ্র্যের কারণে বাবাও করতে পারেননি অর্থের ব্যবস্থা। স্মৃতি হাতড়ে তাপস জানান, সম্ভবত ৫০ টাকা না দিতে পারায় পুরোনো বই বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির পথে ছুটে এসেছিলেন ১০–১২ বছরের তাপস। কিশোর তাপসের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল সেই ঘটনা। দারিদ্র্যকে হার মানিয়ে যখন কিছুটা স্বাবলম্বী হলেন অর্থনৈতিকভাবে, তখন ভাবলেন, এবার কিছু করা যাক। অনেকে মানুষের জন্য অনেক কিছু করলেও তিনি বেছে নিলেন শিশুদের শিক্ষা উপকরণ দেওয়ার পথ। নিজের অতীতের কথা ভেবেই হয়তো। সিদ্ধান্ত নিলেন, হঠাৎ হঠাৎ দু–একজনকে একটু সহায়তা করে কিছু হবে না। সহায়তা হতে হবে ধারাবাহিক। তাতে অনেক মানুষের উপকার করা না গেলেও সমস্যা নেই। সে কারণেই ছোট পরিসরে শুরু করলেন প্রথমে।

এ জন্য নিজেই কৃচ্ছ্রসাধন শুরু করেন তাপস। হাতখরচের টাকা বাঁচাতে থাকেন তিনি। নিজের একান্ত প্রয়োজন আর শরীরচর্চা ছাড়া কোনো কিছুতে টাকা খরচ করেন না তিনি। সেই টাকা বাঁচিয়ে প্রতি মাসে গরিব শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেন খাতা-কলম। খোঁজ নেন লেখাপড়ার। কেউ ভালো ফল করলে একটু বেশি টাকা খরচ করে উৎসাহ দিতে স্কুলের পোশাক, ব্যাগ, ফাইলসহ নানা ধরনের শিক্ষা উপকরণও দেন তিনি উপহার হিসেবে। আর নিজের বেকারি থাকায় বিস্কুট খেতে দেন একেবারে ফ্রিতে। তাতে শিশুরা খুশি হয়, লেখাপড়ায় মনোযোগী হয় বলে জানান তাপস। আর্থিক অনটনে না পড়লে বছরখানেকের মধ্যে খাতা–কলম দেওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যায় সেঞ্চুরি করতে চান তিনি।

৫০ জন দরিদ্র শিশু নিয়মিত বিনা মূল্যে পেয়ে থাকে খাতা, কলম এবং প্রয়োজন হলে বই। শিশুদের সংখ্যা দ্রুতই ১০০ ছাড়িয়ে যাবে। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
৫০ জন দরিদ্র শিশু নিয়মিত বিনা মূল্যে পেয়ে থাকে খাতা, কলম এবং প্রয়োজন হলে বই। শিশুদের সংখ্যা দ্রুতই ১০০ ছাড়িয়ে যাবে। ছবি: সাদ্দাম হোসেন



আমারও একটি ছেলে আছে
‘আমার বাবাকে সবাই ভালো মানুষ বলে।’ খুলনার আঞ্চলিক টানে বললেন তাপস। জানালেন, অন্য লোকে তাঁর বাবাকে ‘ভালো মানুষ’ বললে বড় আনন্দ হয় তাঁর। নিজেরও একটি ছেলে আছে তাপসের। কথার ফাঁকে হা হা করে হেসে উঠে তিনি জানালেন, তাঁর ছেলেও যেন মানুষের কাছে শোনে ‘তার বাবা ভালো মানুষ ছিলেন।’

শুধু শিশুদের শিক্ষা উপকরণ দেওয়াই নয়, কেউ অসুস্থ হলে ডাক্তার ডাকতে, কারও রক্তের প্রয়োজন হলে নিজে রক্ত দিতে কিংবা রক্তদাতা খুঁজে দিতে, মৃতের সৎকার করতে বা মৃতদেহ বইয়ে নেওয়ার কাজে নেতৃত্ব দিতে সবার আগে ডাক পড়ে তাপসের। তিনি নিজেও রাত–দিন উপেক্ষা করে এসব কাজ করতে দ্বিধা করেন না।

নিজের বেকারিতে কেক সাজাচ্ছেন তাপস রাহা। ছবি: সাদ্দাম হোসেন
নিজের বেকারিতে কেক সাজাচ্ছেন তাপস রাহা। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

বিস্তর আড্ডার পর যখন উঠতে যাব, তখন বেকারিতে এল তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া আলপনা রানি। গত দুই বছর থেকে তাপসের কাছ থেকে খাতা-কলম উপহার পাচ্ছে সে। আলপনার বাবা মাছের ঘেরে পাহারাদার হিসেবে কাজ করেন। শুধু আলপনা নয়, ভ্যানচালক ছদরুলের ছেলে ও তাঁর বড় ভাইয়ের মেয়ে দুজনই তাপসের কাছ থেকে খাতা–কলম পেয়ে আসছে নিয়মিত। এ রকম আরও আরও অনেক মানস বৈরাগী, কুমারেশ, মোজাফফরের মতো মানুষের ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছেন তাপস রাহা।