নিয়ম মেনে গাড়ি চালান

গাড়ি চালানোর সময় নিয়ম মেনে চলা জরুরি। ছবি: অধুনা
গাড়ি চালানোর সময় নিয়ম মেনে চলা জরুরি। ছবি: অধুনা

প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। সেখানে চলাচল করে ৪০ লাখের বেশি গাড়ি। স্বল্প পরিসরে অপর্যাপ্ত রাস্তায় এত বিপুলসংখ্যক গাড়ির সুষ্ঠু চলাচলের জন্য সবার আগে প্রয়োজন গাড়িচালকের সচেতনতা ও নিয়মানুবর্তিতা। তাহলে দুর্ঘটনা যেমন কমে আসবে, সড়কেও ফিরবে শৃঙ্খলা। তাই গাড়ি চালানোর সময় কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। 

রক্ষণাত্মক গাড়িচালনা রপ্ত করুন
ব্যস্ত কোনো রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় অবশ্যই রক্ষণাত্মক থাকবেন। আপনি হয়তো গাড়ি চালনায় পটু, কিন্তু আপনি জানেন না পাশের লেনের যে গাড়িটা আপনাকে ওভারটেক করতে চাইছে, সেই গাড়ির চালক গাড়িচালনায় দক্ষ কি না। 

ধরে নিন আপনি ছাড়া রাস্তায় অন্য কোনো দক্ষ গাড়িচালক নেই, তাই সব সময় সাবধান থাকুন। গতি নিয়ন্ত্রণে রাখুন। লেন পরিবর্তনের সময় যথেষ্ট জায়গা আছে কি না, দেখে নিন এবং অবশ্যই ইন্ডিকেটর (নির্দেশক) ব্যবহার করুন। 

গাড়ির চাকা কোন দিকে ঘুরে আছে, তা খেয়াল রাখবেন। রাস্তায় কোনো পথচারীকে পার হতে দেখলে তাকে আগে যেতে দিন। ওভারব্রিজ ব্যবহার করছে না বলে তাকে শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব আপনার নয়, অন্তত গাড়ি চালানোর সময় তো নয়ই। বরং আপনার দক্ষতায় নিশ্চিত দুর্ঘটনার হাত থেকে কোনো পথচারী বেঁচে গেলে সেটা আপনার কৃতিত্ব। বৃষ্টির সময় গাড়ি চালাতে অধিক সাবধানে থাকতে হবে। ভেজা রাস্তায় জোরে ব্রেক কষলে চাকা পিছলে যাওয়ার (স্কিড করা) আশঙ্কা থাকে, যা দুর্ঘটনার একটি বড় কারণ। অন্য কোনো চালক কোনো অনিরাপদ বা অন্যায় করলে তাকে অনুসরণ নয়, বরং এড়িয়ে চলুন।

আপনার সামনে মালবাহী বড় ট্রাক বা কার্গো গাড়ি থাকলে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখুন। কতটুকু দূরত্ব বজায় রাখবেন, সেটার একটা সঠিক (স্ট্যান্ডার্ড) হিসাব আছে। আপনি ঘণ্টায় যত কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন, নিরাপদ দূরত্ব হবে মিটার এককে তার ঠিক অর্ধেক। ধরুন আপনার গাড়ির গতি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার, সে ক্ষেত্রে সামনের গাড়ির সঙ্গে আপনার নিরাপদ দূরত্ব হবে ৫০–এর অর্ধেক অর্থাৎ ২৫ মিটার। 

রাতে একটানা গাড়ি চালাবেন না, প্রয়োজনে থামুন। রাতে গাড়ি চালানোর সময় যাত্রাসঙ্গীর সঙ্গে কথা বলুন, হালকা ভলিউমে গান শুনুন। কোনো অবস্থাতেই ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালাবেন না। ঘুম এলে রাস্তার পাশের কোনো দোকান থেকে এক কাপ চা খেয়ে নিতে পারেন। চাইলে গাড়ি নিরাপদ কোথাও থামিয়ে একটু ন্যাপ (স্বল্পমেয়াদি ঘুম) নিতে পারেন। 

রাস্তায় বেরোনোর আগে
রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার সময় ফুয়েল ট্যাংক পরীক্ষা করে নিন। পর্যাপ্ত জ্বালানি না থাকলে আপনার প্রথম গন্তব্য হোক ফুয়েল পাম্প। গাড়ির চাকায় হাওয়া আছে কি না, পরীক্ষা করে নিন। রেডিয়েটর আর ব্যাটারিতে পানি আছে কি না দেখে নিন। অবশ্যই গাড়িতে পানি রাখবেন, সেটি নিজে পান করার জন্যই হোক আর রেডিয়েটরে ঢালার জন্যই হোক। সব বাতি পরীক্ষা করে নিন, হাই বিম জ্বলে থাকলে তা বন্ধ করুন। গাড়িতে কোনো আবর্জনা থাকলে তা আগেই ফেলে দিয়ে ভেতরটা পরিষ্কার করে নিন।

লম্বা ভ্রমণের আগে কিছু খেয়ে নিন। খালি পেটে কিংবা অতিরিক্ত ভরা পেটে গাড়ি চালানো উচিত নয়। গাড়ির সব কাগজপত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স সঙ্গে রাখুন। এসব কাগজপত্র এমন কোথাও রাখবেন, যেন যেকোনো প্রয়োজনে তা সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। বাইরে দুই পাশের আয়না এমনভাবে ঠিক করে নিন, যেন পেছনে ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত আপনি দেখতে পারেন। রিয়ার ভিউ মিররও এমনভাবে সেট করে নিন, যেন ঘাড় বেশি না ঘুরিয়েই তা দেখতে পান। গাড়ির পেছনের গ্লাসে এমন কিছু না লাগানোই ভালো, যা রিয়ার ভিউ আয়নার দৃষ্টি ব্যাহত করতে পারে। যদি আপনি চোখে চশমা ব্যবহার করেন, তাহলে আন্টি-রিফ্লেক্টিভ গ্লাস ব্যবহার করুন। এতে দূরের জিনিস দেখতে এবং অতিরিক্ত আলোতে সমস্যা হবে না। 

একাধিক কাজ এই সময়ে নয়
গাড়ি চালানোর সময় ফোনে কথা বলা সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণগুলোর একটি। কোনো অবস্থাতেই গাড়ি চালানোর সময় মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটে, এমন কোনো কাজ করবেন না। জরুরি ফোন এলে গাড়ি পার্ক করে কথা বলুন অথবা পরে কল ব্যাক করুন। এমন শব্দে গান শুনবেন না, যাতে পাশের গাড়ির হর্ন আপনি শুনতে না পান। গাড়ি চালানোর সময় ভিডিও দেখবেন না। 

এসির তাপমাত্রা পরিবর্তন অথবা রেডিওর চ্যানেল পাল্টানোর সময় সাবধান থাকবেন। গাড়ি চালানোর সময় সব ধরনের খাওয়াদাওয়া থেকে বিরত থাকুন। পায়ের কাছে কিছু পড়ে গেলে অবশ্যই গতিতে থাকা অবস্থায় তা ওঠানোর চেষ্টা করবেন না। 

অন্যের বিরক্তির কারণ হবেন না
ধরুন, আপনি একটা বড় সিগন্যালের পেছন থেকে একেবারে সামনে চলে এসেছেন, মোড়টা পার হতে যাবেন, ঠিক তখনই বেরসিক ট্রাফিক পুলিশ হাত উঁচিয়ে আপনাকে থেমে যেতে বললেন। বিরক্ত হলেও কখনই ট্রাফিক পুলিশের সিগন্যাল অমান্য করে রাস্তা পার হয়ে যাবেন না, এতে যানজট অথবা দুর্ঘটনা—দু-ই ঘটতে পারে। 

বাংলাদেশের গাড়িচালকেরা কোনো এক বিচিত্র কারণে হর্ন বাজাতে খুব পছন্দ করেন। হর্ন বাজাতে তেল খরচ হলে বোধ করি বাংলাদেশের রাস্তায় এত শব্দদূষণ হতো না। অনেক দেশে হর্নের শব্দ একটি দুর্লভ বস্তু। তারা মনে করে, কারও উদ্দেশে হর্ন বাজানো মানে তাকে একপ্রকারের অপমান করা। মনে রখবেন, নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া হর্ন বাজানো একধরনের অভদ্রতা। আর হ্যাঁ, নিজের রাগ হর্নের ওপর ঝাড়বেন না। আর কোনো অবস্থাতেই গাড়িতে হাইড্রোলিক হর্ন লাগাবেন না। 

রাতে গাড়ি চালানোর সময় ভেতরের আলো বন্ধ রাখা উত্তম। আমরা প্রায়ই গাড়িতে কিছু খেয়ে বা ব্যবহার করে উচ্ছিষ্টটুকু রাস্তায় ফেলে দিই, যা অবশ্যই উচিত নয়। গাড়িতে সব সময় টিস্যু এবং ছোট বাক্স–জাতীয় কিছু রাখবেন ময়লা ফেলার জন্য। পাশের গাড়ির চালকের সঙ্গে ঝগড়া করা আমাদের রাস্তাগুলোর একটি পরিচিত দৃশ্য, যা মোটেই সমীচীন নয়।

খালিদ মাহমুদ
সহকারী পরিচালক (প্রকৌশল), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)