এক সফল ও অনুপ্রেরণীয় মা ও মেয়ের গল্প


গুলশানের ঝাঁ চকচকে শপিং মলগুলোর মধ্যে আলাদা করে চোখে পড়ে এমসিসি বিল্ডিং এর নাবিলা লেখা বিশাল ব্যানার। লেকের পাড় থেকে নাবিলা এইখানে এসেছে তাও তিন বছর। শো রুমের ভেতর আরও চমকপ্রদ। সারি ধরে সাজানো ঝলমলে পোশাক, গহনা, প্রাচীন কারুকাজের দরজা আয়না রাজকীয় প্রাসাদের সাজঘরের অনুভূতি জাগায়।

নাবিলা দুই নারীর প্রতিষ্ঠান। মা শামীমা নবী ২০০৫ সালে মেয়ের নামে শুরু করেন নাবিলা শাড়ির ব্র্যান্ড। সেই মেয়ে নাবিলা নবীই এখন বড় হয়ে হাল ধরেছেন মায়ের সঙ্গে। নারী দিবসে এই দুই অনুপ্রেরণীয় নারীর গল্প শোনা যাক-

শামীমা নবী তার যুগের নারীদের তুলনায় অনেক আলাদাই ছিলেন বলতে হয়। মাত্র ২১ বছর বয়সে স্বামীর সঙ্গে তিনি শুরু করেছিলেন গার্মেন্টসের ব্যবসা। ব্যবসা ভালোই চলতো। একটি ছেলে হলো, তাকে নিয়েই দাপিয়ে কাজ করতেন শামীমা। তবে বাধ সাধল মেয়ের জন্মের পরে। বাংলাদেশের সামাজিক ব্যবস্থায় কন্যার নিরাপত্তার কথা ভেবে শামীমাকে ছাড়তে হলো বাইরের কাজ।

শামীমা বলেন, ‘আমি এত কম বয়স থেকে নিজে কামাই যে বাড়িতে বসে থাকাটা আমি মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। নাবিলা যখন একটু বড় হলো, আমি একটা বুটিক করার চিন্তা করলাম’।

সে সময় ঘরে ঘরে বুটিক। নারীরা সবাই চাচ্ছেন কিছু একটা করতে। অনেকেই শুরু করেন কিন্তু টিকে থাকতে পারেন না, ফলে সমাজে এসব কিছু করতে চাওয়া নারীদের বিদ্রূপও কম শুনতে হত না। শামীমা ভাবলেন, বড় করে কিছু একটা করবেন। বড় একটা ব্র্যান্ড, যেন তার টিকে থাকা নিয়ে কেউ প্রশ্ন না তুলতে পারে। তার দ্বিতীয় একটি স্বপ্ন ছিল দেশীয় কাঁচামাল নিয়ে দেশীয় পণ্য তৈরি করবেন। কিন্তু ঠিক যেই শ্রেণির মানুষদের লক্ষ্য করে শামীমা কাজ করতেন, তাঁরা দেশি থেকে বিদেশি পণ্যেই আগ্রহী ছিল। জেদ ছাড়লেন না শামীমাও। পহেলা বৈশাখ, ঈদ প্রভৃতি উপলক্ষে ঠিক দেশি পণ্যের একটি পসরা নিয়ে আসতেন।

কর্মজীবী প্রত্যেক মায়ের মতো শামীমা চেষ্টা করেছেন, মেয়েকে সর্বোচ্চ শিক্ষাটা দিতে। নাবিলা অস্ট্রেলিয়া থেকে আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন। ভিক্টোরিয়া কোর্টে প্র্যাকটিসও করেছেন, কিন্তু যার নামে নাবিলার নাম, সে কি আর নাবিলা থেকে দূরে থাকতে পারে? 

নাবিলা বলেন, ছোটবেলায় দেখতাম মা একা হাতে ঘরে বাইরে সব সামলাচ্ছেন, যত বড় হয়েছি বুঝেছি মায়ের ঠিক কতটা কষ্ট হচ্ছে। আমি আইনে লেখাপড়া করলেও, মন সবসময় বলতো আমি তো নাবিলার নাবিলা। অস্ট্রেলিয়ায় আমার মতো আইনজীবী অনেক আছে। কিন্তু দেশে নাবিলাকে এগিয়ে নিতে হলে আমাকে ফিরতেই হবে।

বাংলাদেশের একটা ব্র্যান্ড তৈরি হবে এই বোধ থেকে নাবিলা বদলে ফেলেন পড়ার বিষয়। তিনি এখন পিএইচডি করছেন বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে। মাঝে পড়াশোনা করেছেন ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়েও।

নাবিলার নাবিলা হলেও মায়ের ব্যবসাটায় ঢোকা খুব সহজ ছিল না, শামীমা নবীর কড়া নির্দেশ ছিল- কাজ করতে হলে, একদম সেলাই থেকে শুরু করে বিপণন পর্যন্ত সব শিখে আসতে হবে। জীবনে সবচেয়ে কঠোরতম বসের আদেশ মেনে সবটাই করেছেন নাবিলা।

মায়ের ব্যবসায় মেয়ের প্রবেশের পরে অমূলে বদলে গেছে নাবিলা। শামীমা নবী বলেন, সময়ের বদলে আমি যেন অনেক পিছিয়ে যাচ্ছিলাম। নতুন যুগের প্রচারণা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি নিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলাম। মেয়ে এসে সবটার হাল ধরে। আমরা নতুন করে গুলশান অ্যাভিনিউতে আউটলেট নেই, নতুন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাজাই।

একটা সময় ছিল বাংলাদেশের মানুষ খুঁজত বিদেশী ব্র্যান্ড, এখন মারিয়া বি, টিনা দুরানির মতো ব্র্যান্ডগুলো কাজ করতে চান নাবিলার সঙ্গে। শামীমা নবীর কাজ করা জামদানির শাড়ি, জ্যাকেট লেহেঙ্গার বিপুল চাহিদা দেশ ও বিদেশে। তিনি বলেন, ‘আমি শুরুতে একটা বড় কারখানা তৈরি করেছিলাম, দেশি পোশাকের চাহিদা না থাকায় গুটিয়ে নিয়েছিলাম এখন সেটিকে বড় করেছি। চাহিদা এখন একটাই বেড়েছে যে, এটা আরও বড় করা দরকার বলে মনে করছি’।

ব্র্যান্ড তৈরির ব্যাপারে খুব সচেতন নাবিলাও। তিনি বলেন, আমরা যদি পোশাক তৈরি করতে পারি ব্র্যান্ড কেন পারব না?

নাবিলার এখন তিনটি শো রুম উত্তরা, গুলশান ও ধানমণ্ডি। সেখানে সেলস অ্যাডমিন সব পর্যায়েই নারীদের দৃপ্ত বিচরণ। কারখানাতেও কাজ করেন নারীরা। ‘কেউ যদি বাড়ি বসে ডিজাইনের কাজ করতে চান সে সুযোগ দেই।  আমি চাই না ঘরের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো নারীর কাজ বন্ধ হয়ে যাক।’ বলেন শামীমা।

শামীমার স্বপ্ন নাবিলা ব্র্যান্ড যাবে প্যারিস, লন্ডনে। বড় বড় ফ্যাশন প্যারেডে মডেলরা পরবে নাবিলার পোশাক। এই স্বপ্ন নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন মা ও মেয়ে।