ফ্যাশনে করোনার প্রভাব

বারবেরি ব্র্যান্ডের পোশাকে
বারবেরি ব্র্যান্ডের পোশাকে

ফ্যাশনের চার রাজধানী নিউইয়র্ক, লন্ডন, মিলান ও প্যারিস ফেব্রুয়ারিজুড়ে ছিল আলোচনায়; প্রতিবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো ফ্যাশন উইক: হেমন্ত-শীত ২০২০ বা ফল ২০২০। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ততটা না হলেও যুক্তরাজ্যের লন্ডন থেকে করোনা-জুজু পিছু নিয়েছে। ডিজাইনাররাও করোনার অনুষঙ্গ রানওয়েতে হাজির করেছেন। অনেক ডিজাইনারের তৈরি পোশাকসম্ভারের ক্যাটওয়াকে মডেলদের মাস্ক পরতে দেখা গেছে। ফ্যাশন শো বাতিলও হয়েছে। এমনকি চীনের শীর্ষ সারির কোনো ডিজাইনার আসেননি প্যারিসে। সব মিলিয়ে বেশ আতঙ্কই বিরাজ করেছে ফ্যাশনের জমজমাট স্থানগুলোতে।

বারবেরি ব্র্যান্ডের পোশাকে
বারবেরি ব্র্যান্ডের পোশাকে

এবারের ফ্যাশন উইকে নানা সমকালীন বিষয় উঠে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তন থেকে ব্রেক্সিট, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তি—সবই ছিল রানওয়েতে। প্রথমবারের মতো কার্ল লেগারফেল্ড উদ্ভাবনী সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন এমিলি অ্যাডামস বোর্ড। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচনায় ঘুরেফিরে আসছে মৌসুমভিত্তিক ফ্যাশন উপস্থাপনার যৌক্তিকতা। এবার এর ব্যত্যয় ঘটেনি। যাহোক, চারটি ফ্যাশন উইকের পর্যালোচনায় একেবারে শেষ থেকেই শুরু করা যাক—

প্যারিসজুড়ে ছিল করোনাভাইরাস আর জলবায়ু পরিবর্তন। মিলানের আসর শেষে ফ্যাশনপ্রিয়রা পা রাখেন প্রিয় পারিতে। ফলে করোনা নিয়েই ছিল যত আলোচনা। ফ্যাশন সাময়িকী ভোগ–এর সম্পাদক আনা উইন্টর ইতালির মিলান থেকে সোজা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে স্বেচ্ছানির্বাসনে গেছেন। কারণ, তত দিনে ইতালির অবস্থা সঙিন করোনা–সংক্রমণে। তাঁর মতোই মিলান থেকে ফিরে গেছেন জর্জিও আরমানি। আসেননি তাঁর প্রিয় শহর প্যারিসে। এমনকি বাতিল করেছেন ফ্যাশন শো।

অনুষঙ্গের নকশাতেও ভিন্নতা
অনুষঙ্গের নকশাতেও ভিন্নতা

আতঙ্ক আর তা উপশমে মুখোশ ও হাত নির্বিষ করার উপকরণের পাশাপাশি আবহাওয়া ভারী করার জন্য যথেষ্ট ছিল জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক অবিচার, রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে সৃজনশীল উপস্থাপনা। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় ব্যালাঁসিয়াগা আর বালমেঁর কথা। এই হাউসের জন্য দেমনা ভাসালিয়ার উপস্থাপনায় ছিল বিনাশী দর্শন। রঙের খেলা তো ছিলই। আরও ছিল পৃথিবী বদলে যাওয়া ভয়ংকর আগামীকে দেখিয়ে দেওয়া। তাই তো মঞ্চ প্লাবিত করেছেন জলে। মনে হতে পারে সমুদ্রপৃষ্ঠ উঠে যাওয়ার ফল এই অবশ্যম্ভাবী প্লাবন। সাধারণ মডেল নয়, তিনি নেন সব জিমন্যাস্টকে। ডিওরও শুনিয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা, যা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের কুফল হিসেবে দেখানো হয়েছে। অলিভিয়ের রোসটাং, বালমেঁর ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর। বেড়ে ওঠা বোখদোর এতিমখানায়। তিনি জানেন জীবনসংগ্রাম। জানেন শ্রেণিবিভাজন। তাই পৃথিবীজুড়ে উচ্চবিত্তের ১ শতাংশের বাইরে নিয়ে এসেছেন এবারে সৃষ্টি। শত সমস্যা আর বিভেদে জর্জড়িত পৃথিবী তো আসলে এক মিলনক্ষেত্রও। এই সত্য প্রতীয়মান করেছেন ইসে মিয়াকি; তাঁর সৃজনে প্যারিসের আসরকে দিয়েছেন অনাবিল প্রশান্তি, কাঙ্ক্ষিত স্বস্তি।

মিসোনির পোশাকে মডেলরা
মিসোনির পোশাকে মডেলরা

মিলান
এবারের ফ্যাশন উইকে করোনা-ঝঞ্ঝাটের মধ্যে ছিল নতুন সেতুবন্ধের সুবাতাস। মিউসিয়া প্রাদার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেন র​্যাফ সিমন্স। তিনি যোগ দিলেন প্রাদার সহসৃজনশীল পরিচালক হিসেবে। সপ্তাহজুড়ে আলোচনায় থাকল এই খবর। এবারের আসর শুরু হয় গুচির জন্য আলেসান্দ্রে মিশেলের শো দিয়ে। পর্দা নামে শূন্য প্রেক্ষাগৃহে আরিমানির আয়োজনে। করোনা–আতঙ্কই তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনুঘটক হয়েছে। প্রাদার কাজে ছিল সংস্কৃতির প্রেরণা। মারনির সংগ্রহে ছিল অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড–এর অনুসরণ। স্বাধীনতা আর মুক্তির বাণী উপজীব্য হয়েছে ফেন্দির সংগ্রহে। করোনার ক্রান্তিকালে ডলচে অ্যান্ড গ্যাবানা উদ্​যাপন করেছেন কারুশিল্পী আর হস্তশিল্পীদের সৃজননৈপুণ্য। উপস্থাপিত হয়েছে সৃষ্টির সেই সৌন্দর্য।

প্রাডার কালো ও বাদামি রঙের প্রাধান্য
প্রাডার কালো ও বাদামি রঙের প্রাধান্য

লন্ডন
লন্ডন কি খুব একটা প্রণোচ্ছল ছিল এবার? কারণ, মনে হয়েছে সর্বত্রই যেন বিষাদের কুয়াশায় আচ্ছন্ন। ভিভিয়েন ওয়েস্টউড আবির্ভূত হয়েছেন প্রতিবাদী ভূমিকায়। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তির দাবি তিনি তুলেছেন ফ্যাশন মঞ্চে।

ভার্সাচের সংগ্রহ
ভার্সাচের সংগ্রহ

এখানে বিষণ্নতা যেমন ছিল, ছিল প্রতিবাদ আর অন্য রংও। লন্ডনের কর্মজীবী শ্রেণির জন্য ছিল রিচার্ড কুইনের ডিজাইনের নাটকীয়তা ও মজা। লেনা ডেনহ্যাম হেঁটেছেন প্রথমবারের মতো। বারবেরির পছন্দের তিন মডেল জিজি, বেলা আর কেন্ডাল জেনার তো ছিলেনই।

করোনার কারণে ইতালির মিলান থেকেই ফিরে গেছেন জর্জিও আরমানি
করোনার কারণে ইতালির মিলান থেকেই ফিরে গেছেন জর্জিও আরমানি

লন্ডনের ঘরের মেয়ে ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম পরিধেয় সংগ্রহে আসর মাতিয়েছেন। প্যাটার্ন আর সিলুয়েটে অভিনবত্ব ছিল তাঁর সংগ্রহে। তবে তিনি ফিরিয়ে এনেছেন স্পাইস গার্ল হিল। টমি হিলফিগার তাঁর ট্র্যাভেলিং রোড শো নিয়েই হাজির হয়ে যান লন্ডনে। নগরীর অলিম্পিয়া এক্সিবিশন সেন্টারে বারবেরির শোতে আমন্ত্রিত ছিলেন ৮০০ অতিথি। পুরো সময় ধরে পরিবেশন করলেন পিয়ানিস্ট কাটিয়া ও মারিয়েল লাবেক।

অনেক দর্শক এসেছিলেন মাস্ক পরে
অনেক দর্শক এসেছিলেন মাস্ক পরে

নিউইয়র্ক
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এবারের নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকের সঙ্গে আগের কোনো আসরের মিল পাওয়া যাবে না। এবার যেসব চলতি ধারা নজর কেড়েছে, তার মধ্যে রয়েছে উজ্জ্বল রং, আপটাউন পাঙ্ক, কাটআউট, ভিক্টোরিয়ান ফ্রিল আর নিখুঁত টেলারিং। পাশাপাশি তারকা উপস্থিতিও ছিল উল্লেখ করার মতো। মার্ক জেকবের শোতে বিশেষ চমক হিসেবে দেখা গেছে মাইলি সাইরাসের উপস্থিতি। মিসোনি, প্রোয়েঞ্জা শাউলার বা মাইকেল করস্। সবার কাজেই ছিল উদ্ভাবনীর চূড়ান্ত। রং নিয়ে খেলেছেন সবাই। বাদ যাননি ক্যারোলিনা হেরেরার ডিজাইনার ওয়েস গর্ডন। শুধুই কি রং, গর্ডনের সংগ্রহে ফুলেল উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ফুলেল কাটের এমব্রয়ডারি, প্রিন্ট—অনেক কিছুই তিনি হাজির করেছেন। পুরো উইকে আলোচিত ছিল প্রবাল গুরুং আর মার্ক জেকবস। উভয়েই ফ্যাশনপ্রিয়দের স্মৃতিমেদুর করেছেন নিউইয়র্কের প্রেরণায় তৈরি তাঁদের সংগ্রহে।

প্যারিসে ফ্যাশন উইক চলার সময় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তির দাবি
প্যারিসে ফ্যাশন উইক চলার সময় জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের মুক্তির দাবি