পোষা বিড়ালের যত্ন

বাড়ির বিড়ালের যত্ন প্রয়োজন প্রতিদিন। ছবি: মনন মাহমুদ
বাড়ির বিড়ালের যত্ন প্রয়োজন প্রতিদিন। ছবি: মনন মাহমুদ

শৈশব-কৈশোর পার করেছি খুব স্বাধীনভাবে। বাবার চাকরির সুবাদে এমন এক সুন্দর জায়গায় সময় কেটেছে, যেখানে পরাধীনতার শিকল পরাতে হয়নি ছটফটে মনকে। ঠিক একই রকম স্বাধীন জীবন পেয়েছে আদরের পোষা বিড়ালেরাও। সেসব দিন কোথায় হারাল। শহুরে জীবনের বন্দিদশায় সেই মুক্ত জীবনের স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ পাচ্ছি না আমরা। একই অবস্থা আদরের পোষা বিড়ালগুলোরও। 

বিড়ালকে সময় দিন। ওর সঙ্গে খেলুন। খেলনাও দিন। আঁচড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট জায়গা রাখা ভালো। লুকানোর সুযোগ দিন, সম্ভব হলে বেয়ে ওঠার মতো কিছুও। প্রতিদিন বিড়ালকে ছাদে বা বাইরে নিলে ওর মন ভালো থাকে, ব্যায়ামও হয়, স্থূলতার আশঙ্কা কমে। বিড়াল ঘরে রেখে আপনি যদি বাইরে কাজে থাকেন, পর্যাপ্ত পানি ও খাবারের ব্যবস্থা রাখুন। ঘরে তৈরি খাবার গরম আবহাওয়ায় চার–পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় বাইরে রাখলে নষ্ট হয়ে যায়। সে কারণে বিড়ালকে শুকনা খাবারের (ড্রাই ক্যাটফুড) অভ্যাস করানো আবশ্যক। 

প্রাণী চিকিৎসক এবং ঢাকার প লাইফ কেয়ার ক্লিনিকের কম্প্যানিয়ন অ্যানিমেল প্র্যাকটিশনার সুশ্যাম বিশ্বাস জানালেন নিরাপদে বিড়াল পালার এমন নানা উপায়। 

নিরাপদে থাকুক ওরা

● যাঁরা বিড়াল পোষেন, তাঁদের বাসা ক্যাটপ্রুফ বা বিড়ালের উপযোগী করুন, বিশেষত বহুতল ভবন হলে। অর্থাৎ, যেখান দিয়ে বিড়াল বাইরে যেতে বা পড়ে যেতে পারে (এমনকি বাথরুমের জানালাও) সেখানটায় ছোট ফাঁসের নেট (তার বা নাইলনের) দিয়ে দিন।

● তেলাপোকা বা ইঁদুরের বিষ ব্যবহার করবেন না। বিড়াল যেন কোনো রাসায়নিকের সংস্পর্শে না আসে। 

● বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। এগুলোর আশপাশে পানি যেন না থাকে, তার যেন ছেঁড়া না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। আগুন থেকে সাবধান। চুলা অযথা জ্বালিয়ে রাখবেন না। বিশেষত যাঁরা বিড়াল বাসায় রেখে বাইরে যান, তাঁদের এ বিষয়গুলো মেনে চলা জরুরি।

● গাছের টবে ব্যাঙের ছাতা (মাশরুম) গজালে তা তুলে ফেলুন।

● বাড়িতে ফার্নগাছ রাখতে চাইলে অ্যাসপারাগাস বাদে অন্যান্য (যেমন বল, বোস্টম, ডালাস প্রভৃতি) ফার্ন রাখতে পারেন। 

বিড়াল জন্মানোর জন্য
বিড়ালের দুই মাস বয়সে কম্বাইন্ড টিকা দিন। এর ২১/২৮তম দিনে বুস্টার ডোজ দিতে হয়। জলাতঙ্কের টিকা দিতে হলে তিন মাস বয়স হতে হবে। জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া থাকলে বিড়ালটি অন্য প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের শিকার হলেও নিরাপদ থাকবে। টিকা দেওয়া থাকা বিড়ালের কামড় বা আঁচড়ে মানুষের জলাতঙ্কের ঝুঁকি থাকে না। বছরে একবার বিড়ালকে টিকা দিতে হবে। তবে বিড়াল গর্ভাবস্থায় থাকলে কিংবা বিড়ালের দেড় মাস কিংবা এর কম বয়সী বাচ্চা (যে মায়ের দুধ খায়) থাকলে সেই মাকে টিকা দেওয়া যাবে না। 

বাইরে নিয়ে গেলে
ঘরের বাইরে গেলে লিশের (কুকুরকে হাঁটতে নিলে যে ধরনের লম্বা বেল্টজাতীয় পরানো হয়) প্রান্ত আপনার হাতে পেঁচিয়ে রাখুন; নইলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পাখি ধরতে গিয়ে লাফ দিয়ে ছাদ থেকে পড়েও যেতে পারে। অনেকে কলার পরাতে পছন্দ করেন। তবে কলারের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে কখনো, যদি আপনার অগোচরে বিড়াল বাইরে চলে যায়।

খাবার ও পানির সুব্যবস্থা

● বিড়ালের জন্য পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা রাখুন। নিয়মিত পানি বদলে দিন। তবে নির্দিষ্ট পানির বদলে ও অন্য কোথাও থেকে পানি খেতে আগ্রহীও হতে পারে। 

● উন্নত মেলামিনের পাত্রে খাবার ও পানি দিন। 

● আমিষ আবশ্যক। এরপর পর্যায়ক্রমে স্নেহজাতীয় ও শর্করাজাতীয় খাবারের চাহিদা। চামড়া ছাড়া মুরগির মাংস সেদ্ধ, সেদ্ধ কলিজা, সেদ্ধ মাছ, ডিম, সবজি সেদ্ধ (কুমড়া, লাউ, শসা, মটর, গাজর, শিমের বিচি, ব্রকলি, মিষ্টিআলু), সেদ্ধ ভুট্টা, সেদ্ধ গম, কলা, বিচি ছাড়া তরমুজ, ব্লু-বেরি, হার্ড চিজ, কটেজ চিজ, দই দিতে পারেন। গরম পানিতে ১০-২০ মিনিট ওট ভিজিয়ে রেখে ডিম বা কুসুম মিশিয়ে কিছুক্ষণ রেখে খাওয়াতে পারেন। শীতের সময় তেলযুক্ত মাছ দেওয়া ভালো। 

● বাড়িতে ঘাস রাখুন। প্রয়োজন হলে ওরা ঘাস খেয়ে নেয়, বিষাক্ত পদার্থ ঘাসের সঙ্গে বমি করে উগরিয়েও দেয়।

● তরল খাবার বা ওষুধ খাওয়াতে হলে তা মুখের এক পাশ থেকে দিন। মুখের মাঝ বরাবর দিলে শ্বাসনালিতে খাবার বা পানি গিয়ে সংক্রমণ হয়। 

খাবারে নিষেধাজ্ঞা! 

● পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মাছ-মাংস বা প্রাণিজ পণ্য, আঙুর, চকলেট, চা, কফি, চিনি, অ্যালকোহল দেবেন না। 

● প্রক্রিয়াজাত করা হয়নি (আনপ্রসেসড) এমন বা তরল দুধ না দেওয়াই ভালো। অভ্যাস থাকলে প্রয়োজনে দেওয়া যায় (গুঁড়া দুধও)। ছোট্ট বিড়ালকে (মায়ের দুধ না পেলে) দুধ দিতে হলে তরল দুধের সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে পাতলা করে দিন।

● সম্ভব হলে শর্করাজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। 

● চিংড়ি বা রেড মিটে অ্যালার্জি থাকতে পারে অনেক বিড়ালের। 

আরও যা

● বিড়ালের প্রস্রাব-পায়খানার স্থান পরিষ্কার রাখুন। 

● বিড়ালের গায়ে উকুন থাকলে লেজের গোড়া বা পেটে চুলকানি হয়। ৬ সপ্তাহের বেশি বয়সী বিড়ালকে ফ্লি-নাশী স্প্রে করতে পারেন নির্দেশনা অনুযায়ী। এর কম বয়সীর ফ্লি চিরুনি দিয়ে বের করতে পারেন। উকুননাশক শ্যাম্পু দিয়ে সাবধানে গোসল করাতে পারেন (কানে যেন পানি না ঢোকে)। গোসলের সঙ্গে সঙ্গে মুছিয়ে দিন বা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে ফেলুন।

● নখ কাটতে চাইলেও ৬ মাসের আগে নয়, আগে কাটলে বেয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে (স্নায়বিক সমস্যা, এমনকি মৃত্যুও)। কখনোই খুব গভীর করে নখ কাটা ঠিক নয়। 

● বিড়ালের ঘুমের সময় ছাড়া অন্য সময় ওকে একলা ঘরে রাখলে আলোর ব্যবস্থা রেখে যাওয়া ভালো। 

● কিছুদিনের জন্য কোথাও যেতে হলে পরিচিত ও নিরাপদ কোনো আশ্রয়ে ওকে রেখে যেতে পারলে ভালো।

করোনাভাইরাসে ভয়?
করোনা নিয়ে অনেকেই এখন সন্ত্রস্ত। তবে পশুপাখির সঙ্গে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কোনো যোগসূত্র এখনো পাওয়া যায়নি। অবশ্য সতর্ক থাকা ভালো। আপনার ও আপনার আদরের পোষা প্রাণীটির নিরাপত্তার স্বার্থে এই কয়েকটা দিন বিড়ালকে বাইরে যেতে দেবেন না কিংবা নিয়ে যাবেন না। বিড়ালকে ধরার আগে ও পরে নিয়মমাফিক হাত ধুয়ে নিন। খাবার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আগে এবং পরেও হাত ধুয়ে নিন সঠিক নিয়মে। গুজবে আতঙ্কিত হয়ে আদরের প্রাণীগুলোকে ভালোবাসাহারা করবেন না। বাড়ির বাইরে ফেলে দেবেন না। বাড়িতেও আদরবঞ্চিত করবেন না ওকে। ঠিক আগের মতোই ওকে ভালোবাসুন এই বিপদের সময়টাতেও।