করোনাভাইরাস ও অটিজম

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। প্রতিবছর দিনটি পালন করার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী অটিজম নিয়ে সব পর্যায়ের মানুষকে আরও সচেতন করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এ বছরের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯ নামের একটি ভাইরাসজনিত রোগ। বিশ্ববাসীর কাছে একেবারেই অচেনা এ রোগে এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৪২ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। এই রোগ থেকে সুরক্ষার জন্য নানা রকমের বিধিনিষেধ আর সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হচ্ছে। যেকোনো মানুষকেই এসব নিয়ম-কানুন পালন করতে হবে। আর অটিজম আছে এমন শিশু/ব্যক্তিদের জন্যও নিয়মের ব্যত্যয় করা যাবে না।

আমরা জানি, অটিজম হচ্ছে স্নায়ুর বিকাশজনিত সমস্যা। মায়ের গর্ভ থেকে জন্মের কয়েক বছর পর পর্যন্ত শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে। কোনো কারণে স্নায়ুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারে।

অটিজম রয়েছে এমন শিশুর মধ্যে মূলত দুই ধরনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়:

১. সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতে অসুবিধা এবং আশপাশের পরিবেশ ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যা এবং
২. বারবার একই ধরনের আচরণ করা।

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি বা শিশুরা সামাজিকতা পালন করতে পারে না, নিজের আগ্রহ, আবেগ আর অনুভূতি অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে না, যেকোনো ধরনের সামাজিক সম্পর্ক শুরু করার জন্য নিজে থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না এবং যদি সে কথা বলতেও পারে, তবু আরেকজনের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না, চোখে চোখ রেখে তাকায় না বা কম তাকায়। কখনো একই ধরনের আচরণ বারবার করতে পারে। যেমন হাতে তালি দেওয়া, মেঝেতে ঘুরতে থাকা, বারবার আঙুলের সঙ্গে আঙুল প্যাঁচানো। কখনো-বা একটি বস্তুকে বারবার একই রকমভাবে ব্যবহার করা, কোনো বস্তু বারবার স্পর্শ করা।

সবার মতো অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরাও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। সমস্যা হলো, তাদের যোগাযোগের দক্ষতা কম থাকায় স্বাস্থ্যবিধিগুলো বোঝানো অনেক সময় কঠিন হতে পারে। আবার একই আচরণ বারবার করার কারণে ঝুঁকিযুক্ত বস্তু বা ব্যক্তিকে স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে সংক্রমিত হতে পারে। তাই এ সময় এই বিশেষ শিশুদের দিকে খেয়াল রাখা দরকার বিশেষভাবে।

করোনার সংক্রমণ এড়াতে অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের জন্য অভিভাবকেরা যে ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেন:

• শিশুর অভিভাবক/মা-বাবা নিজেরা কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধিগুলো (হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মানা, ঘরবন্দী থাকা ইত্যাদি) মেনে চলবেন।

• অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু অন্য কোনো সূত্র থেকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার আগেই আপনি তার বয়স এবং সক্ষমতা অনুযায়ী বিষয়টি তাকে জানানোর চেষ্টা করুন। হয়তো সবাই একই রকমভাবে বুঝবে না, সে জন্য শিশুর সক্ষমতা বিবেচনা করে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। অন্তত এটি যে একটি বিপদ, সেটি বোঝাতে হবে।

• সচেতন করার জন্য নানা ধরনের মাধ্যম ব্যবহার করবেন। কারও জন্য ছবির কার্ড, কারও জন্য অভিনয় করে দেখানো, কারও জন্য মুখে বলা বা কারও জন্য অডিও ভিজ্যুয়াল পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হতে পারে। গল্পের আকারে ‘ফ্লু স্টোরি’ বলতে পারেন।

• শিশুকে হাত ধোয়া, জীবাণুনাশক ব্যবহার, টিস্যু ব্যবহার, হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার বোঝাতে গান, ছবির কার্ড, ভিডিও, গল্প বলা, ইশারা ভাষা ইত্যাদির সাহায্য নিতে পারেন। মনে রাখবেন, শিশুকে সবকিছু আপনি করে দিলে সে আপনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। তাকে নিজে নিজে এই কাজগুলো করতে সাহায্য করুন।

• বিষয়টি বোঝার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিন। অটিজমের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের অনেকে একটু ধীরে শেখে। তাই তাড়াহুড়ো করবেন না। তাদের নিজের মতো করে ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করুন।

• শিশুর স্কুল, বিশেষায়িত শিক্ষক, চিকিৎসক এবং যাঁরা বিপদে সাহায্য করতে পারেন, তাঁদের সঙ্গে অনলাইনে বা ফোনে যোগাযোগ বজায় রাখুন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশেষ প্রয়োজনে আপনার অনুপস্থিতিতে শিশুর জন্য বিকল্প যত্নকারীকে প্রস্তুত করতে থাকুন।

• ঘরবন্দী এবং অন্যান্য কারণে এ সময় অন্য সবার মতো শিশুর দৈনন্দিন রুটিন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, যা তাকে উদ্বিগ্ন আর অস্থির করে ফেলবে। বিষয়টি মাথায় রেখে এই সময় একটু বাড়তি মনোযোগ দিন।

• এ সময় শিশুর সব ধরনের শারীরিক নিরাপত্তার দিকে গুরুত্ব দিন। শিশুর আচরণের পরিবর্তনগুলো মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করুন। শিশু হঠাৎ রেগে গেলে, কান্নাকাটি করলে, বিছানায় প্রস্রাব বন্ধ হওয়ার পর আবার শুরু হলে, ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠলে, মা-বাবাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইলে, অন্য কোনো আচরণের হঠাৎ পরিবর্তন হলে সতর্ক হোন।

• শিশুকে মোবাইলে, টিভিতে বা ছবি এঁকে প্রতিরক্ষামূলক পোশাক (পিপিই) পরা স্বাস্থ্যকর্মীর ছবি দেখান। যাতে কোনো জরুরি প্রয়োজনে এই ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীর সান্নিধ্যে যেতে হলে শিশু ভীত হয়ে না পড়ে।

• বাড়িতে স্কুলের আদলে তাকে সংক্ষিপ্তভাবে স্কুলের কাজগুলো করতে উৎসাহিত করুন। কোনো কোনো শিশুর ক্ষেত্রে তাকে স্কুলের পোশাক পরিয়ে বাসায় স্কুলের কাজ দিতে পারেন।

• সে যেন বাড়িতে সব সময় শুয়ে-বসে না থাকে, সেটি নিশ্চিত করুন। শারীরিক কাজ, ব্যায়াম, খেলাকে উৎসাহিত করুন। শিশুকে তার সক্ষমতা অনুযায়ী ঘরের ছোটখাটো কাজগুলো করতে বলুন। সব সময় যেন সে ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত না থাকে।

• শিশুর যদি সক্ষমতা থাকে তবে ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে অথবা টেলিফোনে শিশুর শিক্ষক বা থেরাপিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিন।

• ঘরবন্দী থাকাকালীন নিয়ম করে শিশুকে দিনের বেলা ঘরের বারান্দা/জানালার কাছে বসতে উৎসাহিত করুন।

• ঘরবন্দী থাকাকালীন শিশুর সঙ্গে ঘরোয়া খেলা খেলুন। পুরো সপ্তাহের জন্য একটি পারিবারিক রুটিন তৈরি করুন। রুটিন তৈরি ও তা পালনে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করুন।

• যদি কোনো শিশু হুইল চেয়ার, চশমা, লাঠি ইত্যাদির মতো সহায়ক উপকরণ ব্যবহার করে, তাহলে সেগুলো জীবাণুমুক্ত রাখুন। শিশুর যেসব জিনিস বেশি স্পর্শ করার অভ্যাস আছে, সেগুলোও সব সময় জীবাণুমুক্ত রাখুন।

• পরিবারের কোনো সদস্যের মধ্যে কোভিড-১৯-এর উপসর্গ দেখা দিলে তাকে শিশু থেকে অবশ্যই দূরে আলাদা ঘরে থাকতে বলুন।

• শিশুর অভিভাবক/মা-বাবা নিজেরা নিজেদের মানসিক চাপ মোকাবিলা করুন। শ্বাসের ব্যায়াম, রিলাক্সেশন, মেডিটেশন চর্চা করুন। অযথা রাত না জেগে পরিমিত ঘুমান। বিশেষ শিশুর যত্ন নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে নিজের শরীর ও মনের যত্ন নিতে হবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, চাইল্ড এডোলেসেন্ট ও ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।