নারী স্বাস্থ্য, করোনাভাইরাস, স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকা

আমরা ভয় বা আতঙ্কের কথা না বলেও বলছি, আমরা একটি ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি। সারা পৃথিবীর সবাইকে একসঙ্গে মাথা নত করে দিয়েছে আমাদের কাছে একেবারেই নতুন করোনাভাইরাস। মৃত্যুর মিছিলকে রুখতে পারা যাচ্ছে না। এর ভয়াবহতা আমরা টের পাচ্ছি প্রতি মুহূর্তে।

পৃথিবী স্তব্ধ হয়েছে। পাহাড় নালিশ করেছে তাকে আঘাত করে কাটা হচ্ছে। আকাশ দেখা যাচ্ছে না, ধুলোর আবরণে ঢেকে আছে। নদী মরে যাচ্ছে, গাছ কাটা চলছে—সবুজের স্বাদ নেই। শুধুই কি প্রকৃতি! ৩-৪ বছরের শিশু থেকে ৬০ বছরের নারীও হচ্ছেন ধর্ষিত, হচ্ছেন খুন, হচ্ছেন পাচারের শিকার। হচ্ছে ড্রাগস ট্রাফিকিং। যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারে বারুদের গন্ধে স্তম্ভিত পৃথিবী। প্রকৃতি কাউকে ক্ষমা করে না। আমাদের ক্ষমা নেই। তবুও জোড় হাতে ক্ষমা চাইছি—আমরা আর মৃত্যুর মিছিল দেখতে চাই না। আমাদের দিকে আর একবার ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখো, আমরা আর একবার মানুষ হতে চাই, হে মহান শক্তিধর।

আমরা যারা নারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে কাজ করি, তাদের জন্য এ সময়টা কেমন হতে পারে, তা চিন্তা করে এগোনোর আগেই আমাদের কাজ শুরু করে দিতে হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রতি ঘণ্টায় ৩৯৪.৬২ শিশু জন্ম নিচ্ছে, প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে ৯ হাজার ৪৭১ জন। জন্ম–মৃত্যু কোনো কিছুই থেমে থাকে না। ধরে নিচ্ছি, ৫০ ভাগ শিশু বাড়িতেই জন্ম নিচ্ছে মা–দাদি–নানিদের হাতে। বাকি ৫০ ভাগ শিশু কমিউনিটি লেবেল থেকে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অর্থাৎ সরকারি, বেসরকারি, এনজিওর হাতে জন্ম নিচ্ছে। এই জায়গাগুলোতে কারা কাজ করছেন? এর মধ্যে সিজারিয়ান অপারেশনও হচ্ছে।

আমরা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সোসাইটি ১১ মার্চ থেকে ভাবছি, আমরা কীভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাব, কাদের কীভাবে কাজ করতে বলব। এটা করতে গিয়ে আমরা স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। প্রথম দিনই আমরা গর্ভবতী মায়েদের জন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করেছিলাম, ডিজি, হেলথ এবং ইউএনএফপির সহযোগিতায়। দ্রুত আমাদের ১৩টি শাখার মিডওয়াইফ বা নার্সদের এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের টেলিফোনে বলেছিলাম নিজেদের সুরক্ষা করে কাজ করতে হবে। টেলিফোনে বার্তা দেওয়ার আগেই তো শুরু হয়ে গেছে জন্মলগ্নের। কে কাকে ঠেকাবে! একজন কর্মীও জায়গা ত্যাগ করেননি, ডেলিভারি-সিজার-রক্তক্ষরণের চিকিৎসার কোথায়ও কোনো ব্যত্যয় হয়নি। ঢাকা মেডিকেলের লেবার রুমের একজন মিডওয়াইফ আমাকে ফোনে জানান, ভয় নেই, আমি মায়েদের ছেড়ে কোথাও যাব না। এতে যদি আমারও মরণ হয়, আমি মেনে নেব। আমার টেলিফোনের পর্দাটা চোখের জলে ভেসে গেল। আমার প্রায় ৭০ বছরের শরীরে, মনে আরও সাহস সঞ্চয় হলো। আমি ওকে বুঝিয়ে বললাম, তোমাদের জন্য চশমা আমরা কিনে পাঠাচ্ছি। চশমা পাচ্ছিলাম না। সুইমিংপুলে ব্যবহার করার চশমা দিয়ে বলা হলো, ডেলিভারি করার সময় যেন চোখে পানি ছিটকে না আসে, সে জন্য এটি ব্যবহার করতে হবে।

প্রায় এক মাস পার হতে যাচ্ছে। আমাদের এখন ভীষণ প্রয়োজন, ভয়ানক এ অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের জরুরি ব্রিগেড তৈরি করতে হবে কোভিড-১৯ মায়েদের জন্য। আমরা চাই, কোনো মা যেন এ রোগে আক্রান্ত না হন। একটি টিমে চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফ, অ্যানেসথেটিস্ট, শিশুবিশেষজ্ঞ থাকেন। কিন্তু একটি টিম দুই সপ্তাহ কাজ করার পর ১৪ দিন তাঁদের যেতে হবে কোয়ারেন্টিনে। তাহলে এরপর কারা যাবে? এগুলো আমাদের এক্ষুনি চিন্তা করতে হবে এবং ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থাও করতে হবে তাঁদের। দ্রুত এটি না শুরু করলে আমরা মহাবিপদের মুখে ঠেলে দেব আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যকর্মীদের। একজন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হলেই পুরো দল এবং আশপাশের অনেক রোগী কোয়ারেন্টিনে যাবেন। কাজেই স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা এখন প্রধান কাজ।

স্বাভাবিক চেম্বার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে কেন পড়লেন, আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা গাইডলাইনের প্রথম লাইনটিতে বলেছি, কোনো রকম ইমার্জেন্সি না হলে বাসাতেই থাকবেন। তাহলে চেম্বারে কেন তিনি আসবেন। একজন স্বাভাবিক রোগী চেম্বারে আসেন কমপক্ষে তিনজনকে নিয়ে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ২০ জন রোগী দেখলেও সেখানে ৬০ জন মানুষের ভিড় হচ্ছে। এটি এই মুহূর্তে আমাদের কাম্য নয়।

সর্বশেষে আবারও বলছি, এই মুহূর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, নার্সিং কাউন্সিল/OGSB/এনজিওসহ সবাই মিলে আসুন, একটি ইমার্জেন্সি টিম তৈরি করে ট্রেনিং শুরু করি, যেন ফ্রন্টলাইনে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের কমতি না পড়ে।

বীর ফ্রন্টলাইনের সব স্বাস্থ্যকর্মীদের আবারও স্যালুট।

লেখক: সাবেক সভাপতি, OGSB