তিতা ও টকে নববর্ষের খাবার

‘নিম তিতা, নিশিন্দা তিতা

আরও তিতা ফুলের মৌ।…’

সুস্বাদু খাবারের আয়োজনের জন্য বাজারে না ছুটে হাতের কাছে যা আছে, তা–ই দিয়ে এবার তৈরি করুন নববর্ষের খাবার। ছবি: লেখক
সুস্বাদু খাবারের আয়োজনের জন্য বাজারে না ছুটে হাতের কাছে যা আছে, তা–ই দিয়ে এবার তৈরি করুন নববর্ষের খাবার। ছবি: লেখক

নববর্ষের খাবার নিয়ে দু–চার কথা পেশ করার সময় তিতা আর টকের কথা উঠল কেন, এ প্রশ্ন করবেন জানি। তাই প্রথমেই বলে রাখি, নববর্ষের খাবারে তিতা আর টকের প্রাধান্য অবশ্যম্ভাবী। মিষ্টি কিংবা আরও অন্যান্য স্বাদের খাবার থাকবে পাতে, কিন্তু নববর্ষের খাবারের রাজা তিতা আর টক।

কথাটা একেবারেই আমার নয়। আমাদের শত শত বছরের গড়ে ওঠা খাবারের সংস্কৃতির কথা। তবে আমি যেটা দিয়ে ফোড়ন দেব, তা হলো নববর্ষের খাবার আসলে গ্রীষ্মকালের খাবার। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ গ্রীষ্মকাল। আর নববর্ষটা বৈশাখ মাসের পয়লা তারিখ। তাই এ সময়কার খাবারগুলো আসলে গ্রীষ্মকালের খাবার। তিতা ও টক—এই দুটিই গরম অঞ্চলের মানুষের খাবার। এ সময় প্রাকৃতিকভাব আমাদের দেশে যে খাবারগুলো পাওয়া যায়, খেয়াল করলে দেখবেন, সেগুলোর অনেক খাবারই কিন্তু তিতা আর টক। যেমন পাটশাক, আম, বরই ইত্যাদি।

কেন খাবেন তিতা স্বাদের খাবার? বৈজ্ঞানিকেরা বলছেন, তিতা স্বাদটির প্রতি মানুষ সব থেকে বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল। এটি এতই অন্য ধরনের যে অনেক সময় বয়স্ক মানুষও বুঝে উঠতে পারেন না, কোন ভাষায় এই স্বাদকে ব্যাখ্যা করা যায়। ইবন শায়ার আল ওয়ারকের দোহাই দিয়ে প্রবীরেন্দ্র চ্যাটার্জি জানাচ্ছেন, দশম শতকের দিকে বাগদাদি রান্নাতেও তিতা স্বাদের উপস্থিতি ছিল। আর ইবন শায়ারের রান্নার বইতে তিনি বলেছেন, সাধারণ মানুষের শরীরে অন্য যেকোনো ধরনের খাবারের থেকে গড়মাত্রায় বেশি তাপ উৎপাদন করে তেতো খাবার। বুঝতেই পারছেন, এই তিতা খাবারের পেছনে বেশ গভীর বৈজ্ঞানিক গবেষণা লুকিয়ে আছে। কাজেই যতই তিতা লাগুক, নববর্ষের খাবারে রাখুন তিতা পাটশাক, গিমাশাক, ঘি দিয়ে কচি নিমপাতা ভাজি, উচ্ছে বা করলা।

আহা! করলা বা উচ্ছের কথা উঠলেই সৈয়দ মুজতবা আলীর নাম মনে পড়ে। মনে পড়ে, সোনা মুগের ডাল আর উচ্ছে ভাজার কথা। এই খাবারটাও কিন্তু রাখতে পারেন আপনার পাতে। আর যদি সোনা মুগের ডাল না–ই পাওয়া যায়, তাহলে মসুর ডালও খেতে পারেন একটু ঘন করে। তবে চাইলে আপনি মসুর ডালের সঙ্গে দিতে পারেন শজনে ডাঁটা। এ সময় শজনে ডাঁটা পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর। আর নিশ্চয়ই আপনারা জানেন যে, শজনেকে এ যুগের ‘নিউট্রিসাস সুপার ফুড’ বলা হয়। প্রায় সব ধরনের পুষ্টিগুণ রয়েছে শজনে ডাঁটা ও পাতায়। মসুর ডালে শজনে ডাঁটা দিয়ে খাওয়ার প্রচলন আমাদের দেশে বেশ প্রাচীন। আবার মসুর ডালের সঙ্গে পাটশাক দিয়ে খাওয়ারও চল আছে আমাদের দেশে। এর যেকোনো একটি পদ রাখতে পারেন আপনার নববর্ষের খাবারে। আমাদের বাংলাদেশে টক খাবারের প্রচলন এই মার্চ-এপ্রিল মাসেই। বসন্ত রোগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য এই খাবারগুলোর কথা বলা হয়েছে প্রাচীন আয়ুর্বেদে।

এবার আসি টক খাবারের কথায়। গণিতজ্ঞ বুনো রামানাথ তেঁতুলপাতার ঝোল খেয়েই নাকি গণিতের চর্চা করতেন! সেই তেঁতুলপাতার ঝোল খাওয়ার প্রচলন নেই এখন। তবে আপনি খেতেই পারেন মৌরালা মাছ দিয়ে তেঁতুলপাতার ঝোল। নইলে আর কী, কাঁচা আম তো উঠেছেই বাজারে। কিনে ফেলুন। আর কাঁচা আম দিয়ে মসুর ডাল রান্না করে ফেলুন। অথবা আমের টক। দেশের গরমপ্রধান এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জের মানুষ কিন্তু আম আর তেঁতুলের খাবার তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। গরম কাটানোর জন্যই ওই এলাকার মানুষ টক খাবার খেয়ে থাকেন। কাঁচা আমে পাঁচফোড়ন দিয়ে রান্না করে ফেলুন আমের টক। না পেলে টমেটোর খাটা রান্না করুন হালকা পাঁচফোড়ন দিয়ে। টক খাবারগুলো আপনাকে গরমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উজ্জীবিত করবে।

বাজারে উঠেছে এঁচোড় মানে শিশু কাঁঠাল। এঁচোড়, আলু দিয়ে একটা ঘন্ট রান্না করতে পারেন। সেই সঙ্গে রাখুন মাছের মাথা দিয়ে রান্না করা থোড় অথবা মোচা। আলু, বেগুন, টমেটোর ঘন্টও রাখতে পারেন চাইলে। এগুলো সবই খুব কম তেল-মসলার নিরামিষ রান্না। এই করোনাকালে এগুলো আপনাকে বাড়তি শক্তি জোগাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে।

মাছ অথবা মাংস রাখুন যেকোনো একটা। মাছ থাকলে মাংস না খাওয়াই ভালো। মাছ রান্না করুন হালকা মসলায় ঝোল ঝোল করে, সেটা ইলিশই হোক আর রুই বা কাতলাই হোক। এ সময় ঝোল ঝোল করে রান্না করা মাছ খেতে ভালো লাগে। আসলে গ্রীষ্মের এই সময়ে কোনো গুরুপাক খাবারই শরীরের জন্য ভালো নয়। তাই মাংস রান্না করলেও তা খুব কড়া করে রান্না না করে একটু ঝোল ঝোলই রাখুন।

তাহলে কী দাঁড়াল নববর্ষের খাবারে? জুঁই ফুলের মতো ঝরঝরে সাদা ভাত, সঙ্গে তিতা শাক, টক, একটি ঘন্ট, পটোল কিংবা বড়া ভাজা, আম ডাল অথবা শজনে ডাল, একটি চাটনি, ঝোল ঝোল মাছ কিংবা মাংস। আর শেষ পাতে রাখতে পারেন পায়েস কিংবা একটি মিষ্টি।

এই করোনাকালে এত সব জোগাড় করতে বাজারে দৌড়াবেন না কিন্তু। ঘরে হাতের কাছে যা আছে, তা–ই দিয়ে সেরে ফেলুন এবারের নববর্ষের খাওয়াদাওয়া।