করোনাকালের নববর্ষ

চারুকলা লকডাউন। কোনো আয়োজন নেই এবারের নববর্ষে। নাগরিক বর্ষবরণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা চারুকলার এ দৃশ্য যেন পুরো দেশের প্রতীক। ছবি: লেখক
চারুকলা লকডাউন। কোনো আয়োজন নেই এবারের নববর্ষে। নাগরিক বর্ষবরণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা চারুকলার এ দৃশ্য যেন পুরো দেশের প্রতীক। ছবি: লেখক

চারুকলায় উন্মাদনা নেই, রমনার বটমূলে ছায়ানটের গান নেই, মঙ্গল শোভাযাত্রা নেই, পান্তা ইলিশ নেই, ধামরাইয়ের হাজরার শোভাযাত্রাও নেই, নতুন কাপড় নেই, মানুষের মুখে হাসি নেই, ঘরে স্বজন নেই, মেলা নেই, বাতাসা নেই, গরম জিলাপি নেই, ঢাক নেই, ঢোল নেই, তালপাতার বাঁশি নেই, রঙিন ঘূর্ণি নেই, হাওয়াই মিঠাই নেই, রাস্তাঘাটে মানুষ নেই, রবীন্দ্রনাথ নেই, লালন নেই, নজরুল নেই।

এত নেই আর নেইয়ের মধ্যে এসেছে আমাদের নববর্ষ। আমাদের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক উৎসব। চারদিকে মৃত্যুভয়ে আক্রান্ত মানুষ, যন্ত্রণাক্লিষ্ট অসুস্থ শরীর, উদ্বিগ্ন স্বজন। আক্রান্ত মানুষ সামনে রেখে শুভেচ্ছা জানানো যায় না, বিপন্ন মানুষের মধ্যে উৎসব হয় না। এ কারণে নতুন বছরের শুভেচ্ছাও নেই।

এক বছর আগের বর্ষবরণে চারুকলা ছিল মৌতাতে ভরপুর। রঙিন পোশাকে সুবেশ তরুণ–তরুণীর ঢল ছিল, রঙিন বেলুন হাতে অবাক বিস্ময়ে বাবার ঘাড়ে ছিল ছোট্ট শিশু, ছিল ভেঁপুর কর্কশ শব্দ, ছিল হাওয়াই মিঠাই, ছিল সুরের নহর, ছিল প্রাণোচ্ছল মানুষের পদভারে কম্পিত প্রাঙ্গণ। অথচ এক বছর বাদে আমাদের নাগরিক বর্ষবরণের প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ এখন নিষ্প্রাণ। চারুকলা লকডাউন। বকুলতলা নিঃশব্দ। চারুকলার প্রাচীরে পুরোনো পলেস্তারায় নতুন রঙের প্রলেপ পড়েনি এবার। হয়নি কোনো নতুন আলপনা।

প্রাচীরের গা ঘেঁষে রঙিন চুড়ি আর লেইস ফিতা, বাঁশি ও খেলনার দোকান বসেনি। সেখানে বসে বিরক্ত মুখে প্রায় মানুষহীন চারুকলা পাহারা দিচ্ছেন কিছু ঘরহীন মানুষ। সোহরাওয়ার্দী পার্কে ঢোকার প্রায় সব পথ বন্ধ। কোনো কোনো পথে পুলিশের সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছেন মানুষ আসবে না জেনেও। শাহবাগের ফুলের বাজার বন্ধ। কোথাও কোনো সৌরভ নেই নিষ্প্রাণ শাহবাগে। শুধু শাহবাগ নয়, পুরো শহর নিষ্প্রাণ, পুরো দেশে নৈঃশব্দ্য।

আমরা যখন ১৪২৭ বাংলা সনে প্রবেশ করছি, তখন দেশে করোনা আক্রান্তের পরিসংখ্যানের গ্রাফ ওপরের দিকে উঠছে। যতই করোনা পরীক্ষা জোরদার হচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা ততই বাড়ছে। ওয়ার্ল্ডোমিটার টিক টিক করে আমাদের জানাচ্ছে, পৃথিবীতে করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে মৃতের সংখ্যা প্রায় ৪০। এত মৃত্যু নিয়ে আমরা কে কাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাব?

‘শিরেসংক্রান্তি’ বলে একটি বাগ্‌ধারা আছে বাংলা ভাষায়। এর অর্থ আসন্ন বিপদ। শিরেসংক্রান্তি নিয়ে আমরা চৈত্রসংক্রান্তি পার করেছি। আর করোনার বিপদ মাথায় নিয়েই প্রবেশ করেছি নতুন একটি বছরে। তারপরও জীবন থেমে নেই। ঘরে ঘরে কিছু প্রস্তুতি চলছে। করোনার ছোঁয়া বাঁচিয়ে এখনো যাঁরা সুস্থ আছেন, তাঁরা জীবনের জয়গান গাইবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ঘরবন্দী থেকেও। কোনো বাড়ির রান্নাঘর থেকে বাটা মসলা কিছুটা খোশবাই ছড়াচ্ছে। নির্মল বাতাসে কোথাও থেকে ইলিশের গন্ধ ঝাপটা মারছে নাকে। কোথাও একটি শিশু নতুন জামা গায়ে বারান্দার রেলিং ধরে নতুন বছরের নতুন দিন দেখার চেষ্টা করছে।

এ সবকিছুই আমাদের স্পর্শ করছে। কারণ, আমরা এখনো বেঁচেবর্তে আছি, নতুন বছরে আমরা ভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রাণপণে। এই বেঁচে থাকার আনন্দ এর আগে কোনো নববর্ষে আমাদের ভাগাভাগি করে নিতে হয়নি। আমরা বরং নতুন বছরের আশা–আকাঙ্ক্ষাগুলোই ভাগাভাগি করে নিয়ে উদ্বেলিত হয়েছি, আশায় বুক বেঁধেছি। অথচ এক বছরের ব্যবধানে আমাদের ঘরবন্দী বর্ষবরণের স্বাদ নিতে হচ্ছে।

চারুকলার দেয়ালে নতুন রঙের প্রলেপ নেই। নেই কোনো নতুন আলপনা। ছবি: লেখক
চারুকলার দেয়ালে নতুন রঙের প্রলেপ নেই। নেই কোনো নতুন আলপনা। ছবি: লেখক

গ্রামদেশের নিয়ম চৈত্রসংক্রান্তিতে তিতা খাবার খেয়ে পুরোনো বছরকে বিদায় দেওয়া। নতুন বছরে মিষ্টিমুখ করে, ভালোমন্দ খেয়ে নতুন আশায় বুক বাঁধা। নতুন বছরে আসুন নতুন আশায় বুক বাঁধি এই ভেবে যে করোনায় প্রতিদিন যত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে কিংবা মৃত্যুবরণ করছে, তেমনি সুস্থও হচ্ছে মানুষ। ওয়ার্ল্ডোমিটার জানাচ্ছে, করোনাভাইরাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ৪ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ সেরে উঠেছেন সারা বিশ্বে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানীরা মানুষের জন্য প্রতিষেধক আবিষ্কারের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে অনেক ওষুধ তৈরির খবর পাওয়া যাচ্ছে। আক্রান্ত মানুষের পাশে তো বটেই, নিরন্ন, নিরাশ্রয় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে মানুষই। মানুষের প্রয়োজনেই এগিয়ে এসেছেন বিত্তবান মানুষ। আনন্দযজ্ঞের যত কমতিই থাক, নতুন বছরে এর চেয়ে ভালো খবর আর কী হতে পারে?

নতুন বছরের শুভেচ্ছা সেই সব মানুষকে, যাঁরা করোনামুক্ত হয়ে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছেন। সেই সব মানুষকে শুভেচ্ছা যাঁরা করোনাক্লান্ত পৃথিবীকে করোনামুক্ত করতে প্রাণান্ত পরিশ্রম করছেন প্রতিদিন। সেই সব মানুষকে শুভেচ্ছা, যাঁরা অর্থ দিয়ে, বিত্ত দিয়ে, প্রজ্ঞা দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শুভেচ্ছা সেই সব মানুষকে, যাঁরা আমাদের নিরাপদ রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় ভুলে গেছেন পরিবার-স্বজনের কথা। সেই সব মানুষকে শুভেচ্ছা, মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর বুকে হাত রেখে যাঁরা এখনো স্বপ্ন দেখিয়ে যাচ্ছেন, আমরা করব জয়।

নববর্ষের শুভেচ্ছা সবাইকে, যারা এখনো বেঁচে আছি আরেকটি নববর্ষের আনন্দযজ্ঞে শামিল হওয়ার দূরপ্রসারী স্বপ্ন নিয়ে। ধন্যবাদ আমাদের স্বপ্নকে।