এমন বৈশাখ কখনো দেখিনি আগে

প্রকৃতি আছে তার আপন খেয়ালে। পরিবর্তন নেই পৃথিবীর আহ্নিক গতি আর বার্ষিক গতিতে। চৈত্র পেরিয়ে বৈশাখ ঠিকই হাজির হয়েছে। কিন্তু মন ভালো নেই মানুষের। এমন সংকট এর আগে তো কেউ দেখেনি। এ এক বিস্ময়কর ক্রান্তি। নববর্ষ গেল। অথচ সে অর্থে প্রাণের স্পন্দন নেই। আমাদের অন্যতম বড় উৎসবের দিনে চোখে পড়েনি খোঁপায় ফুল আর লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা কোনো তরুণী কিংবা লাল-সাদা পাঞ্জাবি পরা কোনো তরুণ। ঘরবন্দী আবালবৃদ্ধবণিতার উদযাপন নেই। বর্তমানের সংকট আর ভবিষ্যতের শঙ্কায় অদ্ভুত সময় পার করে চলেছে সবাই।

এমন করোনাময় এই বৈশাখে রবি কবির ঋণ বাড়িয়ে বলতে হয়, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/ তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥/ তবু প্রাণ নিত্যধারা,/ হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/ বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে॥/ তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,/ কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।/ নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ,/ নাহি নাহি দৈন্যলেশ—/ সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে॥’

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আশাবাদী মনের সেই পূর্ণতার পায়ে স্থান মাগাই স্বাভাবিক। এই বৈশাখের পোশাক সংস্কৃতি নিয়ে স্মৃতির অলিন্দে পায়চারি হয়তো ক্ষণিকের জন্য মনটাকে ভুলিয়ে রাখবে।

আজকের উন্নত বিশ্ব যখন গুহাবাসী, বাঙালি তখন বস্ত্রবয়নের জাদু জানে। নিজেরা তুলা ফলিয়ে সেই তুলায় প্রায় অদৃশ্য সুতা কেটে তা দিয়ে কাপড় তৈরি করেছে। একসময়ে তাই তো মসলিনকে বলা হতো ‘পরিদের তৈরি কাপড়।’

সংগত কারণেই বাঙালির ছিল বস্ত্রবিলাস। কাশ্মীরি কবি ক্ষেমেন্দ্রের রচনায় সেই বর্ণনা মোহ জাগায়। সেই সময়ে সে দেশে পড়তে যাওয়া বঙ্গপুঙ্গবদের সুঠাম শরীর হয়তো ছিল না, কিন্তু ছিল সজ্জার পারিপাট্য। পোশাক, জুতার সঙ্গে কেশবিন্যাস।

সেলাইবিহীন কাপড় একসময় সারা বিশ্বেই ছিল। রোমানদের ড্রেপিং আর আমাদের ধুতি ও শাড়ি পেঁচিয়ে পরার মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরার ধরনের ফারাক বৈ তো নয়।

তবে এই ভূখণ্ডের মানুষের পোশাক ছিল বস্তুত নিম্নাঙ্গের। শীতে ঊর্ধ্বাঙ্গে একখণ্ড কাপড় জড়ানোর রীতি ছিল।

এরপর জল অনেক গড়িয়েছে। পোশাকের বিবর্তন হয়েছে। দিবে আর নিবের খেলায় পরিবর্তনও কম হয়নি। উপরন্তু অনেক দিন ধরেই এর ওপর চড়েছে রাজনীতির, ধর্ম আর ঔপনিবেশিকতার নানা রং। এই উতোর-চাপানের মাঝে ধুতি গতায়ু, টিকে আছে শাড়ি। বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম পোশাক। এখানে কৃতিত্ব নারীদের। তারাই কাজটি সসম্মানে আজও করে চলেছেন। আর বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এই পোশাক বংশপরম্পরায় বয়ন করে চলেছেন আমাদের বয়নশিল্পীরা। উভয়ের প্রচেষ্টায় টিকে আছে প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পোশাক ঐতিহ্য।

যাহোক, বিশ্বজুড়ে উদযাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি উপাদানের একটি হলো খাদ্য, অন্যটি বস্ত্র। বাঙালির জন্য এর অন্যথা ছিল না। তবে বৈশাখে আজকের মতো নতুন পোশাক পরার চল বেশি পুরোনো নয়। কারণ, বাঙালি পয়লা বৈশাখকে একটু অন্যভাবে উদযাপন করেছে। যেখানে বস্ত্রের চেয়ে খাদ্য তুলনায় প্রাধান্য পেয়েছে। সঙ্গে মেলা ছিল অনেক বেশি আদৃত। যেখানে কারুপণ্য সব সময়ে থেকেছে মধ্যমণি।

গত নব্বই দশকের শেষের দিক থেকে পয়লা বৈশাখে পোশাক কেনার আগ্রহ বাড়তে থাকে। এর নেপথ্যে সংবাদপত্রের ভূমিকা যেমন ছিল, তেমনি দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির ক্রমবিস্তারও ছিল। কারণ, বাংলাদেশের এই শিল্প খাত উৎসব, পার্বণ আর দিবসনির্ভর। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ উৎসব হিসাবে পয়লা বৈশাখ বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। ফলে উদযাপনে মাত্রা দিয়েছে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে পোশাক। ফ্যাশন হাউসগুলোও সেভাবে ভাবতে শুরু করেছে। ডিজাইনাররা তাদের মেধার স্ফুরণ ঘটিয়েছেন। পরোক্ষে দেশি পণ্য কেনার এবং উৎসবে পরার ঝোঁক তৈরি হয়েছে। মধ্যবিত্তের ক্রয়সাধ্য বৃদ্ধিও এ ক্ষেত্রে অনুঘটক হয়েছে। সব মিলিয়ে একটা ইন্ডাস্ট্রি দাঁড়াতে শুরু করেছে।

বসন্তের শেষ থেকেই গরম পড়তে শুরু করে। আর গ্রীষ্মে রূপান্তরিত হয় প্রচণ্ডতায়। ফলে পোশাকের কাপড়, ডিজাইন বৈচিত্র্য, ব্যবহার উপযোগিতার সঙ্গে আরামসহ নানা বিষয় নিয়ে তৈরি হয়েছে ভাবনা-বলয়। এমনকি এই সাধ আর সাধ্যের সামঞ্জস্যও পেয়েছে সমান গুরুত্ব।

ঐতিহ্যের লালসাদার বৃত্ত থেকে বৈশাখকে বের করে এনেছেন ডিজাইনাররা। এ নিয়ে ছিল দ্বিমুখী মতো। আমি নিজেও অন্তত বৈশাখের বর্ণ-ঐতিহ্য থেকে বের হওয়ার পক্ষপাতি নই। তবে নতুন প্রজন্মের পছন্দ আর রুচির সঙ্গে ডিজিটাল জমানার চাহিদাকে না মেনেও বা উপায় কি। ভেবে আনন্দ পাই, নিজেদের পোশাক বা চিরাচরিত পোশাকের বাইরে নতুন প্রজন্মের পছন্দের পশ্চিমা পোশাকেও লেগেছে বৈশাখী রং। ডিজাইনারদের কল্যাণে এটা অন্তত হয়েছে। বস্তুত সবকিছুকে তো আর লক্ষণরেখা টেনে আটকে রাখা যায় না। এ জন্য বর্তমানের পোশাক নকশায় তরুণদের বিষয়টা সবার আগে ভাবা হয়। কারণ বিশ্বের সব খবর তাদের মুঠোবন্দী। কেনার সময় তারা মিলিয়ে নিতে চায়।

তবে এবারের বৈশাখ ছিল আবার অন্যতর মেজাজের। কারণ, মাত্র দেড় মাসের মধ্যেই ঈদ। ফলে প্রস্তুতির ধরনটা ছিল অন্য রকম। এক দিনে ব্যাপকতা হ্রাস পায়নি। কিন্তু পোশাকের নকশায় একটা বড় অংশই ছিল যেকোনো উৎসব উপযোগিতার বৈশিষ্ট্য। কারণ, বৈশাখ সংগ্রহের একটা অংশ এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যাতে পোশাক ঈদেও পরতে পারা যায়। ছাঁট আর কাটে আধুনিকতা প্রাধান্য পেয়েছে। আন্তর্জাতিক নকশার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিজাইনাররা তাঁদের সৃজন পরিকল্পনা সাজান। এই বৈশাখেও তাই প্রিন্ট নিয়ে কাজ হয়েছে। আবার অনেক ফ্যাশন হাউস বিভিন্ন থিমনির্ভর নকশাও করেছেন। সব মিলিয়ে আয়োজন ছিল জমজমাট।

এত শত প্রস্তুতি শেষ পর্যন্ত কোনো কাজে এল না। গিলে খেল করোনা প্রাদুর্ভাব। ছুটি প্রলম্বিত। শেষ হওয়ার আগে এই মেয়াদ আরও দীর্ঘায়িত হবে কি না, তা এখনই অনুমিত নয়। অথচ এরই মধ্যে চলে আসবে রোজা। শুরু হয়ে যাবে ঈদের প্রস্তুতি। কিন্তু তার আগে কি সবকিছু স্বাভাবিক হবে? নাকি বৈশাখের মতো ঈদও মাঠে মারা যাবে? এসব প্রশ্নে বিশ্বস্ত বাঙালি সংকট থেকে পরিত্রাণের দিন গুনছে। অন্ধকারে পেরিয়ে আলোকরেখার প্রতীক্ষায় থেকে বিশ্বপিতার মঙ্গলবারতা শোনার অধীর অপেক্ষা সবার।