করোনা: ভাইরাস নয়, হলদে পরির দেশের নদী

ক্রয়েশিয়া এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার মধ্যে প্রবাহিত করোনা নদী। ছবি: উইকিপিডিয়া
ক্রয়েশিয়া এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার মধ্যে প্রবাহিত করোনা নদী। ছবি: উইকিপিডিয়া

আপাতদৃষ্টে পরির অস্তিত্ব থাক আর না–ই থাক, ইউরোপের একটি দেশকে ‘হলদে পরীর দেশ’ নামে ডেকেছিলেন আমাদের পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীন। কোন দেশ সেটি? এই দেশটিকে ‘পৃথিবীর বিলুপ্ত দেশ’ নামেও ডাকা যায় এখন। দেশটির নাম যুগোস্লাভিয়া। ১৯১৮ সালে দক্ষিণ ইউরোপের সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রো, স্লোভেনিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়া আর বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা মিলে যুগোস্লাভিয়া নামের এ দেশটি গঠন করেছিল নিজেদের জাতিগত পরিচয়ের সাপেক্ষে।

আমরা যাঁরা গত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশকে বড় হয়েছি, তারা যুগোস্লাভিয়া ও বেলগ্রেডের নাম শুনেছি প্রচুর। এই বেলগ্রেড এখন সার্বিয়ার রাজধানী। যুগোস্লাভিয়া নামের এ দেশটি ভাঙতে ভাঙতে ১৯৯০–এর দশকে এবং তারও কিছু পরে মোট সাতটি দেশের জন্ম দিয়েছে। এই দেশগুলোর প্রতিটিকে আমরা চিনি ১৯৯০–এর দশকের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দেশ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে তার একটি দেশকে আমরা চিনেছি অনিন্দ্যসুন্দর ফুটবলের দেশ হিসেবে। দেশটির নাম ক্রোয়েশিয়া। যুগোস্লাভিয়া ভেঙে ক্রোয়েশিয়া, উত্তর মেসিডোনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ও স্লোভেনিয়া স্বাধীন হয় প্রথমে। সার্বিয়া আর মন্টেনিগ্রো ‘ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া’ নামে আরও কিছুকাল টিকে থাকলেও ২০০৬ সালে মন্টেনিগ্রো স্বাধীন হয়ে গেলে যুগোস্লাভিয়া নামের দেশটি তার অস্তিত্ব হারিয়ে জায়গা করে নেয় ইতিহাসের পাতায়। পরবর্তী সময়ে সার্বিয়া ভেঙে আবারও দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়—একটির নাম সার্বিয়া, অন্যটির নাম কসোভো।

এই করোনাকালে ইতিহাস-ভূগোলের এত কচকচানি কেন? কারণ একটাই। ‘হলদে পরীর দেশ’খ্যাত পৃথিবীতে যে বিশাল দেশটির অস্তিত্ব ছিল, যে দেশ ঘুরে এসে আমাদের পল্লিকবি লিখেছিলেন ‘হলদে পরীর দেশে’ নামে সুখপাঠ্য এক ভ্রমণকাহিনি, সেই দেশের একটি নদীর নাম করোনা। না, করোনাভাইরাসের সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র নেই বটে, কিন্তু এক গভীর যোগসূত্র আছে মানুষের চোখের জলের।

ইতিহাস বলে, জাতিগত দাঙ্গায়, নতুন দেশের গোড়াপত্তনের রাজনীতিতে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বপ্নময় হাতছানিতে আর ভূরাজনীতির ক্ষমতার লড়াইয়ে লাখো মানুষ নিহত হয়েছিলেন যুগোস্লাভিয়া ভাঙার সময়। কোটি কোটি মানুষের চোখের জল মিশে ছিল যুগোস্লাভিয়া নামের দেশটির শত শত নদীর সঙ্গে করোনা নদীতেও। পুরো পৃথিবীতে এই মুহূর্তে স্বজন-বান্ধব কেড়ে নিয়ে লাখ লাখ মানুষের চোখের জল ঝরানো ভাইরাসটির নাম করোনাভাইরাস। অতীত ও ঘটমান বর্তমান ইতিহাসে তাই ‘করোনা’ নামটির সঙ্গে যোগ রয়েছে মানুষের চোখের জলের।

নদীটি কোথায়? উইকিপিডিয়া এবং আরও কয়েকটি ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, করোনা নামের নদীটি যুগোস্লাভিয়া ভেঙে জন্ম নেওয়া ক্রোয়েশিয়া এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার পশ্চিম প্রান্তে প্রবাহিত হচ্ছে এখন। আনুমানিক ১৩৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীটির প্লাবনভূমি প্রায় ২ হাজার ৩০১ বর্গকিলোমিটার। করোনা নামের নদীটির বর্তমান নাম ‘করানা’ (Korana) হলেও, এর আদি নাম ছিল করোনা (Coranna বা Corona)। জানা যায়, ১৩ শতক পর্যন্ত নদীটি করোনা নামেই পরিচিত ছিল স্থানীয়ভাবে। করোনা নদীটির নামের মূলে রয়েছে ‘কর’ (karr) শব্দটি, যার অর্থ পাথর। অর্থাৎ নদীটি মূলত পাথুরে নদী। করোনা নামের এ নদীটি ক্রয়েশিয়া এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার মধ্যে ২৫ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্ত তৈরি করেছে। করোনা নদীর উৎপত্তি কোথায়, সেটা জানা না গেলেও জানা যাচ্ছে যে নদীটি ক্রয়েশিয়ার কুপা নদীতে পড়েছে।

‘করোনা’ শব্দটির স্প্যানিশ অর্থ মুকুট। আর প্রটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান শব্দ করোনার মূলে থাকা ‘কার’ শব্দটির অর্থ পাথর। মুকুট ও পাথর এ দুটি শব্দই করোনাকালে ব্যাপক অর্থবহ। এই মুহূর্তে করোনার মুকুটে যোগ হয়েছে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর পালক। আর পৃথিবীর বুকে এটি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। পিতার সামনে করোনা আক্রান্ত সন্তানের যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীর, স্পর্শরহিত নিথর দেহ, মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের বুকের ওপর বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা ছোট্ট শিশু, চিকিৎসাহীন হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা মৃত মানুষ, চিকিৎসা না পেয়ে মরে যাওয়া চিকিৎসক, করোনার ভয়ে বন ছেড়ে আসা জন্মদাত্রী মায়ের করুণ আর্তনাদের চেয়ে পৃথিবীতে কোনো পাথরের ওজন কত বেশি? পৃথিবীর এক প্রান্তে বয়ে চলা ছোট্ট করোনা নদী কি তার শীতল পানিতে ধুয়ে দিতে পারবে আমাদের এ কষ্ট?