সাবান-পানিই ভালো

অধ্যাপক সৈয়দ আফজালুল করিম। ছবি: সংগৃহীত।
অধ্যাপক সৈয়দ আফজালুল করিম। ছবি: সংগৃহীত।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সাবান–পানি দিয়ে বারবার হাত ধোয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কোন ধরনের সাবান ব্যবহার করবেন, তা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি ও দ্বিধায় ভুগছে সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া যাঁদের ত্বকের রোগ আছে, তাঁরাও বারবার সাবান–পানি দিয়ে হাত ধোয়ার কারণে সমস্যায় রয়েছেন। সাবান–পানি দিয়ে হাত ধোয়া এবং ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আমরা ই–মেইলে যোগাযোগ করেছিলাম ঢাকার হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট অধ্যাপক সৈয়দ আফজালুল করিমের সঙ্গে।

প্রথম আলো: ভাইরাস দূর করার জন্য স্রেফ সাবান–পানি যথেষ্ট, নাকি হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা বেশি ভালো।

আফজালুল করিম: সাবান–পানি আর অ্যালকোহলযুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার—দুটোই হাত জীবাণুমুক্ত করে। তবে সাবান–পানি ভাইরাসটির আবরণ ভেঙে ফেলতে সক্ষম। তাই সাবান–পানিই ভালো। হাতে সাবান নিয়ে পানি দিয়ে ফেনা করে ঘষে ঘষে ধুতে হবে। এতে জীবাণু বা ভাইরাস চলে যায়। তবে সব সময় সব জায়গায় সাবান–পানির ব্যবস্থা নাও থাকতে পারে। তাই ছোট হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল সঙ্গে রাখা যায়। যখন সাবান–পানি পাওয়া যাচ্ছে না, যেমন, পথে চলার সময়, গণপরিবহনে বা বাজারে, মার্কেটে বা ব্যাংকে, তখন এটি ব্যবহার করলেন।

প্রথম আলো: বারবার হাত ধোয়ার জন্য কোন ধরনের সাবান ভালো? সাধারণ বার সাবান, তরল হ্যান্ডওয়াশ, নাকি যেকোনো ডিটারজেন্টমিশ্রিত তরল? গরম পানি দিয়ে হাত ধুলে কি কোনো বাড়তি সুবিধা পাওয়া যাবে?

আফজালুল করিম: করোনাভাইরাসের বাইরের আবরণটি চর্বি বা লিপিড দিয়ে তৈরি। আর ক্ষারযুক্ত যেকোনো সাবান এই লিপিড লেয়ারকে ভেঙে ফেলতে পারে। তাই যেকোনো ক্ষারযুক্ত সাবান ব্যবহার করা যাবে হাত ধোয়ার জন্য। দামি হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এমনকি কাপড় কাচার সাবানও কার্যকর। গোসল করার বার সাবান বা তরল হ্যান্ডওয়াশ যেকোনো কিছু হতে পারে।

অতিরিক্ত গরম পানি দিয়ে হাত ধুলে ত্বক বেশি শুষ্ক হয়ে পড়ে। পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও আছে। তাই হালকা গরম পানি বা স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি দিয়ে বারবার হাত ধুতে হবে। কতবার বা কতক্ষণ পরপর ধুতে হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তবে খাওয়ার আগে ও পরে, খাবার প্রস্তুত বা পরিবেশনের আগে, বাইরে থেকে এসে বা বাইরে থেকে আনা যেকোনো জিনিস স্পর্শ করার পর, টয়লেটের আগে ও পরে, অসুস্থ মানুষের পরিচর্যা করার পর, যেকোনো তল বা বস্তু পরিষ্কার করার পর বা নোংরা–আবর্জনা হাতে লেগে গেলে অবশ্যই হাত ধুতে হবে। এর বাইরে যখনই মনে পড়বে হাত ধুয়ে নিন।

প্রথম আলো: বারবার হাত ধোয়ার কারণে কারও কারও ত্বক শুষ্ক হয়ে পড়ছে বেশি। বিশেষ করে যাদের আগে থেকে শুষ্ক ত্বক আর ত্বকের সমস্যা আছে, তারা এ সমস্যা পড়ছে বেশি। কারও হাতে চুলকানি হচ্ছে, চামড়া উঠছে, লাল হয়ে যাচ্ছে, ফেটে যাচ্ছে ইত্যাদি। এসব সমস্যার প্রতিকার কী?

আফজালুল করিম: হাত ধোয়ার কিছুক্ষণ পর হাত শুকিয়ে গেলে হালকা ময়েশ্চারাইজার ক্রিম ব্যবহার করা যাবে। এতে হাত বেশি শুষ্কতা থেকে রক্ষা পাবে। রাতে ঘুমানোর আগে হাত ভালো করে অনেকক্ষণ ধরে ধোয়ার পর পুরু করে ময়েশ্চারাইজার বা পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে নিন। কারণ, রাতে তো আর হাত ধোয়া হবে না। সারা রাতে ত্বক আর্দ্র হবে।

প্রথম আলো: কোভিড–১৯ সংক্রমণের এই সময়ে অনেক বাড়িতেই গৃহকর্মী নেই। তাই সবাই মিলে কাপড় কাচা, বাসনকোসন ধোয়া, রান্নাবান্নার কাজ করতে হচ্ছে। এ কারণে হাতের ত্বক আরও শুষ্ক হয়ে পড়ছে। কারও আবার ছত্রাক সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?

আফজালুল করিম: অতিরিক্ত পানি, বিশেষ করে ডিটারজেন্টমিশ্রিত পানি ব্যবহারে অনেকেরই ত্বকে অ্যালার্জি হতে পারে। পানির কাজ করার পর হাত ভালো করে পরিষ্কার করে হাতে ময়েশ্চারাইজার লাগিয়ে নেওয়া ভালো। এ ছাড়া ধোয়ামোছার কাজের সময় দরকার হলে কিচেন গ্লাভস হাতে পরে নিতে পারেন। তবে কাজ শেষে গ্লাভস খুলে হাত ধুয়ে নিতে হবে। ডিসপোজেবল গ্লাভস হলে ভালো করে মুড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে। রিইউজেবল গ্লাভস হলে ওটা সাবান–পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার জায়গায় রাখুন।

প্রথম আলো: করোনাভাইরাস তৈলাক্ত আবরণ দিয়ে তৈরি। তাই ক্ষারযুক্ত সাবান–পানিতে এটি দূর হয়। কিন্তু হাতে তৈলাক্ত ময়েশ্চারাইজার, লোশন, ক্রিম, ভ্যাসলিন ইত্যাদি ব্যবহার করলে কি ভাইরাস লেগে থাকার ঝুঁকি বাড়বে?

আফজালুল করিম: প্রথমে ভালো করে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত, নখ, আঙুলের ফাঁক, কবজি ইত্যাদি ধুয়ে নিলে হাত জীবাণমুক্ত হবে। এবার শুকিয়ে যাওয়ার পর পরিষ্কার হাতে নিশ্চিন্তে ময়েশ্চারাইজার লাগাতে পারেন। এতে কোনো সমস্যা নেই। তবে এই হাত দিয়ে আবার নিজের অজান্তেই অনেক কিছু স্পর্শ করে ফেলবেন। তাই আবারও কিছুক্ষণ পর হাত ধুতে হবে। বারবার হাত ধোয়ার বিকল্প নেই।

প্রথম আলো: যাঁরা বাইরে যাচ্ছেন, স্বাস্থ্যকর্মী, সংবাদকর্মী, পুলিশ, পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রায় সবাই এখন হাতে গ্লাভস পরছেন। দীর্ঘ সময় গ্লাভস পরে থাকলেও হাতের ত্বকে কিছু সমস্যা হয়। গ্লাভস খোলার পর হাতে গুঁড়া লেগে থাকে, শুষ্ক মনে হয়। এ ব্যাপারে করণীয় কী?

আফজালুল করিম: গ্লাভস কিন্তু সম্পূর্ণ সুরক্ষা দিতে পারবে না। কারণ, গ্লাভস পরা হাত দিয়ে আপনি নিজের নাক–মুখ স্পর্শ করলে জীবাণু প্রবেশের ঝুঁকি তো রয়েই গেল। আবার অনেকক্ষণ গ্লাভস পরে থাকলে হাত ঘামে। বাইরে গেলে বা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজ করার সময় গ্লাভস পরলেও বিশেষভাবে লক্ষ রাখবেন, এই গ্লাভস পরা হাত যেন নিজের নাক–মুখ স্পর্শ না করে। আর কাজ শেষে যত দ্রুত সম্ভব গ্লাভস সঠিকভাবে খুলে সঠিক জায়গায় ফেলতে হবে এবং তারপর হাত ধুয়ে ফেলতে হবে।

প্রথম আলো: ত্বকের কিছু রোগে, যেমন: সোরিয়াসিস এ, কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমাতে পারে। এই সময়ে এই রোগীদের কি বাড়তি কোনো ঝুঁকি আছে? তাঁরা কি এসব ওষুধ চালিয়ে যাবেন?

আফজালুল করিম: ত্বকের অনেক রোগের জন্য এমন কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যা দীর্ঘদিন সেবন করার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। কিন্তু চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ না করে কোনো ওষুধ হঠাৎ বন্ধ করবেন না। এতে রোগের তীব্রতা বেড়ে যেতে পারে। বরং যাঁরা এ ধরনের ওষুধ সেবন করেন, তাঁরা একটু বিশেষ সতর্ক থাকুন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবেন না, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। বারবার হাত ধোয়া ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনে বা টেলিমেডিসিনের সাহায্য নিন।