এবার ডায়াবেটিসের রোগীর রোজা

ইফতার বা সাহ্‌রিতে খাদ্যতালিকা অনুযায়ী খেতে হবে ডায়াবেটিসের রোগীদের।  ছবি: অধুনা
ইফতার বা সাহ্‌রিতে খাদ্যতালিকা অনুযায়ী খেতে হবে ডায়াবেটিসের রোগীদের। ছবি: অধুনা

ভৌগোলিক অবস্থান ও মৌসুমভেদে পবিত্র রমজান মাসে রোজা থাকার সময়কাল ১৪ থেকে ২৩ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। এ বছর আবার করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভূত পরিবর্তন এসেছে। তাই এবার নানা রকম ঝুঁকি বিবেচনা করে ডায়াবেটিসের রোগীকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

রোজার সময় ডায়াবেটিসের রোগীর যা হতে পারে

* রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া

* রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া

* ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস

* পানিশূন্যতা ও থ্রম্বোএম্বোলিজ

রোজার আগের ভাবনা

যেসব ডায়াবেটিসের রোগী রোজা রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তাঁদের রোজা শুরুর এক মাস আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। এর মধ্যে আছে ঘুম থেকে উঠে ও খাবার দুই ঘণ্টা পর (মোট চারবার) রক্তের গ্লুকোজ, খালি পেটে রক্তের লিপিড, লিভার, কিডনি ও হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতার পরীক্ষা এবং এইচবিএ১সি ইত্যাদি পরীক্ষা করে নেওয়া। এ বছর সব পরীক্ষা সম্ভব না হলেও রক্তে শর্করা মেপে একটি চার্ট করে চিকিত্সকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন।

রোজায় ডায়াবেটিসের ব্যবস্থাপনা

প্রত্যেক ডায়াবেটিসের রোগীর অবস্থা স্বতন্ত্রভাবে বিচার করতে হবে। সবার বেলায় একই নিয়ম না–ও খাটতে পারে।

রমজান মাসে ঘন ঘন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা মেপে দেখতে হবে। দিনের শেষ ভাগে মানে ইফতারের আগে অবশ্যই রক্তের গ্লুকোজ দেখার অভ্যাস করুন মাঝেমধ্যে। রমজানের প্রথম দিকের দিনগুলোতে একটু বেশি সচেতন থাকতে হবে।

প্রতিদিনের খাদ্যের পুষ্টিমান অন্যান্য সময়ের মতোই রাখার চেষ্টা করতে হবে, যদিও তা খুব সহজ না–ও হতে পারে। এ জন্য দরকার হলে পুষ্টিবিদের সাহায্য নিন।

শারীরিক শ্রম বা ব্যায়ামসহ স্বাভাবিক শারীরিক কর্মকাণ্ড চালানো যেতে পারে এ সময়। তবে দিনের বেলা কঠোর শ্রম বা ব্যায়াম না করাই ভালো। তারাবিহর নামাজকে শারীরিক শ্রমের বিকল্প হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত গ্লুকোজ বা মিষ্টিজাতীয় কিছু একটি খেয়ে নিতে হবে। দিন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যদি রক্তের গ্লুকোজ ৩.৯ মিলিমোল/লিটার বা তার চেয়ে কমে যায়, তাহলেও সেদিনের রোজা ভাঙা উচিত। যাঁরা ইনসুলিন, সালফুনাইলইউরিয়া-মেগিস্নটিনাইড–জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটার আশঙ্কা বেশি। আবার রক্তের গ্লুকোজ ১৬.৭ মিলিমোল/ লিটারের বেশি হলেও রোজা রাখা সম্ভব হবে না।

খাদ্য ব্যবস্থাপনা

ডায়াবেটিসের রোগীর রোজা রাখার সময় সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে খাদ্য ব্যবস্থাপনায়।

* সাহ্‌রির খাবার সাহ্‌রি শেষ হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে খাওয়া উচিত।

* ইফতারের সময় অধিক পরিমাণে মিষ্টি ও চর্বিজাতীয় খাবার খাবেন না।

* পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, যেন পানিশূন্যতায় না ভোগেন। ইফতারে একটা খেজুর খেতে পারেন। এই সময় ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও টক দই তালিকাভুক্ত করতে পারলে ভালো। ডাবের পানি পান করা যায়। চিনিমুক্ত পানীয় বেছে নিন।

* খাদ্যের ক্যালরি ঠিক রেখে খাওয়ার পরিমাণ এবং ধরন ঠিক করতে হবে।

* রমজানের আগে যে পরিমাণ ক্যালরিযুক্ত খাবার খেতেন, রমজানে ক্যালরির পরিমাণ ঠিক রেখে খাবার সময় এবং ধরন বদলাতে হবে। ইফতারের সময় অতিভোজন এবং সাহ্‌রিতে অল্প আহার পরিহার করতে হবে, বরং উল্টোটা হতে পারে।

রোগীর ওষুধের সমন্বয়

* যাঁরা দিনে একবার ডায়াবেটিসের ওষুধ (যেসব ওষুধ ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়ায়) খান, তাঁরা ইফতারের শুরুতে (রোজা ভাঙার সময়) সেটি খাবেন, তবে ডোজ একটু কমিয়ে নিতে হতে পারে।

* যাঁরা দিনে একাধিকবার ডায়াবেটিসের ওষুধ খান, তাঁরা সকালের মাত্রাটি ইফতারের শুরুতে এবং রাতের মাত্রাটির অর্ধেক পরিমাণে সাহ্‌রির আধা ঘণ্টা আগে খেতে পারেন।

* যেসব রোগী ইনসুলিন গ্রহণ করেন, তাঁদের রমজানের আগেই ইনসুলিনের ধরন ও মাত্রা ঠিক করে নেওয়া জরুরি। সাধারণত রমজানের সময় দীর্ঘমেয়াদি ইনসুলিন নেওয়া ভালো। দীর্ঘমেয়াদি এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ ইনসুলিন দিনে একবার নিতে হয়, এগুলোতে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার আশঙ্কা অনেকটা কম। যাঁরা রোজার আগে সকালের ও রাতের খাবারের আগে দুবার ইনসুলিন (প্রি-মিক্সড) নিতেন, তাঁরা সকালের ডোজটি সমপরিমাণেই ইফতারের আগে নেবেন, আর রাতের ডোজটির অর্ধেক ইফতারের আগে নেবেন।

বিশেষভাবে জানা প্রয়োজন

* এ বছর কোভিড–১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে সচেতনতা হিসেবে হাসপাতালে ফলোআপের জন্য যাওয়ার দরকার নেই। টেলিফোনে চিকিত্সকের পরামর্শ নিন।

* রোজার সময় নিজে ডায়াবেটিসের ওষুধ সমন্বয় করবেন না।

* সাহ্‌রি কিছুতেই বাদ দেওয়া যাবে না।

* রোজার সময় দিনের বেলা অতিরিক্ত ব্যায়াম করা উচিত নয়। সন্ধ্যার পর বাড়িতে হাঁটাহাঁটি করুন। কোভিড–১৯ সংক্রমণ ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এ বছর রমজানে কিছুতেই বাড়ির বাইরে যাবেন না।

* বাইরের খাবার গ্রহণ করবেন না। বাড়িতে তৈরি পুষ্টিকর স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খান।

* রক্তে শর্করা ওঠা–নামার কারণে অসুস্থ হলে এ সময় বিপদে পড়বেন। তাই প্রতিদিন না হলেও এক দিন পরপর রক্তে সুগার মাপুন ও আপনার চিকিত্সকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।

* অতিভোজন আর ভাজাপোড়ার কারণে অ্যাসিডিটি, গ্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া যেন না হয় সেদিকে লক্ষ রাখবেন।