মা-বাবার ভীতি, উদ্বেগ যেন শিশুর মধ্যে সঞ্চারিত না হয়

শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাজমুন নাহার।
শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নাজমুন নাহার।
>করোনাকালে শিশুদের সংক্রমণের দুশ্চিন্তার পাশাপাশি শিশুর নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান কার্যক্রম ইত্যাদি নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। একসময় শোনা গিয়েছিল, করোনায় শিশুদের ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এ সময় শিশুর সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলেছেন শিশু বিশেষজ্ঞ নাজমুন নাহার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডা. রাফিয়া আলম

প্রথম আলো: আমরা জেনেছিলাম প্রথম দিকে যে করোনায় শিশুদের করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি কম। কিন্তু এখন শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার, এমনকি আইসোলেশনে থাকা শিশুর মৃত্যুর সংবাদও আমরা পেয়েছি। শিশুদের কি আদৌ করোনার সংক্রমণের ঝুঁকি কম?

অধ্যাপক নাজমুন নাহার: শিশুদের মধ্যে সংক্রমণের হার কম, তবে একদমই ঝুঁকি নেই, তা নয়। করোনাভাইরাস সম্পর্কে আগে জানা ছিল যে এতে বয়স্কদের ঝুঁকি বেশি, কিন্তু আমরা কমবয়সীদেরও তীব্রভাবে ভুগতে দেখছি। এমনকি অপেক্ষাকৃত যুবা বয়সীরা মারাও গেছেন। মূলত যাঁদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাঁদেরই ঝুঁকি বেশি। সেটা যেকোনো বয়সেই হতে পারে, এমনকি শিশুদেরও। তবে এ রকম দু–একটি ঘটনা থেকে এমনটা বলা যায় না যে আমাদের দেশে ভাইরাসটির সংক্রমণের ধারা অন্য রকম। তবে শিশুরা এ রোগের অন্যতম বাহক। যেহেতু শিশুদের মধ্যে মৃদু ধরনের সংক্রমণ হয় আর উপসর্গ কম থাকে বা না–ও থাকতে পারে, সে জন্য শিশুরা নীরবে অন্যদের সংক্রমিত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। তাই শিশুদের সংক্রমণের বিষয়টিকে এখন গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।

প্রথম আলো: এই সময়ে শিশুদের নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও অন্যান্য রোগ তো আর থেমে নেই। করোনার সময় শিশুদের এসব রোগের স্বাভাবিক চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে কি?

নাজমুন নাহার: এ রকম পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার স্বার্থে হাসপাতালে না এসে সাধারণ ছোটখাটো সমস্যাগুলোর জন্য বাড়িতে বসেই চিকিৎসা চালাতে বলা হচ্ছে। টেলিফোনে চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন হাসপাতালের বহির্বিভাগ, সরকারের স্বাস্থ্য বাতায়ন ও অনেক চিকিৎসকের সংগঠন; এমনকি ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে টেলিফোন ও ই–মেইলে সেবা দিচ্ছেন। তবে জরুরি পরিস্থিতিতে হাসপাতালে নিতেই হবে। আমাদের দেখতে হবে, এ সময় সাধারণ অন্যান্য রোগের চিকিৎসা যেন আগের মতোই চলে। কারণ, নিউমোনিয়ার মতো রোগে সারা বছর শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে। সঠিক চিকিৎসা না পেলে করোনার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটবে।

প্রথম আলো: লকডাউন পরিস্থিতিতে শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি ব্যাহত হচ্ছে কি? এই পরিস্থিতিতে সময়মতো টিকা না দিতে পারলে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে এবং মা-বাবার পরবর্তী করণীয় কী?

নাজমুন নাহার: সরকারি টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে টিকাদান কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তবে এরই মধ্যে জানা গেছে যে সাম্প্রতিককালে টিকাদান কার্যক্রম প্রায় ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। হতে পারে যে লকডাউনের কারণে, যানবাহনের অভাবে বা ভীতির কারণে মা–বাবা শিশুকে টিকাদান কেন্দ্রে নিয়ে আসছেন না। টিকাদান কার্যক্রম ব্যাহত হলে পরবর্তী বছরগুলোতে শিশুদের অন্যান্য সংক্রামক রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। একেবারে সঠিক সময়ে টিকা দেওয়া না গেলেও টিকা যেন মিস না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে এবং যখনই সম্ভব হবে, তখনই টিকাদান কেন্দ্র থেকে টিকা দিয়ে নিতে হবে।

প্রথম আলো: করোনা সংকটে শিশুরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে কি? এ ক্ষেত্রে মা-বাবার করণীয় কী?

নাজমুন নাহার: এই পরিস্থিতি শিশুর মনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। তবে শিশুর মনকে দুশ্চিন্তা বা আতঙ্কের দিক থেকে মোড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে প্রবাহিত করা সহজ। কারণ, সহজেই শিশুর মন ভোলানো যায়। এ জন্য শিশুকে সময় দিতে হবে। শিশুকে গল্প শোনানো, শিশুর সঙ্গে খেলা, বই পড়তে বা ছবি আঁকতে উৎসাহ দেওয়া, এ রকম নানা কাজে শিশুকে ব্যস্ত রাখতে পারেন মা-বাবা। তাকে সৃজনশীল বিভিন্ন কাজে যুক্ত করতে হবে। আবার কর্মজীবী মা–বাবাকে এই সময় শিশু বেশি সময় কাছে পাচ্ছে, এটা একটা ভালো দিক। এতে অনেক শিশু এ সময় আগের চেয়ে বেশি আনন্দে আছে হয়তো। তবে মা–বাবাকে লক্ষ রাখতে হবে যেন তাঁদের ভীতি, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ শিশুসন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত না হয়। তবে শিশুদেরও করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানানো, হাত ধোয়ার গুরুত্ব ও নিয়মকানুন, মাস্ক পরা ও অন্য স্বাস্থ্যবিধিগুলো সম্পর্কে সচেতন করে তোলা উচিত।

প্রথম আলো: মা যদি করোনায় সংক্রমিত হন কিংবা মাকে যদি আইসোলেশনে থাকতে হয়, তাহলে শিশুর যত্ন অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে না?

নাজমুন নাহার: এ রকম হলে মায়ের কাছে শিশুকে যতটা কম যেতে দেওয়া যায়, ততই ভালো। তবে শিশু মায়ের দুধ পান করতে পারবে। করোনাভাইরাস মায়ের দুধের মাধ্যমে ছড়ায় না। মা মাস্ক পরে হাত ভালো করে ধুয়ে শিশুকে দুধ খাওয়াতে পারবেন। শিশুকে স্পর্শ করার আগে মাকে সাবান দিয়ে নিয়মমাফিক হাত ধুতে হবে। এ ছাড়া মা অন্যান্য ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখবেন। স্তন পরিষ্কার রাখবেন। শিশুর মুখের কাছে তিনি মুখ নেবেন না। দুধ খাওয়ানোর সময় ছাড়া অন্য সময় শিশুকে মায়ের কাছে রাখা যাবে না। আর শিশু যদি মায়ের দুধ খাওয়ার বয়সী না হয়, তাহলে পরিবারের অন্য কেউ শিশুর খাবারদাবার ও সার্বিক যত্নের ব্যবস্থা করবেন। সে ক্ষেত্রে শিশু মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। তাই অন্যরা তাকে সাহস জোগাবেন, মায়ের অভাব পূরণ করবেন আর নানা কাজে শিশুকে ব্যস্ত রাখবেন। দিনে কয়েকবার টেলিফোনে বা ভিডিও কলে মায়ের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করতে হবে।