করোনা মহামারি: দীর্ঘ মেয়াদে যা করতে হবে

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের কারণে হওয়া কোভিড-১৯ সংক্রমিত একটি রোগ, যা বর্তমানে মহামারি আকার ধারণ করেছে। বারবার নিজের গঠন পরিবর্তন করে সংক্রমিত হওয়ার হার প্রায় অপ্রতিরোধ্য করে এই রোগ এখন জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বাস্তবতা হলো এ ধরনের সংক্রামক ব্যাধি বা মহামারি থেকে আমরা কখনোই পুরোপুরিভাবে মুক্ত হব না। কালে কালে নতুন নামে, নতুনভাবে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ আসবে। সেগুলোকে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে এখনো কোনো কার্যকরী টিকা না এলেও অল্প পরিমাণ ওষুধ বাজারে আসতে শুরু করেছে।

ইতিমধ্যে অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন, অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন, অনেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই রোগের আরও দুই থেকে তিনটি ওয়েভ বা স্রোত মানবজাতিকে আঘাত হানতে পারে। তাই অন্তত আগামী দুই বছরের জন্য নিজেদের যতটুকু পারা যায়, ততটুকু নিরাপদ রাখতে জীবনযাত্রায় অল্প কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতেই হবে। দীর্ঘ মেয়াদে যা করা যেতে পারে:

১. অন্তত আগামী এক বছর নিজ এলাকার ভেতর সব ধরনের জনাকীর্ণ পরিবেশ এড়িয়ে চলুন। বাজারে গেলে এমন সময়ে যাবেন, যে সময় ক্রেতা কম থাকে। পার্কে গেলে এমন সময় যাবেন, যখন লোকসমাগম কম। খুব ভালো হয় যদি এলাকাবাসীর মধ্যে এটা নিয়ে একটা শৃঙ্খলা গড়ে ওঠে, যে কে কখন কোথায় যাবেন, কোথায় যাবেন না।

২. রাস্তার খোলা খাবার বা জনাকীর্ণ রেস্তোরাঁয় খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। হোম ডেলিভারি বা টেক-অ্যাওয়ের মাধ্যমে খাবার বাসায় আনিয়ে নিলেও খাওয়ার আগে খাবারের গুণগত মান নিশ্চিত করে তারপর খান। খাবারের পুষ্টিমান সম্পর্কে সচেতন হোন। কেবল দামি খাবারেই পুষ্টি মেলে, তা কিন্তু সঠিক নয়। বাড়ির আশপাশে অযত্নে জন্মানো শাকসবজিতেই আপনার প্রয়োজনীয় পুষ্টি বিদ্যমান। সম্ভব হলে নিয়মিত মৌসুমি ফল খান।

৩. সামাজিক অনুষ্ঠান, যেমন বিয়ে, জন্মদিন বা এ ধরনের জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। পারিবারিক অনুষ্ঠানেও বাহুল্য বর্জন করুন।

৪. খুবই জরুরি না হলে দেশের ভেতরেও দূরপাল্লার ভ্রমণ থেকে বিরত থাকুন। পাহাড়-নদী-সমুদ্র অথবা নানান দর্শনীয় স্থান দেখতে আমাদের সবারই ভালো লাগে। তবে বাস্তবতা হলো নতুন জায়গায় গিয়ে অন্যকে আক্রান্ত করার বা নিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি না নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

৫. নিরাপদ থাকতে আগামী দুই বছরের জন্য দেশের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। অনেক দেশ আস্তে আস্তে নিজেদের বন্দরগুলো খুলে দেবে। তবে নিজের পূর্ণ নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে ভ্রমণ করবেন না। এ ছাড়া বাজারে বেশ কিছু টিকা পাওয়া যায়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভ্রমণের আগে সেসব টিকা নিয়ে নিতে পারেন।

৬. সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে নিষ্ঠাবান হোন। বেতন–বিল ইত্যাদি জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে লাইনে দাঁড়ালে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ান। একে অন্যের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বেন না। ধাক্কাধাক্কি করবেন না। খুবই ভালো হয় যদি লেনদেন অনলাইনে করা যায়, যাতে সরাসরি টাকার সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা যায়।

৭. হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় মুখ ঢাকুন। হাঁচি-কাশি হয়েছে এমন কারও থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন। রাস্তায় বা খোলা জায়গার কফ, থুতু, ব্যবহৃত টিস্যু ইত্যাদি ফেলা থেকে বিরত থাকুন। পথের ধারে মলমূত্র ত্যাগ করাকে নিরুৎসাহিত করুন।

৮. বাইরে বের হলে মাস্ক ব্যবহার করা নিরাপদ। তবে সর্বসাধারণের জন্য পেশাদার রেস্পিরেটর মাস্ক ব্যবহার করা আবশ্যক নয়।

৯. রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে নিজের প্রতি যত্নবান হোন। স্বল্প আহার, পরিপূর্ণ বিশ্রাম ও কায়িক পরিশ্রম করুন। প্রচুর পানি খান। গলা শুকনো থাকলে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। ধূমপান ও মদ্যপান এড়িয়ে চলুন। সকাল ও বিকেলে অন্তত আধ ঘণ্টা রোদে থাকুন।

১০. সেলুন বা নাপিতের দোকানে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। অনেকেই চুল ফেলে দিয়েছেন। অনেকেই বাসায় চুল ফেলে দেওয়া বা ছেঁটে ফেলা শুরু করেছেন। যদি সেলুন স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখতে সক্ষম না হয়, সে ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলা ছাড়া গতি নেই।

১১. যে ধরনের কাজ বা মিটিং অ্যাপের মাধ্যমে, ফোনে, ভিডিও কলে বা ই-মেইলে করা সম্ভব, সেসব করার জন্য জনসমাগম করা বন্ধ রাখুন। হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর নিতেও অনলাইনে মিটিং শেষে অনেকে একজন কর্মচারীকে অন্যদের বাসায় পাঠাচ্ছেন, যা অনুচিত।

১২. পার্টি, ক্লাব, সিনেমা হল, মল—এ ধরনের জনাকীর্ণ স্থানে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। নিতান্তই যেতে হলে ঘণ্টাখানেকের বেশি অবস্থান করবেন না।

১৩. অনেক এলাকায় রোগী দেখতে যাওয়ার একটা রীতি প্রচলিত আছে। কেউ অসুস্থ হয়েছে শুনলে দল বেঁধে দেখতে যাওয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসুন। নিতান্তই সহযোগিতা বা সহমর্মিতা জানাতে চাইলে আর্থিক বা অন্য কোনোভাবে করুন।

১৪. বিদেশ থেকে সদ্য আসা ব্যক্তি নিজ দায়িত্বে অন্তত ১৪ দিনের জন্য সবার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন। সম্ভব হলে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকুন। বিদেশ থেকে ফিরেই গণসংযোগ করবেন না। এতে এলাকার কারও অসুস্থতা থাকলে বিদেশফেরত ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারেন অথবা তাঁর নিজের কোনো রোগ থেকে থাকলে তিনি সবাইকে আক্রান্ত করতে পারেন।

১৫. এ ধরনের পরিস্থিতিতে সবারই মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হবে, হওয়াটাই স্বাভাবিক। অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, অনিশ্চয়তা ইত্যাদি নানান কারণে আস্তে আস্তে মানসিক চাপ বেড়ে সবাই কিছুটা খিটখিটে বা বদমেজাজি হয়ে উঠবেন ধীরে ধীরে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে না লড়ে নিজেদের সামলে নেওয়াটাই এখন সবার কাজ হওয়া উচিত। প্রত্যেকেই প্রথমে নিজের এবং তারপর অন্যের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও যত্নবান হোন।

একে অন্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে ভাবতে হবে। এই মহামারিতে কেবল নিজে ভালো থাকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। অন্যের ভালো থাকাটা মাথায় রেখেই কেবল নিজের ভালো থাকা নিশ্চিত করা যাবে।

লেখক: এমবিবিএস (ইউএসটিসি-১৮), বিসিএস (স্বাস্থ্য), ডিএলও ট্রেইনি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।