করোনা: ব্যক্তির আচরণে পরিবর্তন আনতেই হবে

কোভিড-১৯ ঠেকাতে নেওয়া লকডাউনের সিদ্ধান্তে অর্থনীতি ভয়াবহ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বিশ্বের বহু মানুষ আজ সরকারি সহায়তার দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স
কোভিড-১৯ ঠেকাতে নেওয়া লকডাউনের সিদ্ধান্তে অর্থনীতি ভয়াবহ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বিশ্বের বহু মানুষ আজ সরকারি সহায়তার দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার নীতি মেনে চলা ছাড়া এই মুহূর্তে মানুষের হাতে অন্য কোনো বিকল্প নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইংরেজি ভাষ্য ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’-এর বাংলা হিসেবে ‘সামাজিক দূরত্ব’ কথাটি ব্যবহার করা হচ্ছে হরদম। এই ভাষান্তর সাদাচোখে ঠিক থাকলেও তার যে প্রভাব পড়েছে, তা কিন্তু ভয়াবহ। অনেকে একে সত্যি সত্যি সামাজিক দূরত্ব বলে ভেবে নিয়েছে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এই সময়েই বৃহত্তর সমাজের একজন হিসেবে ভূমিকা নেওয়াটা সবচেয়ে জরুরি। কারণ, এই দুর্যোগে সামষ্টিক আচরণই নির্ধারণ করে দেবে মানুষের ভবিষ্যৎ।

করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ ঘরবন্দী থাকতে বাধ্য হচ্ছে। রাষ্ট্রও অর্থনৈতিক ধসের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে লকডাউনের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে। এতে প্রতিটি দেশের এক বিরাট অংশের মানুষ ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের মতো করে লকডাউন তুলে দেওয়ার আন্দোলন এখন অনেক দেশেই হচ্ছে বা হব হব করছে। বহু দেশেই এমন ধারার আন্দোলন বা জনরোষ সৃষ্টির আগেই প্রশাসন সবকিছু খুলে দিচ্ছে।

মানুষ কেন এত বড় ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সবকিছু স্বাভাবিক দশায় ফিরে পেতে চাইছে? তারা কি অবুঝ? না, তারা অবুঝ নয়। তারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত। দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকার মানসিক ধকলটির কথাই উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্তের মনে উঁকি দেয় আগে। আর মধ্য, নিম্ন-মধ্য বা নিম্নবিত্ত মানুষের মাথায় আগে আসে অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টি। এ কারণে দীর্ঘদিন লকডাউনে বসে থাকাটা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। সে উদগ্রীব হয়ে কাজে যাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। আবার রাষ্ট্র ও ব্যবসায়ী শ্রেণিও দ্রুততম সময়ে সব স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চায়। কারণ, সে খুব ভালো করেই জানে, যে সংকট নিম্নবিত্তকে আক্রান্ত করার মধ্য দিয়ে তার বিস্তার ঘটাচ্ছে, তা তাকেও অনায়াসে গিলে ফেলার ক্ষমতা রাখে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

মোদ্দা কথা, সব স্থবির হয়ে থাক, এটা এক কথায় কেউই চায় না। সবাই চায় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সঙ্গে সবগুলো ক্ষেত্র আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠুক। কারণ, এর সঙ্গে জড়িত অর্থনীতি। সব চালু না হলে না খেয়ে মরতে হতে পারে। কিন্তু সব চালু করলে যদি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরতে হয়? এ তো মহা ঝামেলা। এ তো সেই শাঁখের করাত, যার আছে দুদিকে ধার। এই ধার দুপাশকেই কাটতে থাকে। এমনকি সিদ্ধান্তহীনতায় বসে থাকলেও এ কাটতে থাকে। তাই তৃতীয় বিকল্পের দিকে তাকাতে হবে।

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি এই উপদেশ দিচ্ছে যে অর্থনীতি স্বাভাবিক দশায় ফেরাতে সব চালু করতে হবে। তবে কোনোভাবেই আগের উপায়ে নয়। অর্থাৎ, করোনাভাইরাস মানুষের আচরণ ও অভ্যাসে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছে। প্রতিটি সংকটই মানুষকে কিছু না কিছু শেখায়। আর মহামারির মতো এত বড় সংকট সাধারণত এক ধরনের অভ্যাসগত পরিবর্তনের দাবি নিয়ে হাজির হয়। আজকের মানুষের পরিচ্ছন্নতার যে স্বাভাবিক ধারণা, তা কিন্তু গড়ে উঠেছিল এমন সংকট মোকাবিলার মধ্য দিয়েই। এই বঙ্গে যেমন ডায়রিয়ার প্রকোপ ঠেকানোর কৌশল হিসেবেই যেখানে-সেখানে মলমূত্র ত্যাগের অভ্যাস পরিবর্তন কিংবা নিরাপদ পানি পানের অভ্যাস গড়ার বিষয়টি সামনে আসে। একই সঙ্গে খাবার গ্রহণের আগে হাত ধোয়ার যে অভ্যাস, তারও শুরু জীবাণু দ্বারা সৃষ্ট রোগের প্রকোপ ঠেকানোর কৌশল হিসেবেই।

বলার অপেক্ষা রাখে না, আজকের এই করোনাভাইরাসের প্রকোপ এমনই অভ্যাস বদলের ডাক নিয়ে হাজির হয়েছে। আর এই বদলটি ব্যক্তি পর্যায়ে হলে হবে না। কারণ, এ ভাইরাসের বিস্তার একটি বৈশ্বিক মহামারির সৃষ্টি করেছে। তাই এ অভ্যাস বদল হতে হবে সামষ্টিকভাবে। এ ক্ষেত্রে জনপরিসরে একজন মানুষের আচরণ কেমন হবে, অন্যের সঙ্গে ভাববিনিময়ের ক্ষেত্রে নতুন কৌশল কী হবে, বাস ও রেলস্টেশনের মতো জনসমাগমের স্থলে মানুষের মান-ব্যবহারটি কী হবে, জনসমাগমের এসব স্থলের নকশা কেমন হওয়া চাই—এ সবকিছুই নির্ধারণ করে দেবে ভাইরাসটির সঙ্গে মানুষ কত দ্রুত সহাবস্থান করতে শিখছে তা। যেহেতু খুব দ্রুত এর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতি আসছে না বা একটি ভ্যাকসিন পেতে এবং তা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে যেতে এখনো অনেক সময় লাগবে, তাই যে দেশের মানুষ যত দ্রুত এই কৌশলগুলো নিজেদের মতো করে আবিষ্কার করবে, তত দ্রুতই সব স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।

মার্কিন রোগতত্ত্ববিদেরা এরই মধ্যে বলেছেন, কোনো কার্যকর ভ্যাকসিন ও নির্দিষ্ট চিকিৎসাপদ্ধতি হাতে আসার আগেই সবকিছু চালু করতে হলে মানুষকে নিজেদের মধ্যকার সরাসরি যোগাযোগের হার কমিয়ে আনতে হবে। জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির রোগতত্ত্ববিদ ড. জেরার্ডো চাওয়েলের নেতৃত্বে পরিচালিত এ-সম্পর্কিত এক গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, মানুষকে নিজেদের মধ্যকার সরাসরি যোগাযোগের পরিমাণ আগের চেয়ে ৬৫ শতাংশ কমিয়ে সব কাজ সমাধা করার কৌশল শিখতে হবে। তবেই রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রেখে সব স্বাভাবিক করা যাবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, সরাসরি পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এমন পরিবর্তন এক বিরাট আচরিক পরিবর্তনের দাবি জানায়। দাবিটি শুধু ব্যক্তি মানুষের আচরণগত পরিবর্তনের কথাই বলে না। এটি একই সঙ্গে যাবতীয় সামাজিক চুক্তির নবায়নের কথাও বলে। এটি ব্যক্তিকে সমষ্টির কথা আরও বেশি করে মনে করিয়ে দিচ্ছে। কারণ, শুধু নিজে সাবধান থাকার মধ্য দিয়ে এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী থেকে শুরু করে দিনে একবার মাত্র যার সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তার সুস্থ ও সতর্ক থাকার ওপরও নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নির্ভর করছে। এ কারণে ব্যক্তিক আচরণ নয়, সামষ্টিক আচরণই নির্ধারণ করবে সবকিছু কবে স্বাভাবিক হবে।

কোনো সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি থেকে নিস্তার মিলবে না। অর্থনীতি বাঁচাতে লকডাউন শিথিলের মতো সিদ্ধান্ত মড়কের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণ হবে কি না, তা আদতেই নির্ধারণ করবে সমষ্টি। এ ক্ষেত্রে সত্যিকার অর্থে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীই চালকের ভূমিকায়। তাদের আমলে না নিয়ে, তাদের সুরক্ষার কথা বিবেচনা না করে কোনো সিদ্ধান্তের আরোপণ ভয়াবহ হতে পারে। অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার মতো দুধারি তলোয়ারের হাত থেকে বাঁচতে হলে একটি অঞ্চলের জনসমষ্টি ও ওই অঞ্চলের প্রশাসন উভয়কেই দায়িত্ব নিতে হবে। প্রশাসনিক অঙ্গের মধ্য থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা জনস্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দায়িত্ব নিয়ে জনসমষ্টিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতির বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে (এই অঞ্চলে স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যবহার ও নিরাপদ পানি পানের বিষয়ে পরিচালিত সচেতনতার মতো করে)। ঠিক একইভাবে সমষ্টিকেও বুঝতে হবে, ব্যক্তি নয়, সামষ্টিক চিন্তা ও দায়িত্ববোধই একমাত্র সবাইকে রক্ষা করতে পারে। উভয় পক্ষে এ বোধ যত দ্রুত আসবে, ততই দ্রুত সব স্বাভাবিক হবে।