ভোলার ভুলটি ভুলিনি

সন্ধ্যা নদীর খাল, ঠিক সন্ধ্যার মুখে। ছবি: লেখক
সন্ধ্যা নদীর খাল, ঠিক সন্ধ্যার মুখে। ছবি: লেখক

ঘাট ছেড়েই স্পিডবোটের গতি বাড়িয়ে দিলেন চালক। যেন নামের সার্থকতা প্রমাণে ব্যস্ত তিনি। তাই মৃদু মেজাজে বয়ে চলা বাতাসও গায়ে তিরের মতো বিঁধছিল। প্রকৃতিকে চোখ জুড়িয়ে দেখার বাসনা থেকে সামনে দৃষ্টি রেখে বসেছিলাম, বাতাসের ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খেতে খেতে মনে হচ্ছিল, পড়ন্ত বিকেলের সিদ্ধান্তটা ভুল হয়েছে!

ভোলার ভেদুরিয়া ঘাটটি তেঁতুলিয়া নদীর পাড়ে। জেলা শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার পথ। এই ঘাট থেকেই বরিশালগামী দ্রুতগতির নৌযানে চেপে বসেছিলাম। সে স্পিডবোট অল্প সময় পরই তেঁতুলিয়া নদী পেছেনে ফেলে পৌঁছে গেল তিন নদ-নদীর মোহনায়, সেখানে কালাবদর, আড়িয়াল খাঁ আর সন্ধ্যা এসে গল্প জুড়েছে যেন। সেই মাঝনদীতে গতি সীমিত করে চালকের হাঁক, 'ভাই, সকলে ভাড়াটা দিয়েন।'

চারপাশে তাকিয়ে দেখি পানি আর পানি, দূরে বক্ররেখার মতো নদী তীর। ফেব্রুয়ারির এই শুকনো মৌসুমেও জায়গাটা ভয় জাগিয়ে দিল। শুনেছি, এই মোহনায় বর্ষা মৌসুমে লঞ্চ চালাতে হিমশিম খেতে হয় চালকদের। আর এখানে, সিকি শতাব্দী আগেও অসংখ্য লঞ্চডুবির কিংবদন্তি তো আছেই।

যাক সে বৃত্তান্ত। নদী দর্শনের চেয়ে তখন মাথায় প্রকট হয়েছে চালকের ভাড়া চাওয়ার ব্যাপারটা। চালকদের এই এক স্বভাব। কেন বাপু, ঘাট ছাড়ার আগে টাকা নিলেই পারতে, নাওনি যখন গন্তব্যে পৌঁছে চাও, এখন এই মাঝদরিয়ায় কেউ যদি বলে টাকা নেই, তাঁকে কি জলে ফেলে যাবে?

প্রশ্নটা উঁকি দিয়েছিল পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে। একবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে হাতিরঝিল হয়ে বাড্ডার দিকে যাচ্ছিলাম। মাইক্রোবাস যখন কুনিপাড়ায় তখন চালকমশাই এক যাত্রীকে ভাড়া তুলে দিতে বললেন। একে একে সবাই ভাড়া দিলেও, একজন কাচুমাচু হয়ে বললেন, 'ওস্তাদ, ট্যাকা যে নাই।’ আর যায় কোথায়! ভাবখানা এমন, টাকা নেই তো পায়ে হেঁটে যাও। সেই ব্যবস্থা করতেই পুলিশ প্লাজার পাশে লোকাটাকে নামিয়েই দিল। শুধু কি তাই, ভাড়াটুকু উশুল করে নিতে চালক কিছুক্ষণ গালাগাল করে গেলেন। অবশ্য ভাড়া ছাড়া অনেক যাত্রী বহনের বিকল্প নজিরও দেখেছি। তাই নগরীর বাস থেকে হিউম্যান হলার, খেয়া পারাপারের ডিঙি নৌকা থেকে স্পিডবোট কোথাও যেন স্বস্তি নেই।

এদিকে স্পিডবোটের ভাড়া দিতে গিয়ে আমার আকেল গুড়ুম হওয়ার জোগাড়। এই তো সকালেই যে পথে এলাম ৩০০ টাকায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় সেই ভাড়া কমে ১২০ টাকা হয় কী করে! দেশের সবকিছুর দাম যখন ঊর্ধ্বমুখী, তখন নৌপথের ভাড়া কয়েক ঘণ্টায় হ্রাস! প্রশ্নটা করেই বসি, 'বরিশালের ভাড়া ১২০ টাকা?'

মেঘনা নদীর তীরের জীবন। ছবি: লেখক
মেঘনা নদীর তীরের জীবন। ছবি: লেখক

চালকসহ স্পিডবোটের যাত্রীদের ১১ জোড়া চোখ মুহূর্তে এবার আমার দিকে নিক্ষিপ্ত হলো। অনেকের তাকানোয় মিশে থাকল সহমর্মিতা। কেউ তাকালেন এমনভাবে, যার অর্থ খুঁজতে গিয়ে দুটি শব্দই মনে পড়ল 'আবুল একটা'! মুখফুটে একজন বলেই বসল, 'লাহারহাট ঘাট কই, আর বরিশাল কই!' আমি কী করে বুঝব স্পিডবোটটি লাহারহাট যাচ্ছে! সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা বরিশালগামী স্পিডবোটের নির্ধারিত ঘাট সেটি। সেখান থেকেই তো ছেড়ে এল!

আমি যে প্রথম ভ্রমণ করছি, ততক্ষণে বুঝে গেছেন সবাই। তাই যথাসম্ভব উপদেশ দিতে শুরু করলেন। সন্ধ্যার মুহূর্তে এখন বিকল্প পথ ধরতে হবে। আমার জন্য সবচেয়ে সুন্দর সমাধান দিলেন সবাই যাঁর যাঁর পক্ষ থেকে। আমিও বুঝে গেছি, ভোলায় এসে দ্বিতীয় ভুলটি এরই মধ্যে করে ফেলেছি!

থাক, সেই পথের ভুল। এ বেলায় ভোলা যাওয়ার কথাটুকু একটু না হয় বলি।

পথ ভুলের আগে
ফেব্রুয়ারির শেষ দিন গিয়েছিলাম বরিশালে, অফিসের কাজে। কাজ শেষ করে হাতে একটি দিন ঘোরাঘুরির জন্য পেলাম। সকাল থেকেই মনে হলো, যাই তো দেখি, ভোলায় গিয়ে মন ভোলানোর কিছু পাই কি না। রোমাঞ্চকর ভ্রমণের চিন্তা মাথায় আসতেই, চর কুকড়িমুকড়ি ভ্রমণের বিষয়টিও ভাবলাম। ভাবনার পরিচ্ছন্ন তথ্য দিলেন সহকর্মী মো. নেয়ামতউল্যাহ। তিনি বলেছিলেন, চর কুকড়িমুকড়ি যেতে হলে সকাল সকাল ভোলায় পৌঁছাতে হবে। কিন্তু আমার সকাল হলো সাড়ে ১০টায়। বরিশাল স্পিডবোট ঘাটে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হলো। যখন কীর্তনখোলার বুকে স্পিডবোট ঢেউ তুলল, তখন প্রায় সাড়ে ১১টা।

গতিময় ছন্দে নৌযানটি কীর্তনখোলাকে বিদায় জানিয়ে সরু খালে প্রবেশ করল। এগিয়ে চলল দুপাশে বসতি, বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে। সবুজ প্রকৃতিতে আবিষ্ট হয়ে ভোলায় যখন পৌঁছালাম, তখন ভরদুপুর। প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধুদের খোঁজ করে, একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনিই জানালেন, ভোলা ছেড়ে অবেলায় দুর্গম চরে যাওয়ার ঝক্কির কথা। সময় স্বল্পতার কারণে সে যাত্রায় ইস্তফা দিয়ে শহরের পথে পথে ঘুরতে থাকলাম। সঙ্গী প্রথম আলোর ভোলা প্রতিনিধি।

দুপুরের খাবার সেরে ভোলা শহরের নতুন বাজারে হাঁটছিলাম। অতিথি আপ্যায়নে এবার যোগ হলো মিষ্টি। যেনতেন মিষ্টি নয়, গুড়ের মিষ্টি। 'বিষুর মিষ্টি' নামে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। কত পদের মিষ্টির স্বাদই তো নেওয়া হয়েছে, গুড়ের তৈরি মিষ্টির স্বাদ সেই প্রথম।

নাম তার তুলাতুলির বাজার
মিষ্টির স্বাদ মুখে নিয়ে শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরের তুলাতুলি বাজারে গিয়েছিলাম। বাজারের গা ঘেঁষে চলে গেছে মেঘনা নদী। নদীটি এখানে এসে যেন ভিন্ন এক রূপ নিয়েছে। সে রূপে মুগ্ধ হতে ভোলা শহর থেকে বিকেল কাটাতে অনেকে আসেন। তাই বেড়িবাঁধ ঘিরে গড়ে ওঠেছে পর্যটনকেন্দ্র।

ভোলায় খাওয়া গুড়ের রসগোল্লা। ছবি: লেখক
ভোলায় খাওয়া গুড়ের রসগোল্লা। ছবি: লেখক

দুপুর বলে মানুষের আনাগোনা ছিল কম। আমরা গেলাম নদীর পাড়ে। যেখানে জেলে নৌকাগুলো রোদ পোহাচ্ছিল। পাটাতানে শুয়ে-বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন জেলেরা। কেউ কেউ আবার পরম যত্নে ছেঁড়া জাল সেলাইয়ের কাজ করছিলেন। তাঁদের এই অখণ্ড অবসরের কারণ, সেদিন থেকে নদীতে মাছ ধরার ওপর জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

আরও কিছুটা সময় তুলাতুলি বাজার এলাকায় কাটিয়ে ফিরেছিলাম ভোলা শহরে। সে রাতেই ছিল ঢাকা ফেরার লঞ্চ। তাই বরিশালে তখনই যেতে হবে বলে শহরে নেমেই অটোরিকশা নিয়ে পৌঁছাই ভেদুরিয়া ঘাটে। বরিশালগামী স্পিডবোট যেখান থেকে ছাড়ে, সেখানে নামা মাত্র একজন বলে উঠলেন, 'একজনই লাগবে যান যান...।' আমিও বিনাবাক্যে তড়িঘড়ি উঠে পড়ি স্পিডবোটে! আর সেখানেই ভুল। বাকিটা ইতিহাস।