আশ্রম থেকে ডেনমার্ক: রং ও রেখায় শেফালীর গল্পকথা

স্বাভাবিক হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলো। বিভিন্ন দেশের মানুষ হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে লকডাউন উঠে যাওয়ায়। এর কয়েক দিন আগে কথা হচ্ছিল কোপেনহেগেনের শিল্পী শেফালী রনটির সঙ্গে। বাংলাদেশের সঙ্গে শেফালীর অদ্ভুত নাড়ির টান। সে রহস্য পরে না হয় ভেদ করা যাবে। তার আগে অবরুদ্ধ জীবনের নানা দিক নিয়ে তাঁর সঙ্গে যেসব কথা হয়েছে, তার কিছুটা ভাগাভাগি করে নেওয়া যেতে পারে।

অবরুদ্ধ জীবন তাঁর মোটেও মন্দ কাটেনি। বরং অনেকের মতোই বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই নিয়েছেন। সময়টাকে কাজে লাগানোর প্রয়াস পেয়েছেন; নতুনতর বোধ, অন্যতর প্রতীতির জন্ম নিয়েছে। ক্যানভাস ভরিয়েছেন তুলির টানে। ডান হাতে ব্যথা ইদানীং কষ্ট দিচ্ছে। ফলে বাঁ হাত ব্যবহার করছেন। আর এই সুযোগ তাঁকে ক্রমেই সব্যসাচী করে তুলছে।

ইউনেসকোর ভার্চ্যুয়াল প্রদর্শনী ‘মাস্ক-আর্ট ক্রিয়েটিভিটি আন্ডার লকডাউন: ইউনেসকো অ্যান্ড মিডোজ আর্টিস্টস এগেইনস্ট কোভিড-নাইন্টিন’-এ শেফালীর মাস্ক আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে। ছবি: শেফালী রনটির ফেসবুক পেজ
ইউনেসকোর ভার্চ্যুয়াল প্রদর্শনী ‘মাস্ক-আর্ট ক্রিয়েটিভিটি আন্ডার লকডাউন: ইউনেসকো অ্যান্ড মিডোজ আর্টিস্টস এগেইনস্ট কোভিড-নাইন্টিন’-এ শেফালীর মাস্ক আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে। ছবি: শেফালী রনটির ফেসবুক পেজ

বাধ্যতামূলক বন্দিজীবন আমাদের উপলব্ধিকে গভীরতা দিয়েছে। অভাববোধ ভাবতে শিখিয়েছে। মৌলিক অনেক বিষয় আমরা ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের বোধোদয় হচ্ছে। পরিবারের প্রতি মমত্ববোধ প্রগাঢ় হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম এই সংকটে আমাদের কিছুটা হলেও ভাবনাহীন রাখছে, যোগাযোগকে সহজ করে দিয়ে, এভাবেই বলছিলেন তিনি, ‘অনেকেই বাইরে বেরিয়েছেন। স্বাভাবিক সময়ের মতোই। অবশ্যই নিয়ম মেনে। তবে আমি যাইনি। এই পরিস্থিতি আমাদের সবার জন্যই একটা ওয়েক আপ কল। তবে এর নেতিবাচক দিকও যে নেই তা নয়। দুঃখের বিষয় হলো, অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। অনেকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।’

প্রথম চার সপ্তাহ মানুষ ভুলে গিয়েছিল সবকিছু। তারা যে অসুস্থ, সেটাও। কারণ করোনাভীতি কাজ করেছে সবার মধ্যে।

শেফালী রনটি। ছবি: শেফালী রনটির ফেসবুক পেজ
শেফালী রনটি। ছবি: শেফালী রনটির ফেসবুক পেজ

এই সময়টাকে ব্যস্ত জীবনের একটি বিরতি হিসেবেই দেখছেন শেফালী। কোনো তাড়াহুড়ো নয়, বরং আস্তে ধীরেই এগিয়ে নিতে চান সবকিছু। সংসারে সময় দিয়ে ফাঁক বের করে আঁকছেন। একটি প্রকল্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজও চলছে। এক বন্ধুর সঙ্গে যৌথভাবে; যার মূল উপজীব্যই হলো জীবন।

এমন টুকরা টুকরা নানা কথাই হয়েছে কোপেনহেগেনের চিত্রশিল্পী শেফালীর সঙ্গে; আর কথাগুলো অক্ষর দিয়ে সাজাতে যে সময় নেওয়া হয়েছে। তার মাঝেই দারুণ এক খবর দিয়েছেন শেফালী। ইউনেসকো সম্প্রতি একটি ভার্চ্যুয়াল প্রদর্শনীর আয়োজন করে। প্রদর্শনীর বিষয় ছিল ‘মাস্ক -আর্ট ক্রিয়েটিভিটি আন্ডার লকডাউন-ইউনেসকো অ্যান্ড মিডোজ আর্টিস্টস এগেইনস্ট কোভিড-নাইন্টিন’। এই প্রদর্শনীতে শেফালীর মাস্ক আর্টও নির্বাচিত হয়েছে।

শেফালীর হালের কথা তাঁর মুখ থেকেই আমরা সবিস্তারে শুনতে পারি। এ জন্য সে বর্ণনায় না গিয়ে বরং এই শিল্পীর শিকড়ের সন্ধান দেওয়া যাক। তাঁর জন্ম চট্টগ্রামে। স্বাধীনতার বছর দুয়েক পরে। তেমনই শুনেছেন। আসল নাম মনে নেই। ছয় বছর বয়সে দাদু তাঁকে ঢাকার এক খ্রিষ্টান মিশনে দিয়ে দেন। পাড়া-প্রতিবেশীরা ধরে নিয়েছিল, তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এই অপবাদ বৃদ্ধ দীর্ঘদিন বয়ে বেড়িয়েছেন। তবে ২৩ বছর আগে দেশে ফিরে শিকড়সন্ধানী শেফালী খুঁজে পান দাদুকে। দেখা করে আসেন। ফলে তিনি অন্তত শান্তিতে মরতে পেরেছেন।

শেফালীর জীবনের পরতে পরতে টানাপোড়েনের ঠাস বুনট। ছেলেবেলায় মা তাঁদের ছেড়ে অন্যখানে গিয়ে সংসার পাতেন। দারিদ্র আর দেখভালের ঝক্কি এড়াতেই তাঁকে হয়তো আশ্রমে দেওয়া। সেটা কাগজ-কলমের হিসাবে ১৯৭৯ সাল। আশ্রমের এক সিস্টার তাঁর নাম দেন শেফালী। এটাই তাঁর পরিচয়। আবিশ্ব তাঁকে শেফালী নামেই চেনে।

আশ্রমে বেশি দিন থাকতে হয়নি। যে কদিন ছিলেন প্রতিদিনই সবাইকে গাইতে শুনেছেন ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গানটি। নিজেও গেয়েছেন। এটা আজও মনে আছে। তাই দুই লাইন গেয়েও শুনিয়েছেন কথোপকথনের শেষে।

সেই উনআশি সালে এক দিনেমার পরিবার তাঁকে দত্তক নেওয়ার পর নাম দেওয়া হয় অ্যান রনটি। নতুন বাবা-মা তাঁকে নিয়ে চলে যান ডেনমার্ক। তবে রাজধানী কোপেনহেগেনে নয়। বরং উপকূলের শহর আরহুসে। ভাগ্য এখানেও তাঁর সঙ্গে মশকরা করে। কারণ এখানে মা অন্য পুরুষের সঙ্গে চলে যান। এরপর বাবা আর দ্বার পরিগ্রহ করেননি। বরং তাঁকে মানুষ করেছেন। তাঁকে বড় হয়ে উঠতে হয়েছে খুব দ্রুত। স্কুলে যাওয়া, ভাষা শেখা, বাবার জন্য রান্না করা নিত্য রুটিনে পরিণত হয়। কিন্তু জীবনের অনেক পাঠ শিখতে না পারার আক্ষেপটা তাঁর থেকেই গেছে।

মায়ের স্নেহ পাননি বলেই নিজের সন্তানদের (এক ছেলে ও এক মেয়ে) আগলে রাখেন। নিজে মায়ের ভূমিকা পালনের সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। এমনকি শিশুদের নিয়ে কাজ করে তাদেরও মা হয়ে ওঠার প্রয়াস যেন পান তিনি।

বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবীর সঙ্গে, ঢাকা, ২০১৮। ছবি: শেফালী রনটির ফেসবুক পেজ
বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবীর সঙ্গে, ঢাকা, ২০১৮। ছবি: শেফালী রনটির ফেসবুক পেজ

স্কুলে ভালো নাচতেন। আঁকতে আর গান গাইতেও পারতেন। কিন্তু সৃজনশীলতায় সায় ছিল না বাবার। তবে এক শিক্ষক বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করান। লন্ডনের ফেম স্কুলে নাচ শেখা এবং নাচ নিয়ে পড়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্য ছিল না বাবার। অর্ধেক সরকার দিলেও বাকিটা দিতে না পারায় সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে।

‘এই পরিস্থিতিতে মনের ভার লাঘব করতে গির্জায় গিয়ে বসে থাকতাম। আমাকে দুদণ্ড প্রশান্তি দিতেন ক্রুস বিদ্ধ যিশু। তাঁকে আঁকতাম। আমার আঁকা দেখে এক ওলন্দাজ শিল্পী বলেছিলেন, দেখো, তুমি একদিন বিখ্যাত শিল্পী হবে।…বিখ্যাত হয়েছি কি না, জানি না। তবে আমার শিল্পের কদর করে মানুষ। যে কোনো প্রশংসা আমাকে মনে করিয়ে দেয় সেই শিল্পীর ভবিষ্যদ্বাণী। বিশ্বাস করো, তখন ছোট ছিলাম তাই তাঁর কোনো নাম-ঠিকানা রাখিনি। তবে এখন মনে মনে ঠিকই খুঁজি তাঁকে। যদি কোনো দিন পেয়ে যাই।’

‘কম্পিউটার আসার আগে সবকিছু হাতেই আঁকতে হতো। এ জন্যই বেছে নিয়েছিলাম গ্রাফিক ডিজাইন। গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে সিঙ্গাপুর আর লন্ডনে কাজ করেছি। পরে পেইন্টিং শিখেছি। আসলে নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আমার শিক্ষা মূলত শিশুদের উন্নয়ন আর দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজে লাগানোর জন্য।’ কথার পিঠে কথা আসতে থাকল জানান শেফালী।

শেফালীর ক্যানভাসে মেলে সেই প্রতিফলন। পঞ্চাশ দশকের শিল্পদল ‘কোবরা’ আর আভাঁ গার্দ আন্দোলনে প্রাণিত তাঁর রঙেরা গল্পকথক। তাঁর অনন্য স্টাইল মুগ্ধতা ছড়ায়। আধাবিমূর্ত, শিশুতোষ, স্বতঃস্ফূর্ত আর সারল্যে বাঙময় মাছ, সাপ, পাখি আর শিশুরা। কারও সঙ্গে সেভাবে মেলানো যাবে না। সাপ তাঁর কাছে স্মৃতির মণিকাঞ্চন। চট্টগ্রামে তাঁদের মূল জীবিকাই ছিল মাছ ধরা। বর্ষাকালে মাছ ধরতে গিয়ে একাধিকবার সাপে কামড়েছে। সাপ তাই তাঁর ক্যানভাসে ফিরে ফিরে আসে।

স্টুডিওতে ছবি আঁকছেন শেফালী। ছবি: শেফালী রনটির ফেসবুক পেজ
স্টুডিওতে ছবি আঁকছেন শেফালী। ছবি: শেফালী রনটির ফেসবুক পেজ

শেফালীর আলোচিত দুটি সিরিজ ‘জয় অব লাইফ’ আর ‘ট্রিবিউট টু মাদার’। জীবনের আনন্দ খুঁজে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে তিনি খোঁজেন মাকে। নিজের মা কিংবা পালক মা। অথবা নিজের মাতৃত্বের উদযাপনও হতে পারে। ডেনমার্ক ছাড়া সুইডেন, ঘানা আর দুবাইতে পড়েছেন শিল্প বিষয়ে। ডেনমার্ক, দুবাইসহ তাঁর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হয়েছে বিশ্বের নানা দেশের নানা শহরে। পরিব্রাজকের মগ্নতায় ঘুরেছেন বহু দেশ। গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করার মাঝে পরিচিত পুরুষটিই এখন তাঁর অর্ধেক জীবন।

নানা স্বীকৃতি আর সম্মাননা পেয়েছেন। সবশেষ ২০১৬ সালে ভূষিত হয়েছেন দুবাই ইন্টারন্যাশনাল আর্ট সিম্পোজিয়াম সম্মাননায়। কিউরেট করছেন ইভেই আর্ট কম্পিটিশন ‘ডিসকভার ইওরসেল্ফ’। শারজাহ ইন্টারন্যাশনাল বিয়েনাল ফর চিলড্রেন’স আর্ট জুরি বোর্ডের অন্যতম সদস্যও তিনি।

মাঝে বেশ কিছুদিন দুবাইতে থেকে ফিরে গিয়ে থিতু হয়েছেন কোপেনহেগেনে। শেফালীর পয়ের নিচে শর্ষে। ঘুরে বেড়ান তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে, এদেশ-সেদেশ। অংশ নেওয়ার কথা ছিল বেশ কয়েকটি প্রদর্শনীতে। কিন্তু করোনার কারণে বাতিল হয়েছে সেগুলো।

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে ফেরার অভিজ্ঞতা মধুর ছিল না বলেই দীর্ঘদিন আর আসেননি। ২২ বছর পর ফিরেছিলেন এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল ২০১৮-তে। সেবারই পরিচয় আর দীর্ঘ আলাপ হয়। সেই থেকেই রয়ে গেছে যোগাযোগ। এই সুযোগে তাই কথা হয় শেফালীর সঙ্গে। ভার্চ্যুয়াল অন্তরঙ্গচারিতার ফাঁকে তাই জুড়ে দেওয়া গেল তাঁর জীবনের জলছবি।