'যার বাঁচারই কথা ছিল না, সে-ই এসএসসি পাস'

মা-বাবার সঙ্গে ফাহিম। ছবি: সংগৃহীত
মা-বাবার সঙ্গে ফাহিম। ছবি: সংগৃহীত

এসএসসির ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার্থীদের সাফল্যের খবরে ফেসবুক সয়লাব। স্বজনেরা নানাভাবে প্রিয় সন্তানের কৃতিত্বকে করেছেন উদযাপন। তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিওনেটাল সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল হানিফ টাবলুর ফেসবুকে দেওয়া পোস্টটি ছিল একেবারেই ব্যতিক্রম। তিনি পোস্ট দিয়েছেন তাঁর এক রোগীর পাস করার খবর জানিয়ে। সেই রোগীর নাম ফাহিম নূর নিশাদ। সে ময়মনসিংহের কারিগরি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট থেকে এবার জিপিএ–৪.৫ পেয়েছে। তবে তার ব্যাপারটি অন্য রকম।

জাতীয় শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক আবদুল হানিফের রোগীকে নিয়ে পোস্ট দেওয়ার কারণ জানতে ফিরে যেতে হবে ২০০৩ সালে। ফাহিম নূর নিশাদ ওই বছরেই জন্মগত জটিলতা নিয়ে জন্মায়। আবদুল হানিফ প্রথম আলোকে জানান, জন্মের সময় বুক ও পেটের পর্দায় বেশ বড় গ্যাপ থাকায় ফাহিমের নাড়িভুঁড়ির বেশির ভাগই বুকে চলে গিয়েছিল। ফুসফুস জায়গা না পাওয়ায় সেভাবে বাড়েনি। শ্বাসকষ্ট নিয়ে জন্ম নেয় ফাহিম। এ ধরনের জন্মগত জটিলতা নিয়ে ভূমিষ্ঠ শিশুদের এক–তৃতীয়াংশ বেঁচে থাকে। ফাহিম যখন জন্ম নেয়, তখন ওকে বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে আধুনিক যন্ত্রপাতি বলতে গেলে কিছুই ছিল না। সেই ছেলে পাস করায় মা–বাবার পাশাপাশি চিকিৎসকদেরও আনন্দের সীমা নেই।

ফাহিম। ছবি: সংগৃহীত
ফাহিম। ছবি: সংগৃহীত

আবদুল হানিফ তাঁর ফেসবুকে অনেকগুলো চিকিৎসাসংক্রান্ত টার্ম উল্লেখ করে ২০০৩ সালের কথা লিখেছেন, ‘এনআইসিইউ নেই। ২–৩ দিন অক্সিজেন দিয়ে রেখে বাবাকে আল্লাহ ভরসা বলে অপারেশন করে ফেললাম...২–৩ দিন খুব ক্রিটিক্যাল গেল...আল্লাহ আল্লাহ করা ছাড়া কিছু করার ছিল না (এখনো নাই!)। আল্লাহই বাঁচালেন। কিন্তু ৬ দিনের দিন আবার বিপত্তি...।’
অধ্যাপক আবদুল হানিফ তাঁর পোস্টে ওই সময় ফাহিমের চিকিৎসায় তাঁর সঙ্গে অন্য যে চিকিৎসকেরা জড়িত ছিলেন, তাঁদের নামও উল্লেখ করেছেন। ফাহিমের মা–বাবা ফোন করে ছেলের পাসের খবর দিয়েছেন হানিফকে। তিনি জানালেন, এখন আর ফাহিমের শারীরিক বড় কোনো জটিলতা নেই। ঈদে ফাহিমের পরিবারের সঙ্গে টেলিফোনে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। এই অধ্যাপক ফাহিমের একদম ছোটবেলার ছবি এবং ফলোআপে আসার পর তোলা ছবিগুলোও যত্ন করেই রেখে দিয়েছেন।

টেলিফোনে ফাহিমের বাবা এ কে এম আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে কথা হলো। বাবা জানালেন, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ফাহিমের জন্ম। সমস্যা দেখে ময়মনসিংহ মেডিকেলের চিকিৎসকেরা ফাহিমকে ঢাকায় নিতে বলেন। এক দিনের নবজাতককে নিয়ে রাজ্জাকের দৌড় শুরু হয়েছিল। প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলেও সেদিন ছেলেকে ভর্তি করাতে পারেননি। রাজধানীর বড় বড় আরও কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে শেষ ভরসা হিসেবে আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলেকে নিয়ে যান। হাসপাতালে সকালে অধ্যাপক আবদুল হানিফের সঙ্গে দেখা। তারপর যা কিছু করার চিকিৎসকেরাই করেন। বাবা বলেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে’ চিকিৎসকেরা ছেলের অস্ত্রোপচার করেন। দীর্ঘ ১ মাস ২২ দিন কাটে হাসপাতালে। অন্যদিকে অস্ত্রোপচারে জটিলতার জন্য ফাহিমের মা ফাতেমা বেগম চিকিৎসাধীন ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এতে মা ও ছেলের দেখা হয়নি দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময়। সব ঝক্কি সামলেছেন আবদুর রাজ্জাক।

আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ছেলেটা বিভিন্ন জটিলতা নিয়ে জন্ম নিছে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরি। কোথাও ভর্তি করতে পারি না। কোনো কোনো হাসপাতালের চিকিৎসক ভয় দেখিয়ে বলেছে, দেশে ছেলের চিকিৎসা সম্ভব না। হলেও চার–পাঁচ লাখ টাকা লাগবে। তখন পকেটে টাকাও ছিল না। চোখের সামনে চিকিৎসার অভাবে ছেলেটা মরে যাবে—এ চিন্তায় দিশাহারা হয়ে পড়ি।’

ওই ছেলে এখন এসএসসি পাস করেছে বলে টেলিফোনেই এই বাবার উচ্ছ্বাস টের পাওয়া গেল। বলেন, ‘ছেলের জীবনে কত যে ট্র্যাজেডি গেছে! এরপর ছেলের ১২–১৩ বছরের সময় গলব্লাডারে পাথর হলে তা–ও অপারেশন করতে হয়। কিন্তু ছেলে এসব কিছু কেয়ার করে না। আমরাও ওরে কোনো বিষয়ে চাপ দিই না। পড়াশোনার জন্যও চাপ দিই না। ও যে চোখের সামনে বেঁচে আছে, এই তো অনেক।’