করোনা এবং ওসিডি

অদৃশ্য করোনাভাইরাসের আতঙ্ক আজ প্যান্ডেমিক আকার ধারণ করেছে। খুবই ছোঁয়াচে। সবাই আতঙ্কিত। রোগ যাতে না ছড়ায় সেই ব্যবস্থা নিতে বিশ্বব্যপী বেড়েছে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা। সামাজিক দূরত্ব মানা এখন জরুরি।

মানুষের আয়রোজগার, বাচ্চাদের পড়াশোনা, পয়লা বৈশাখের মতো একটা সর্বজনীন বাঙালি উত্সব সবই বন্ধ হয়েছিল। ঈদেও সবাই ছিল ঘরবন্দী। এখনো অনেকে থাকছে ঘরে। বাইরে গেলে নাকে–মুখে মাস্ক ব্যবহার করছে। হাঁচি–কাশি, হাসপাতাল এড়িয়ে চলছে। ‘ট্যাপ অ্যান্ড পে’ পদ্ধতিতে বাজার করতে আগ্রহী করে তুলছে মানুষকে। তাহলে এটাকে কী বলবেন? করোনা কি অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি) বাড়িয়ে দিচ্ছে?

সারা বিশ্বে ওসিডি রোগীর সংখ্যা প্রচুর। যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি ৪০ জনে ১ জন এবং শিশুদের প্রতি ১০০ জনে ১ জন এই রোগে ভোগে।

ওসিডি বা চিন্তাবাতিক ও বাধ্যতাধর্মী আচরণ (শুচিবাই) একটি উদ্বেগজনিত রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তালিকায় এই মেডিকেল ডিজঅ্যাবিলিটির প্রধান ১০টি রোগের মধ্যে এটি একটি। সারা বিশ্বে প্রতি ৫০ জনে ১ জন জীবনের কোনো না কোনো সময় এই রোগে ভোগে। সাধারণত শৈশব ও কৈশোরে এই রোগটি শুরু হয়। নারী ও পুরুষ উভয়ই এই রোগে ভুগতে পারেন। নিকট আত্মীয়দের মধ্যে এই রোগ হওয়ার আশঙ্কা পাঁচ গুণ বেশি।

বিষণ্নতা রোগ, ফোবিক ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্তির পরই আসে ওসিডির নাম। এই রোগের ব্যাপকতা অনেক বেশি, কিন্তু এই সব আচরণকে আমরা রীতিনীতি সংস্কার হিসেবে গণ্য করি।

ওসিডি বা শুচিবাই

এটা এমন ধরনের রোগ যাতে অবসেশন অথবা কমপালশন বা দুটিই থাকতে পারে। অবসেশন একধরনের মর্মপীড়াদায়ক চিন্তা, ছবি অথবা তাড়না, যা মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাথায় আসে। এই চিন্তাভাবনাগুলো বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয় এবং কোনো যুক্তির ধার ধারে না।

আর কমপালশন হলো অবসেশনে প্রভাবিত হয়ে এবং অস্বস্তি ও উদ্বেগ কমানোর জন্য যে কাজ করা হয়। যেমন অকারণে বারবার হাত ধোয়া, গণনা করা, বারবার যাচাই করা, গুছিয়ে রাখা এবং একই কথা বারবার বলা ইত্যাদি।

কেন এমন হয়

ওসিডির জন্য বংশগত কারণ যদি ৫৫ ভাগ দায়ী হয় তবে পারিপার্শ্বিক কারণ ৪৫ ভাগ। বংশগত কারণ ছাড়াও এটা হতে পারে। এই রোগের জন্য মানসিক চাপ অনেকাংশে দায়ী। শিশুরা প্রকাশ করতে পারে না, তাই তাদের প্রকাশভঙ্গি বড়দের থেকে কিছুটা ভিন্ন হয়। স্কুলে ভর্তি বা পরীক্ষার চাপ, সহপাঠীদের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা শিশুদের মনে অভিভাবকদের অজ্ঞাতেই একটা কালো ছায়া ফেলে। বয়ঃসন্ধির সময় মেয়েদের পিরিয়ড শুরু হওয়া, ছেলেদের স্বপ্নদোষ—অনেক ক্ষেত্রে ওসিডির সূত্রপাতের ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রাখে। কিশোর বয়সে বিয়ে, গর্ভধারণ বা বাচ্চা প্রসবও প্রভাব ফেলে।

জীবনের যেকোনো ঘটনা দিয়ে রোগটি শুরু হতে পারে। ব্যক্তিজীবনের মানসিক চাপ, পরিত্যক্ত ব্যান্ডেজ বা বর্জ্য ইত্যাদি দেখেও হতে পারে। তবে খুব কম ক্ষেত্রে শারীরিক রোগের কারণে এটি হতে পারে।

ওসিডিতে ব্রেনের কর্টিকো-স্ট্রায়েটাল-থ্যালামোকর্টিক্যাল লুপ অথবা সার্কিট আক্রান্ত হয়ে থাকে। এতে শরীরে জৈব রাসায়নিক সিরোটনিন, গ্লুটামেট, ডোপামিনের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে।

লক্ষণ

ওসিডির লক্ষণগুলোকে আমরা চারটি মাত্রায় ভাগ করতে পারি। কোনো না কোনো মাত্রার সঙ্গে আপনার লক্ষণগুলো মিলে যাবে। ওসিডি আক্রান্তের এক বা একাধিক রকম লক্ষণ থাকতে পারে, যা চারটি শ্রেণিতে ভাগ করে নেওয়া যায়।

l জীবাণু ও সংক্রমণজনিত উদ্বেগ।

l ক্ষতি, আঘাত বা দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী ভেবে উদ্বেগ।

l অগ্রহণযোগ্য চিন্তাগুলো।

l সামঞ্জস্যপূর্ণ, সম্পূর্ণ ও নিখুঁতভাবে করার বিষয়ে উদ্বেগ।

আপনি কী করছেন?

ওসিডি বংশানুক্রমিক রোগ। হয়তো আপনি অনেক দিন থেকে এই রোগে ভুগছেন। আপনার কারণে আপনি নিজে বা আপনার আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী বা অনাত্মীয় কেউ মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত নন। আপনার ওসিডি আপনাকে একটা ভুল অযৌক্তিক চিন্তার দ্বারা তাড়িত করে। যাকে আপনি চাইলেও মাথা থেকে সরাতে পারেন না। আর তারই কারণে আপনি ধোয়াধুয়ি, গোসল করা, বাথরুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিচ্ছেন। আপনি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এতে আপনার পরিবার, আপনার পেশাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আপনার এই আচরণ আপনার পরিবারের বা সমাজের আর কেউ করছে না। আপনাকে বাধা দিলে আপনি রাগ করছেন। ঝগড়া করছেন। খাওয়াদাওয়া, ঘুম সবকিছুরই ব্যাঘাত ঘটছে। ওসিডির ক্ষেত্রে শুধু আপনিই আইসোলেশনে থাকছেন। পরিবার থেকে, সমাজ থেকে একমাত্র আপনারই সামাজিক দূরত্ব, শারীরিক দূরত্ব বাড়ছে। আপনার কাছ থেকে করোনার মতো কারও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা নেই। আপনার অজান্তেই আপনি ঘরবন্দী হয়ে পড়ছেন।

আপনি ক্রমেই অন্যান্য মানসিক রোগ যেমন বিষণ্নতা, ফোবিয়া, প্যানিক ডিজঅর্ডারে ভুগতে পারেন। নিজেকে আঘাত করার বা আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। সঙ্গে যদি অন্যান্য শারীরিক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ থাকে, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেও এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়ে।

প্রয়োজনীয় চিকিত্সা

ওসিডির চিকিৎসা বিভিন্ন ওষুধ, সাইকোথেরাপি, শৃঙ্খলার মধ্য থেকে করা হয়। ওষুধের ক্ষেত্রে আছে এসএসআরআই গ্রুপের ওষুধ এবং অন্যান্য। এ ছাড়া রোগী ও তার পরিবারকে রোগ সম্পর্কে জানানো, তাদের চিকিত্সা নিতে উত্সাহিত করা।

রোগীকে সাইকোথেরাপির মাধ্যমেও চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। এর মধ্যে এক্সপোজার অ্যান্ড রেসপন্স প্রিভেনশন থেরাপি, শাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন থেরাপি, রিলাক্সেশন থেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি উল্লেখযোগ্য।

এ ছাড়া রোগীর জন্য পর্যাপ্ত ঘুম, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি জরুরি।

যেমন খাবার খেতে হবে

ওসিডি রোগীদের খেতে হবে সিরোটনিন সমৃদ্ধ খাবার। যার মধ্যে আছে—

l আমিষ: মাংস, কলিজা, ডিম, দুধ, সামুদ্রিক মাছ।

l ফলমূল জাতীয় খাবার: কলা, আনারস, আম, আঙুর, খেজুর।

l শাকসবজি: পালংশাক, পুঁইশাক, বেগুন, ফুলকপি, শিম জাতীয় বীজ, মাশরুম, টমেটো, ব্রকলি।

একই সঙ্গে যেসব খাবার এই রোগীদের এড়িয়ে চলতে হবে তার মধ্যে আছে—মিষ্টি জাতীয় খাবার, ক্যাফেইনযুক্ত খাবার যেমন চকলেট, চা, কফি, কোমল পানীয়, ক্যাফেইনযুক্ত কিছু ওষুধ, মদ জাতীয় পানীয় ও কৌটায় সংরক্ষিত খাবার।

ওসিডি আক্রান্ত বুঝবেন যেভাবে

l আপনি কি অতিরিক্ত ধোয়ামোছা করেন অথবা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকেন?             

l আপনি কি কোনো কিছু অতিরিক্ত যাচাই-বাছাই করেন?

l আপনার মাথায় অযাচিতভাবে কি কোনো চিন্তা আসে? যা কিনা আপনি চাইলেও মাথা থেকে সহজে বের করতে পারেন না?

l আপনার দৈনন্দিন কাজ শেষ করতে কি অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়?

l আপনার মধ্যে আসবাব, বই, খাতা, কাপড়চোপড় অথবা যেকোনো জিনিস নির্দিষ্ট ছকে গুছিয়ে রাখার প্রবণতা আছে কি?

এসব প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ মানে আপনি ওসিডি ঝুঁকিতে আছেন।

যা মনে রাখবেন

অন্যান্য শারীরিক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ চিকিত্সার মাধ্যমে যেভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, ঠিক তেমনি এই ওসিডি রোগটিও চিকিত্সার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এই সব আচরণগুলোকে স্বাভাবিক না ভেবে কমিয়ে আনতে চেষ্টা করুন। সচেতন হন। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

আর করোনা হচ্ছে সাময়িক ভাইরাসজনিত রোগ। বিশ্ববাসী এখন ভ্যাকসিনের আশায় দিন গুনছে। সার্স, মার্স, প্লেগ, কলেরা, গুটিবসন্ত যেমন মহামারি আকার ধারণ করেছিল, তেমনি এটা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অনেক বেশি ছোঁয়াচে। এর প্রভাব কত দিন থাকবে বলা যাচ্ছে না। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন কমাতে, মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা কমাতে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন। সচেতন হোন। নিজে ও অন্যকে সুরক্ষিত রাখুন।

ডা. সুলতানা আলগিন, সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ ও ওসিডি কনসালট্যান্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।