নতুন স্বাভাবিক এল জীবনে

করোনাকালে চলাফেরায় মানতে হচ্ছে নতুন রীতি। নতুন স্বাভাবিকে যেন অভ্যস্ত হচ্ছে পৃথিবী। মডেল: অনামিকা ও আবীর। ছবি: সুমন ইউসুফ
করোনাকালে চলাফেরায় মানতে হচ্ছে নতুন রীতি। নতুন স্বাভাবিকে যেন অভ্যস্ত হচ্ছে পৃথিবী। মডেল: অনামিকা ও আবীর। ছবি: সুমন ইউসুফ

‘সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা কৃষ্ণকলির দিনগুলো যদি থাকত।’

কিন্তু সেই দিনরাত্রি আর নেই। নতুন স্বাভাবিক মানে ‘নিউ নরমাল’–এর মুখোমুখি আমরা। ২০১৯ সালে বছরের শেষের দিকে মানবদেহে ঝাঁপিয়ে পড়ল যে অধরা। অচেনা–অনাহূত অতিথি সেই করোনাভাইরাস সারা পৃথিবী দাপিয়ে বেরাল, বেরাচ্ছে—একই অঙ্গে তার কত রূপ!

বলছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ স্তিফেন কার্লটন, আমরা তো ফিরে যেতে পারব না কোভিড–১৯–এর আগের সময়ে। এ যেন এক অচেনা অভাবিত বিস্ফোরণ। টুকরোগুলো পড়ে আছে সর্বত্র। ছোট–মাঝারি ব্যবসাগুলো টিকবে না, এরই মধ্যে অনেকে চাকরি খুইয়েছেন।

ভ্রমণ, পর্যটন, হোটেল, রেস্তোরাঁ খুচরো ব্যবসা—সবকিছুর ওপর পড়বে প্রভাব। শিল্পও সংকুচিত হয়ে আসবে।

নিয়োগকর্তারা বুঝে গেছেন, কর্মচারীরা বাড়ি থেকে অফিস করলে অফিস বেশ চলে, তাই বড় বড় দালান ভাড়া করার দরকার নেই।

ভাঙা টুকরোগুলো আবার একত্র করে নতুন এক স্বাভাবিক সময়ের অভ্যর্থনার জন্য হলো তৈরি। অর্থনীতি আবার নতুন করে গড়ার সময় এল, আরও স্মার্ট আরও ভিন্ন সাজে সাজবে সব। এত দিন ধরে যে অসাম্য, বৈষম্য ছিল, ছিল অবিচারের সংস্কৃতি, এর মেরামতি কি হবে?

সৃষ্টি হবে নতুন চাকরি, বাড়বে মজুরি, জনস্বাস্থ্য–শিশুস্বাস্থ্যের আওতা কি বাড়বে?

চাকরির বাজার যেন মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো, চেয়ারগুলো চাকরি, যে ভালো খেলবে সে–ই করবে চেয়ার দখল।

আমরা এমন বিশ্বের স্বপ্ন দেখব অলস বেলায়? সবাই মিলে সুরক্ষা করবে জনগোষ্ঠী, পরিবেশ পরিবর্তনের জন্য চলবে লড়াই, অর্থনৈতিক অন্যায্যতা হবে দূর?

এই তো দক্ষিণ কোরিয়ায় স্কুল খোলার একটা চেষ্টা হয়েছিল কয়েকদিন আগে। ঢোকার আগে তাপমাত্রা মাপা হচ্ছিল, স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করা হচ্ছিল...স্কুলে ফেরার প্রস্তুতি। একদিন খুলে পরের দিন থেকেই আবার স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয় সেদেশে।

প্রতিদিনের জীবনে ছন্দ ফেরানোর চেষ্টা, অবস্থা বুঝে আবার নতুন ব্যবস্থা, সংক্রমণ যাতে উসকে না ওঠে, আবার অর্থনীতি যাতে রক্ষা হয়—দুটোর মধ্যে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা। ভাইরাস বেশ নিয়ন্ত্রণে, সত্যি কি তা–ই?

এদিকে ভাইরাস টেস্ট আর অ্যান্টিবডি টেস্ট দুটো মিলিয়ে অঙ্ক কষা চলছে। খোলার জন্য কত চেষ্টা!

সময়ের স্বাভাবিক দৃশ্যে এল পরিবর্তন। ভোক্তারা বদলেছেন। নিজেকে নিয়ে, পরিবারকে নিয়ে উৎকণ্ঠা; চাকরি, ব্যবসা নিয়ে উদ্বেগ।

অনলাইন কেনাকাটা রমরমা; বিউটি সার্ভিস, রেস্তোরাঁয় গিয়ে আহার, শপিং মলে ব্যয় আরও দেরি হচ্ছে। মুভি বা থিয়েটার দেখা পিছিয়ে গেল। টিভি শো দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, গাড়ি–বাড়ি কেনা—এসবে আগ্রহও নেই। অন্দরসজ্জা, এসব এখন আর তেমন হচ্ছে না। নিরামিষ আহার বাড়বে।

হাত ধোয়া হবে নতুন জীবনের অংশ, সেই সঙ্গে যত্রতত্র থুতু ফেলা কি বন্ধ হবে? শারীরিক বিচ্ছিন্নতার রেশ রয়ে গেল। উড়াল অভিবাদন, আলিঙ্গনের চল বাড়বে। একে অপরের বুকে বুক লাগিয়ে উষ্ণতা অনুভবের দিন আর নেই। জোরেশোরে এখনো চলে ফেসবুক, টেক্সট মেসেজ, হোয়াটসঅ্যাপ। ভিডিও কল, জুম সম্মেলন জীবনের হবে অংশ। হাত ধোয়ার চল ছিল ডাক্তারদের ১৭৪ বছর আগে থেকে। হাসপাতাল সংক্রমণ এড়ানোর বড় পন্থা। আর লোকসমাজে এই পরিচ্ছন্নতা সংস্কৃতি এল আনন্দ–সংবাদ হয়ে।

পুরোনো আচরণের বাইরে কিছু করতে গেলে তা কঠিন হয় মানুষের রপ্ত করতে, কিন্তু একদিন তা অভ্যাস হয়ে যাবে। মাস্ক পরে হাতে স্যানিটাইজার নিয়ে ৬ ফুট দূরত্ব রেখে মানুষ চলছে। মন্দ কী?

তবে সংস্কৃতি বদলাতে গেলে নেতাদের করে দেখাতে হবে, নব আচরণের মডেল হতে হবে। একে আলিঙ্গন করতে হবে। টিকার আশা আছে, তবে ওষুধের আশা দূরে। এর মধ্যে অন্য রকম জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। সরকার কিছু নিষেধ শিথিল করল, সাধারণের জন্য তিন স্তরের কাপড়ের মাস্ক পরার চল চালু হলো বলে। আর না মানলে জরিমানা নয় মোটিভেশন—এমন ধারণা বিজ্ঞদের।

কোভিড–পূর্ব জগতে ফিরব কি?

সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক অবিচার, পরিবেশের অধঃপতন কি বন্ধ হবে? ইতিহাস বলে, প্লেগ মহামারির পর সমাজে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এমন পরিবর্তন কী আসবে করোনা–উত্তরকালে? নতুন যুগের দ্বারে আমরা করোনাকে ছাপিয়ে উঠব, বিজ্ঞানের ওপর বিশ্বাস আর আত্মপ্রত্যয়  হবে আমাদের শক্তি। বিজ্ঞানকে অবহেলা করেছি, করেছি অবহেলা পরিবেশকে—দাবানল জ্বলেছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায়, উষ্ণতার তুঙ্গে উঠছে এই গ্রহ। হিমশৈল আর হিমবাহ (গ্লাসিয়ার) গলছে, বন্যা আর খরা বিপন্ন করেছে আমাদের, আফ্রিকায় নেমেছে পঙ্গপালের ঝাঁক। পরিবেশবিজ্ঞানী বিল মেক কিবেন বিস্ময়ের সঙ্গে মনের দুঃখে বলেছেন, ‘এর মাশুল গুনতে হয় আমাদের।’

ইতিহাসের এক অধ্যাপক মাসখানেক আগে বইটি লিখেছেন এপিডেমিকস অ্যান্ড সোসাইট ফ্রম দ্য ব্ল্যাক ডেথ টু দ্য প্রেজেন্ট। বিজ্ঞান ভিন্ন, কিন্তু প্লট একই। প্লেগ প্রতিরোধের ওপর নির্মিত কলাকৌশল এখনো চলে। সঙ্গনিরোধ, শারীরিক বিচ্ছিন্নতা, লকডাউন। পিপিই। পিপিই বলতে তখন শুধু মাস্ক, বিরাট লম্বা ঠোঁট, মিষ্টি সুবাসিত দুর্গন্ধ এড়ানোর জন্য। হাতে লম্বা লাঠি, সবাই দূরে দূরে। প্লেগের পর এল অনেক রূপান্তর।

এল পয়োনিষ্কাশন প্রণালি, টয়লেট। হাউজিং রেগুলেশন, পাকা রাস্তা, আধুনিক নগরীর স্বাস্থ্যবিধি। এশিয়াটিক কলেরার অভিজ্ঞতার পর এল পয়োনিষ্কাশন পদ্ধতি।

ঔপন্যাসিক অরুন্ধতী রায় বলেছেন কোভিড সংকট নিয়ে। আমরা বাইরের লোক আর শত্রুদের হাত থেকে সীমান্ত রক্ষায় ব্যস্ত। আছে ইমিগ্রেশন কন্ট্রোল, বায়োমেট্রিক্স, সীমান্ত নজরদারি। আছে অস্ত্র, আছে বোমা, নিউক্লিয়ার অস্ত্র। সাবমেরিন। কিন্তু নেই সোয়াব, নেই গ্লাভস, নেই মাস্ক, নেই যন্ত্রপাতি, নেই ওষুধ। এই মাইক্রো জীব আমাদের অপরিচিত। সংখ্যায় আমাদের ছাপিয়ে পরিব্যাপ্ত হচ্ছে, ভ্রমণ করে সঙ্গোপনে, কোনো দেশ গ্রাহ্য নেই, সামাজিক মাধ্যমকে তোয়াক্কা নেই। ক্রীড়াবিদেরা অন্তরীণ, কনসার্ট থেমে আছে। করোনা আমাদের সমাজের বড় ফাটল দেখাল। নগরী অনেক নীরব, নেই জীবনের কোলাহল, হৃদয়ের চলায় নেই জীবনের স্পন্দন। গরিবের ওপর বোঝা চাপবে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে আমরা পরস্পর হৃদয়ের কথা বলব চোখে চোখে দূরভাষে আর ভিডিওর মাধ্যমে। ছোট ছেলেমেয়েরা ভার্চ্যুয়ালে বন্দী, দোষ তাদের নয়।

আমরা আছি এক ট্রানজিট লাউঞ্জে। অতীত আর আগামী দিনের যোগ তৈরি হচ্ছে। আমাদের বুদ্ধি, আমাদের সমমর্মিতা, আমাদের মনের শক্তি নিয়ে যাবে আমাদের ইপ্সিত লক্ষ্যে। প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমানেরা কাজ করছেন সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে। বদলে যাবে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা। ঘরের ভেতর থাকবে না ধোঁয়াশা, আমরা দেখব নীল আকাশ। বন্য প্রাণীর জীবনে আসবে নতুন ছন্দ। আবার শুরু হবে অর্থনীতি পুরোনো খোলনলচে বদলে। ঝাঁপ দিয়ে উঠব প্লেনে। বদলে যাবে দিনরাত্রির রুটিন। আমরা আরও স্বাস্থ্যসচেতন হব আর শৃঙ্খলার মধ্যে আসব, আমাদের পরিচিত পরিবেশ বদলাবে। বদলাবে সামাজিক রীতি–নীতি, আমাদের অন্তরের জগৎ আর চিরাচরিত সংস্কৃতি কি খুব বদলাবে? আবার কী জমবে মেলা হাটে–মাঠে–ঘাটে? বৈশাখী মেলা, বসন্ত উৎসব? স্বজনের শেষ বিদায়ে কি আমরা আগের মতো অংশ নেব? উষ্ণ আলিঙ্গন কি থাকবে?