যাঁর চিকিৎসা বাড়িতেই সম্ভব, তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি না করাই সমীচীন: ডা. রুবীনা ইয়াসমীন

ডা. রুবীনা ইয়াসমীন
ডা. রুবীনা ইয়াসমীন
কোভিড-১৯ সম্পর্কে মানুষের মনে কাজ করছে নানা শঙ্কা, আতঙ্ক আর বিভ্রান্তি। এ সময় জ্বর–কাশির মতো উপসর্গ দেখা দিলে বা করোনাভাইরাস পজিটিভ হলে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, বাড়ির অন্যদেরই-বা করণীয় কী? এসব বিষয় নিয়ে ৫ জুন রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. রুবীনা ইয়াসমীন–এর সঙ্গে কথা বলেছে প্র স্বাস্থ্য। গত ২০ এপ্রিল থেকে এই হাসপাতালটি বিশেষায়িত কোভিড হাসপাতাল হিসেবে শত শত মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে। অধ্যাপক রুবীনা ইয়াসমীন শুরু থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডা. রাফিয়া আলম

 প্র স্বাস্থ্য: করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক রোগীকে কাছ থেকে দেখছেন আপনি। দেশে করোনার ধরন, জটিলতা কেমন মনে হয় আপনার কাছে? 

অধ্যাপক রুবীনা ইয়াসমীন: আমাদের দেশের অধিকাংশ রোগী মাইলড গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। মানে তাদের মৃদু ধরনের উপসর্গ হচ্ছে আর তেমন বড় কোনো জটিলতা ছাড়াই সেরে উঠছেন। খুব কম রোগীরই হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন আছে। করোনায় আক্রান্ত হলে বা করোনার লক্ষণ দেখা দিলে তাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বেশির ভাগ করোনা রোগীরই জটিলতার আশঙ্কা কম, বিশেষত যাঁদের অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা নেই।
যাঁদের আগে থেকে কোনো শারীরিক সমস্যা আছে, তাঁদেরই জটিলতার হার বেশি। জটিলতা বলতে সেপসিস (সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া), শক (অভ্যন্তরীণ রক্ত সঞ্চালন অপর্যাপ্ত হওয়া) এবং এআরডিএস (অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিনড্রোম, শ্বাসতন্ত্রের একধরনের মারাত্মক জটিলতা) হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। সারা বিশ্বেই এই চিত্র মোটামুটি একই রকম। যাঁদের আগে থেকে দীর্ঘমেয়াদি কিডনির সমস্যা আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে জটিলতা বেশি দেখা যাচ্ছে। ডায়ালাইসিসের পূর্বশর্ত হিসেবে কিছু রোগের নিরীক্ষণ (স্ক্রিনিং) করতে হয়; অনেক সময় এই স্ক্রিনিং পরীক্ষা করার জন্য যেটুকু সময় লাগছে, তার মধ্যেই রোগীর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। যাঁদের কিডনি, লিভার, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, ক্যানসার ও অন্যান্য জটিলতা আগে থেকেই বিদ্যমান তাঁদের করোনা হলে অবহেলা না করতে পরামর্শ দেব। এ ধরনের ব্যক্তির হাসপাতালে ভর্তি করানো জরুরি।


প্র স্বাস্থ্য: বাসায় যাঁরা আইসোলেশনে থাকবেন, তাঁদের আপনারা কী পরামর্শ দেন?
রুবীনা ইয়াসমীন: বেশির ভাগ করোনা রোগীর চিকিৎসা বাড়িতেই খুব ভালোভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব। বরং হাসপাতালে স্বজনদের ছাড়া একাকী অনেকেই অসহায় আর অনিরাপদ বোধ করেন। পজিটিভ রিপোর্ট এলে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে একটি চিকিৎসা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরামর্শ নিতে হবে। যাঁদের অন্য কোনো শারীরিক সমস্যা নেই, শ্বাসকষ্ট বা বুকে চাপ অনুভব করছেন না, গুরুতর কোনো শারীরিক অস্বস্তি অনুভব করছেন না, তাঁরা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নিতে পারবেন।
তবে বাড়িতে অন্যদের থেকে রোগীর আলাদা থাকা জরুরি। আলো-বাতাসে ভরা একটি ঘরে তিনি নিজেই নিজের যত্ন নেবেন (সম্ভব হলে), অর্থাৎ তাঁর সংস্পর্শে অন্যরা যত কম যাবেন ততই ভালো। যাঁদের বাসা ছোট বা একসঙ্গে অনেক মানুষের বসবাস তাঁরা আইসোলেশন সেন্টারে যেতে পারেন বা ঘরের এক কোণে যেদিকে জানালা আছে সেখানে পর্দা দিয়ে আলাদা থাকবেন। সংক্রমণ প্রতিরোধে হাঁচি-কাশির আদবকেতা মেনে চলতে হবে, মাস্ক পরতে হবে (হাঁচি-কাশি বা কথা বলার সময় যাতে পরিবেশে খুব বেশি ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে), বারবার হাত ধুতে হবে।
এভাবে পরিবারের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি কমবে। কোনো মা যদি আক্রান্ত হন, যিনি সন্তানকে বুকের দুধ দিচ্ছেন, তিনি মাস্ক পরে, হাত ধুয়ে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াবেন।


প্র স্বাস্থ্য: বাড়িতে করোনায় আক্রান্ত রোগীর কী কী বিষয় খেয়াল করা উচিত আর ঠিক কখন হাসপাতালে যাওয়া উচিত? বাড়ির লোকদের দায়িত্ব কী?
রুবীনা ইয়াসমীন: বাসায় লক্ষ রাখতে হবে শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ বা বড় রকমের কোনো অস্বস্তি হচ্ছে কি না, দিনে দিনে কাশি বেড়ে যাচ্ছে কি না। এ রকম হলে সঙ্গে সঙ্গেই রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। করোনা রোগী আলাদা ঘরে থাকলেও সবার উচিত বারবার তাঁর দিকে খেয়াল রাখা। দরকার হলে ফোনে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা। বাড়ির লোকেরা যদি দেখেন যে তাঁর চৈতন্য কমে যাচ্ছে, জ্ঞানের মাত্রার তারতম্য হচ্ছে, কিছুই খেতে পারছেন না বা অনেক বমি বা ডায়রিয়া হচ্ছে তাহলেও হাসপাতালে নিন। সম্ভব হলে বাড়িতে একটি পালস অক্সিমিটার রাখতে পারেন, যা দিয়ে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা পরিমাপ করা যায়। অক্সিজেনের মাত্রা ৯২ শতাংশের নিচে নেমে এলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
বাড়ির লোকেরা, পারতপক্ষে রোগীর ৩ থেকে ৬ ফুটের মধ্যে যাবেন না। তবে তাঁর প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করতে হবে। পরিবারের একজনের রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর সবারই করোনা পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। রোগীকে সাহস জোগাতে হবে, মানসিকভাবে রোগী যেন দুর্বল হয়ে না পড়েন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অসুস্থ ও বয়স্ক রোগী নিজের যত্ন নিতে না পারলে একজন তাঁর সেবা ও পরিচর্যার জন্য নিয়োজিত থাকবেন, তবে অবশ্যই সংক্রমণ প্রতিরোধের সব নিয়ম মেনে।
রোগীর ঘর নিয়ম মেনে জীবাণুমুক্ত করা উচিত। রোগীকে খাবার দেওয়ার আগে ও পরে হাত ধুতে হবে। রোগীর ঘরে প্রবেশের সময় মাস্ক পরতে হবে এবং বের হয়ে তা ফেলে দিয়ে হাত ধুতে হবে।


প্র স্বাস্থ্য: করোনার নমুনা পরীক্ষার সিরিয়াল পেতে বা রিপোর্ট পেতে দেরি হচ্ছে অনেক। জ্বর বা কাশির মতো উপসর্গ নিয়ে রিপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত কী করা উচিত?
রুবীনা ইয়াসমীন: এখন পরীক্ষা করানো এবং রিপোর্ট পাওয়াসংক্রান্ত জটিলতা আগের চেয়ে অনেকাংশে কমে এসেছে। তারপরও কোনো কারণে পরীক্ষা করাতে দেরি হলেও যেকোনো জ্বরের রোগীকে করোনা রোগী হিসেবে ধরে নিয়েই একইভাবে বাড়িতে আইসোলেশনে রাখতে হবে। একইভাবে দেখভাল করতে হবে এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে নিতে হবে। সুস্থ হওয়ার পরও ১৪ দিন বাড়িতে আইসোলেশনে থাকতে হবে।


প্র স্বাস্থ্য: অনেকেই করোনায় আক্রান্ত নিশ্চিত না হয়েই জ্বর এলেই ভীত হয়ে নানা রকমের ওষুধ খাচ্ছেন। এটা কি ঠিক?
রুবীনা ইয়াসমীন: প্যারাসিটামল, অ্যান্টিহিস্টামিন–জাতীয় ওষুধ এবং কাশির ওষুধ ছাড়া অন্য কিছু দরকার নেই। নিজে থেকে বিভিন্ন ওষুধ খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। যেমন অ্যান্টিবায়োটিক সেবনে পরবর্তীকালে শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা কমে যেতে পারে। আবার কেউ কেউ অকারণে অকার্যকর অপ্রমাণিত ওষুধ খেয়ে ফেলছেন। কিন্তু সব ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। তাই রিপোর্ট আসুক বা না-আসুক, উপসর্গ হলে টেলিমেডিসিনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। পুষ্টিকর খাবার খান। বিশ্রাম নিন।


প্র স্বাস্থ্য: অনেক সময় দেখা যাচ্ছে বাড়িতে থাকা আপাতদৃষ্টে ভালো রোগী হঠাৎ করে মারা যাচ্ছেন। সে কারণে বাড়িতে থাকতে ভয় পাচ্ছেন অনেকে। কোন কোন ক্ষেত্রে উপসর্গ মৃদু বা মাইল্ড হলেও ভর্তি হওয়া উচিত?
রুবীনা ইয়াসমীন: বয়স ৬৫ বছরের বেশি, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি কিডনি বা লিভারের সমস্যা, অ্যাজমা, সিওপিডি বা ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো কোনো ওষুধ সেবন করলে (যেমন ক্যানসারের জন্য কেমোথেরাপি) করোনা পজিটিভ হলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত। তবে আগে থেকে এসব সমস্যা না থাকলে কিংবা জটিলতার লক্ষণগুলোর কোনোটাই না থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যাঁর চিকিৎসা বাড়িতেই সম্ভব, তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি না করে বরং যাঁর সত্যিই অক্সিজেনের প্রয়োজন, হাসপাতালে আসার যাঁর বেশি দরকার তাঁকে সুযোগ দেওয়াই সমীচীন।


প্র স্বাস্থ্য: আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এলে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আরও কোনো নির্দেশনা মেনে চলা উচিত?
রুবীনা ইয়াসমীন: হাসপাতালেই চিকিৎসা হোক আর বাড়িতেই হোক, রিপোর্ট নেগেটিভ এলেও শেষবার পরীক্ষা করানোর দিন থেকে আরও ১৪ দিন অবশ্যই বাড়িতে আইসোলেশনে থাকতে হবে সংক্রমণ প্রতিরোধের সব নিয়ম মেনে।


প্র স্বাস্থ্য: করোনা রোগীর জন্য কোনো বিশেষ জীবনযাপন, খাদ্য ব্যবস্থাপনা বা ব্যায়ামের পরামর্শ দেবেন?
রুবীনা ইয়াসমীন: পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার পান করা জরুরি। পুষ্টিকর খাবারও অবশ্যই প্রয়োজন, যা অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হলেও খেতে বলা হয়। গরম পানি, আদা-চা, লেবু-চা এগুলো গলাব্যথা ও কাশি প্রশমিত করতে সাহায্য করবে। অবশ্যই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। নিজে নিজে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন, যতটা করলে খুব হাঁপিয়ে উঠছেন না। একবারে বেশ খানিকটা সময় করতে পারেন, সারা দিনে ভাগ করেও নিতে পারেন ব্যায়ামের পরিধিটা। মনে জোর রাখুন। আইসোলেশনে থেকেও পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন, ভালো কোনো কাজে সময় কাটান।  
প্র স্বাস্থ্য: বাসায় করোনা রোগীকে সেবাদানকারীর কী কী সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?


রুবীনা ইয়াসমীন: সংক্রমণ প্রতিরোধের নিয়ম মেনে তো চলবেন–ই। যাঁর সেবা করছেন, তাঁর যেদিন প্রথম রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে, সেদিন থেকে হিসাব করে ১৪ দিন সেবাদানকারীও হোম আইসোলেশনে থাকবেন। তাঁরও পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। রিপোর্ট পজিটিভ এলে তাঁকে করোনা রোগীর জন্য প্রযোজ্য সব নিয়ম মেনে চলতে হবে, নেগেটিভ এলেও ওই ১৪ দিন আইসোলেশনে থাকবেন।


প্র স্বাস্থ্য: করোনাকালে সাধারণ মানুষ, যাঁরা আক্রান্ত হননি, তাঁরা কী করতে পারেন?
রুবীনা ইয়াসমীন: সংক্রমণ এড়াতে করণীয়-বর্জনীয় বিষয়গুলো মেনে চলুন। অকারণে বাইরে যাবেন না। আমিষজাতীয় খাবার, ফলমূল, শাকসবজি খেতে হবে। শ্বাসের ব্যায়ামসহ অন্যান্য ব্যায়াম করুন। ছাদে লোকসমাগম কম হলে সেখানে রোদে হাঁটতে পারেন। কখনোই মনের জোর হারাবেন না। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়, ধূমপায়ীর করোনা হলে জটিলতা বেশি হতে পারে। রক্তচাপ ও সুগার সুনিয়ন্ত্রণে রাখুন। সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করুন।


প্র স্বাস্থ্য: আপনাকে ধন্যবাদ।
রুবীনা ইয়াসমীন: আপনাকেও ধন্যবাদ।