'বঙ্গবন্ধু তৃতীয় আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস'-এর প্রতিপাদ্য ও ফ্যাটি লিভারের প্রেক্ষাপট

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব

বেশি দিন আগের কথা নয়, মাত্র তিন বছর আগে সারা পৃথিবী থেকে ১৫০ জন লিভার বিশেষজ্ঞ ঠিক করলেন, তাঁরা ফ্যাটি লিভার সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরির জন্য প্রতিবছর আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস পালন করবেন। ২০১৮ সালের ৫ জুন ওয়াশিংটন, প্যারিস ও লন্ডন থেকে একসঙ্গে প্রচারিত হলো একটি প্রেস রিলিজ। ১২ জুন পালিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস। আমার বিশেষ সৌভাগ্য, বাংলাদেশের যে দুজন লিভার বিশেষজ্ঞ এই প্রেস রিলিজে স্বাক্ষর করার সুযোগ পেয়েছিলেন, আমি তাঁদের অন্যতম। অন্যজন আমার অগ্রজপ্রতিম জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশি লিভার বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর। প্রথম বছর বিশ্বের ২৫টি শহরে উদ্‌যাপিত হয়েছিল দিবসটি। দ্বিতীয় বছরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০টিতে। এ বছর আরও বড় পরিসরে পালিত হওয়ার কথা ছিল দিবসটির। সবচেয়ে বড় কথা, জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকীতে আমাদের প্রস্তাবে এ বছর দিবসটি ‘বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবস’ হিসেবে উদ্‌যাপনে সাদরে সম্মতি জানিয়েছিলেন দিবসটির উদ্যোক্তা সংগঠন ‘গ্লোবাল লিভার ইনস্টিটিউট’। অবশ্য কোভিড-১৯–এর ডামাডোলে এখন তা সংকুচিত হয়ে ভার্চ্যুয়াল জগতে কম্পিউটারের পর্দায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

বছরখানেক আগেও অবশ্য বিষয়টি তেমন ছিল না। আমরা যখন এক যুগের কিছু বেশি সময় আগে লিভার বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য পড়ালেখা করছিলাম, তখনো লিভারের পাঠ্যপুস্তকে এই রোগের জন্য বরাদ্দ ছিল একটি পাতা। আর আজ ফ্যাটি লিভারের ওপরই আছে একাধিক পাঠ্যপুস্তক। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক মেডিকেল প্রকাশনা সংস্থা ম্যাকমিলান আমার সম্পাদনাতেও ফ্যাটি লিভারের ওপর একটি আন্তর্জাতিক পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছিল।

রোগের কারণ

সেদিন আর এদিন এক নয়। ফ্যাটি লিভার এখন ঘরে ঘরে, মুখে মুখে। এ রোগের কথা প্রথম শোনা যায় ১৯৬২ সালে। রোগ হিসেবে ফ্যাটি লিভারের ব্যাপ্তি ব্যাপক। লিভারে সাধারণ চর্বি জমা থেকে শুরু করে এর কারণে লিভার সিরোসিস, এমনকি লিভার ক্যানসারও হতে পারে। ইদানীং পৃথিবীর আরও অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, যেসব রোগীর লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসারের মূল কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, তাঁদের অনেকেই আসলে ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত।

পাশ্চাত্যে ফ্যাটি লিভারের মূল কারণ অ্যালকোহল। তবে আমাদের মতো দেশগুলোতে মেদ-ভুঁড়ি, ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডেমিয়া বা রক্তে অতিরিক্ত চর্বি, হাইপারটেনশন বা অতিরিক্ত রক্তচাপ, হাইপোথাইরয়েডিজম আর মহিলাদের পলিসিস্টিক ওভারি ফ্যাটি লিভারের মূল কারণ। বিশেষ করে ডায়াবেটিসের রোগীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি খুবই বেশি। আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ৩৩ শতাংশ ডায়াবেটিসের রোগীর ফ্যাটি লিভার রয়েছে। অন্যদিকে আমাদের উপমহাদেশে ৪৯ শতাংশ মানুষ, যাঁদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাঁরা পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারেও আক্রান্ত।

হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলোর মধ্যে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস অনেক সময়ই ফ্যাটি লিভার তৈরি করে থাকে। কর্টিকোস্টেরয়েড, টেমোক্সিফেন ইত্যাদি ওষুধ দীর্ঘদিন সেবনেও ফ্যাটি লিভার হতে পারে।

তবে ফ্যাটি লিভারের অন্যতম প্রধান কারণ খাদ্যাভ্যাস ও লাইফস্টাইল। সিডেন্টারি বা আয়েশি জীবনযাপন আর অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট বা ফ্যাটযুক্ত খাবার খেলে লিভারে চর্বি জমতে পারে। আমাদের দেশে ইদানীং খুবই জনপ্রিয় ‘ফাস্ট ফুড’ কালচার এ দেশে ফ্যাটি লিভারের বাড়তি প্রাদুর্ভাবের সম্ভবত একটি বড় কারণ।

সারা বিশ্বেই ফ্যাটি লিভারের দেখা মেলে। প্রায় ৩০ শতাংশ আমেরিকান প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১০ শতাংশ শিশু ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। জাপান ও ইতালিতে মোট জনসংখ্যার ৩০ থেকে ৫৮ শতাংশের ফ্যাটি লিভার রয়েছে।

নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারের মাইক্রোগ্রাফ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস (কাভার)
নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারের মাইক্রোগ্রাফ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস (কাভার)

লক্ষণ ও পরীক্ষা–নিরীক্ষা
ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত অনেকেরই লিভারে ক্রনিক হেপাটাইটিস বা দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ দেখা দিতে পারে, যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় স্টিয়াটো হেপাটাইটিস বা সংক্ষেপে ‘ন্যাশ’। পাশাপাশি এটিও এখন সুপ্রতিষ্ঠিত যে ফ্যাটি লিভার লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের অন্যতম প্রধান কারণ। ভারতীয় উপমহাদেশে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীদের ১৬ শতাংশের ফ্যাটি লিভার রয়েছে। আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নালগুলো ঘাঁটলে দেখা যায়, যেসব রোগীর স্টিয়াটো হেপাটাইটিস আছে, তাঁদের প্রায় ৩০ শতাংশ পরবর্তী সময়ে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হতে পারেন। আর তাঁদের কারও কারও এমনকি লিভার ক্যানসারও হতে পারে। ফ্যাটি লিভার থেকে একবার লিভার সিরোসিস হলে ১৫ শতাংশ রোগী ৭ বছরের মধ্যে এবং ২৫ শতাংশ রোগী ১০ বছরের মধ্যে মৃত্যুবরণের ঝুঁকিতে থাকেন।

অন্যান্য বেশির ভাগ ক্রনিক লিভার ডিজিজ রোগীর মতো ফ্যাটি লিভারের রোগীদেরও প্রায়ই কোনো লক্ষণ থাকে না। এঁদের কেউ কেউ পেটের ডান পাশে ওপরের দিকে ব্যথা, ভার ভার ভাব বা অস্বস্তি, দুর্বলতা কিংবা খুব অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ার কথা বলে থাকেন।

শারীরিক পরীক্ষা–নিরীক্ষায় এসব রোগীর প্রায় ৫০ শতাংশের লিভার বড় পাওয়া যায়। রক্ত পরীক্ষায় সিরাম ট্রান্স-এমাইনেজ বেশি থাকতে পারে। তবে এটি স্বাভাবিক থাকলেই যে লিভারে হেপাটাইটিস নেই, একথা বলা যায় না। ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত পরীক্ষাটি হচ্ছে আলট্রাসনোগ্রাম, যদিও সিটি স্ক্যান বা এমআরআই এ ক্ষেত্রে বেশি নির্ভরযোগ্য। পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারের অধিকাংশ রোগীর রক্তে সুগার, কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড বেশি থাকে।

ফ্যাটি লিভারের রোগীদের রোগ নির্ণয়ের জন্য ইদানীং উপকারী পরীক্ষাটি হচ্ছে ফাইব্রোস্ক্যান। এটি অনেকটা আলট্রাসনোগ্রামের মতো হলেও আসলে আলট্রাসনোগ্রাম নয়। এই মেশিনের সাহায্যে খুব সহজেই লিভারে ফাইব্রোসিস বা স্থায়ী ক্ষতির মাত্রা জানা যায়। অর্থাৎ জানা যায় লিভারে সিরোসিস হওয়ার ঝুঁকি কতখানি। আর এটিই একমাত্র পরীক্ষা, যা দিয়ে লিভারে চর্বিও পরিমাপ করা যায়।

তবে নিশ্চিত করে ফ্যাটি লিভার নির্ণয়ের পরীক্ষাটি হচ্ছে লিভার বায়োপসি। এতে একদিকে যেমন নির্ভুলভাবে ফ্যাটি লিভার ডায়াগনোসিস করা যায়, তেমনি পাশাপাশি লিভারে স্টিয়াটো হেপাটাইটিস এবং সিরোসিসের উপস্থিতি সম্বন্ধেও একমাত্র এই পরীক্ষার মাধ্যমেই শতভাগ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।

চিকিৎসা ও ওষুধ

ফ্যাটি লিভার চিকিৎসার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে লিভারে সিরোসিস ও ক্যানসার প্রতিরোধ করা। অতিরিক্ত মেদ কমানো ফ্যাটি লিভার চিকিৎসার অন্যতম দিক। তবে খুব দ্রুত, অপরিকল্পিতভাবে ওজন কমালে তাতে বরং হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ, এর ফলে লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ওজন কমানোর জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী পরিকল্পিত ডায়েট কন্ট্রোল, এক্সারসাইজ, ওষুধ সেবন কিংবা প্রয়োজনে অপারেশনও করা যেতে পারে। পাশাপাশি ফ্যাটি লিভারের কারণ নির্ণয় এবং তার যথাযথ চিকিৎসাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ফ্যাটি লিভারের কারণে লিভারে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা থেকে লিভারকে রক্ষা এবং পাশাপাশি লিভারে হেপাটাইটিস কমিয়ে আনার জন্য সারা পৃথিবীতেই ব্যাপক গবেষণা চলছে। এ দেশে আমরাও এ বিষয়ে সীমিত পরিসরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। একথা ঠিক যে এখনো এ জন্য শতভাগ কার্যকর কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তবে বাজারে এমন বেশ কিছু ওষুধ আছে, যা ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় কিছুটা উপকারী বলে প্রমাণিত। আর এর সবই বাংলাদেশেই তৈরি হয়। এসব ওষুধের মধ্যে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, প্রোবায়োটিক, ভিটামিন-ই ইত্যাদি।

ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসায় সর্বশেষ যে ওষুধটি ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছে, তা হলো ওবিটাকলিক অ্যাসিড। এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত যা পাওয়া যাচ্ছে, তা থেকে আমরা আশাবাদী, এই ওষুধ যে শুধু লিভারে চর্বির পরিমাণই কমিয়ে থাকে তা–ই নয়, বরং এটিই একমাত্র ওষুধ, যা দিয়ে সম্ভবত লিভারের স্থায়ী ক্ষত বা ফাইব্রোসিসও কমিয়ে আনা যায়। অর্থাৎ ঠেকিয়ে দেওয়া যেতে পারে লিভার সিরোসিস এমনকি লিভার ক্যানসারও। খুবই খুশির কথা এই যে বাংলাদেশেও এই ওষুধ তৈরি এবং বাজারজাত করা হচ্ছে।

একটা সময় ছিল যখন ধারণা করা হতো, হার্ট বা ব্রেইনে চর্বি জমে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করলেও লিভারের ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন নয়। কিন্তু বিগত দশকে সেই ধারণার আমূল পরিবর্তন এসেছে। এটি আজ প্রমাণিত যে লিভারের অন্যতম প্রধান রোগ ফ্যাটি লিভার। সঠিক সময়ে এ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক এবং রোগী সবারই ব্যাপক সচেতনতার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কারণ, শুরুতে ব্যবস্থা নিলে এ রোগ অনেকাংশেই নিরাময়যোগ্য। এবারের ‘বঙ্গবন্ধু তৃতীয় আন্তর্জাতিক ন্যাশ দিবসের’ প্রতিপাদ্যও এটাই।

লেখক: চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, ফোরাম ফর দ্য স্টাডি অব দ্য লিভার, বাংলাদেশ।